দুদকের বিচার চান জাহালম, তদন্ত কমিটি

বিনা অপরাধে জাহালমের তিন বছর কারাভোগের ঘটনা তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি কমিটি গঠন করেছে। জেলা জজ পদমর্যাদার দুদকের পরিচালক (লিগ্যাল) আবুল হাসনাত মো. আবদুল ওয়াদুদকে প্রধান করে এই কমিটি করা হয়েছে। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচার কার্যালয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের একথা জানান।
তিনি বলেন, জাহালমের ঘটনায় দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তাদের যদি কোনো গাফিলতি থেকে থাকে, তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এজন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে কমিটির সম্পর্কে বিস্তারিত জানাননি ইকবাল মাহমুদ। সোনালী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির ২৬টি মামলা থেকে জাহালমকে এক দিনের মধ্যেই অব্যাহতি দিয়ে রোববার সকালে মুক্তির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরে রাত ১টার দিকে গাজীপুরের কাশিমপুরের কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে তিনি মুক্তি পান।
দুদকের দায়ের মামলায় দীর্ঘ ৩ বছর মূল আসামি আবু সালেকের বদলে জাহালমকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়। রাতে মুক্তি পাওয়ার পর সাংবাদিকদের জাহালম বলেন, আমাকে বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছিল। আমি দুদকের বিচার চাই। ক্ষতিপূরণ চাই। যাদের জন্য বিনা বিচারে জেলে আটকে ছিলেন, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও দাবি জানান তিনি।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর সেটি নজরে আনা হলে হাইকোর্ট জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। একই সঙ্গে জাহালমের গ্রেপ্তারের ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র সচিবের প্রতিনিধি ও আইনসচিবের প্রতিনিধিকে ৩রা ফেব্রুয়ারি আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হিসেবে দুদকের মহাপরিচালক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান, মামলার বাদী আবদুল্লাহ আল জাহিদ, স্বরাষ্ট্র সচিবের (সুরক্ষা) প্রতিনিধি যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেন ও আইন সচিবের প্রতিনিধি সৈয়দ মুশফিকুল ইসলাম আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দেন।
প্রসঙ্গত সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। এরপর সালেককে তলব করে দুদক চিঠি দিলে সেই চিঠি পৌঁছায় জাহালমের টাঙ্গাইলের বাড়ির ঠিকানায়। নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলের শ্রমিক জাহালম তখন দুদকে গিয়ে বলেন, তিনি আবু সালেক নন, সোনালী ব্যাংকে তার কোনো অ্যাকাউন্টও নেই। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আবু সালেকের যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে সেটাও তার নয়। কিন্তু দুদকে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা সেদিন জাহালমকেই ‘আবু সালেক’ হিসেবে শনাক্ত করেন। পরে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোড়াশাল থেকে জাহালমকে গ্রেপ্তার করে দুদক।
আদালতেও জাহালম দুদকের পরিচয় বিভ্রাটের বিষয়টি তুলে ধরে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। কিন্তু কেউ তার কথা কানে তোলেনি। কারো কাছে সমাধান না পেয়ে জাহালমের বড় ভাই শাহানূর মিয়া গত বছর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে যান। তার আবেদনে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে জাহালমের সঙ্গে কথা বলেন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। পরে মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসে, আবু সালেক আর জাহালম একই ব্যক্তি নন।
এদিকে বিনা অপরাধে কারাভোগের কারণে জাহালমের জীবন থেকে তিন বছর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ক্ষতিপূরণ ও দুদকের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নিরপরাধ জাহালমকে মুক্তির নির্দেশ ও ভুল তদন্তে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিয়ে আদালত ন্যায়বিচারের গুরুতর বিচ্যুতির অবসান ঘটিয়েছেন। তবে জাহালম মুক্তি পেয়ে গেছেন, এটা ভেবেই আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই।
বরং হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তাকে অবিলম্বে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যদিও জাহালমকে যে অবর্ণনীয় ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তার প্রকৃত ক্ষতিপূরণ কখনই সম্ভব নয়। এ বিবেচনা থেকেই এই ঘটনার গুরুত্ব নির্ধারণ করতে হবে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় দুদক প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এতে করে কমিশনের প্রতি দেশের জনগণের আস্থাহীনতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। তাই কিভাবে এই ঘটনা সংঘটিত হলো, কারা জড়িত ছিল, কেন এমন ভুল তারা করল, নাকি প্রকৃত অপরাধীর সঙ্গে যোগসাজশে তারা এই জালিয়াতিতে অংশ নিয়েছে এই সবগুলো বিষয়ই তদন্ত করে দেখতে হবে। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ও আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে এধরনের অবিচার আর কারও সঙ্গে না হয়। টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, দুদক যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, সেই কমিটি সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করবে এবং তদন্তের ফল ও তার ভিত্তিতে কী পদক্ষেপ গৃহীত হলো সে সম্পর্কে দুদক দেশের জনগণকে অবহিত করবে সেটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করতে চাই, জাহালমের মতো আর কেউ এভাবে বিনাবিচারে কারভোগ করছেন না এবং ভবিষ্যতেও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। শুধু দুঃখপ্রকাশ নয়, জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে দুদক আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

No comments

Powered by Blogger.