ছয় গ্রেডে পোশাক শ্রমিকদের বেতন বাড়লো: আশুলিয়ায় বিক্ষোভ, সংঘর্ষ

পোশাক শ্রমিকদের মজুরি কাঠামোর গ্রেডে সমন্বয় করেছে সরকার। যৌক্তিক হারে বেতন বৃদ্ধি করে গ্রেডগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর ছয়টি গ্রেডে বেতন বাড়িয়েছে সরকার। গতকাল শ্রম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মালিক-শ্রমিক ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এই সিদ্ধান্ত জানান। নতুন কাঠামোতে চিকিৎসা, যাতায়াত, বাড়িভাড়া বাড়ানো ছাড়াও মূল মজুরির সঙ্গে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট ঘোষণা করা হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির ঘোষিত কাঠামোতে দেখা গেছে, এক নম্বর গ্রেডে শ্রমিকদের মজুরি ৭৪৭ টাকা, দুই নম্বর গ্রেডে ৭৮৬ টাকা, তিন নম্বর গ্রেডে ২৫৫ টাকা, চার নম্বর গ্রেডে ১০২ টাকা ও পাঁচ নম্বর গ্রেডে মজুরি ২০ টাকা বেড়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, প্রথম গ্রেডের একজন কর্মী সব মিলিয়ে ১৮ হাজার ২৫৭ টাকা বেতন পাবেন। ২০১৩ সালের বেতন কাঠামোতে এই গ্রেডের মজুরি ছিল ১৩ হাজার টাকা।
২০১৮ সালে নতুন মজুরি কাঠামোর গেজেটে তা ১৭ হাজার ৫১০ টাকা করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় গ্রেডের সর্বমোট বেতন ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৪১৬ টাকা। ২০১৩ সালের বেতন কাঠামোতে এই গ্রেডের বেতন ১০ হাজার ৯০০ টাকা এবং ২০১৮ সালের গেজেটে তা ১৪ হাজার ৬৩০ টাকা করা হয়েছিল।
তৃতীয় গ্রেডের সর্বমোট বেতন ঠিক হয়েছে ৯ হাজার ৮৪৫ টাকা, যা ২০১৩ সালের বেতন কাঠামোতে ৬ হাজার ৮০৫ টাকা এবং ২০১৮ সালের গেজেটে ৯ হাজার ৮৪৫ টাকা করা হয়েছিল।
চতুর্থ গ্রেডের সর্বমোট বেতন ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৩৪৭ টাকা। ২০১৩ সালের বেতন কাঠামোতে এই গ্রেডের বেতন ৬ হাজার ৪২০ টাকা ছিল। ২০১৮ সালের নতুন কাঠামোর করা হয়েছিল ৯ হাজার ২৪৫ টাকা।
পঞ্চম গ্রেডে সর্বমোট বেতন ঠিক হয়েছে ৮ হাজার ৮৭৫ টাকা, যা ২০১৩ সালের বেতন কাঠামোতে ৬ হাজার ৪২ টাকা এবং ২০১৮ সালের গেজেটে ৮ হাজার ৮৭৫ টাকা ছিল।
ষষ্ঠ গ্রেডের সর্বমোট বেতন ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪২০ টাকা। ২০১৩ সালের বেতন কাঠামোতে তা ছিল ৫ হাজার ৬৭৮। আর ২০১৮ সালে মজুরি কাঠামোর গেজেটে তা বাড়িয়ে ৮ হাজার ৪০৫ টাকা করা হয়েছিল।
সপ্তম গ্রেডের মজুরি সব মিলিয়ে আট হাজার টাকাই রাখা হয়েছে। ২০১৩ সালের কাঠামোতে সর্বনিম্ন গ্রেডের বেতন ছিল ৫৩০০ টাকা।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, সংশোধিত এই কাঠামো ২০১৮ সালের ১লা ডিসেম্বর থেকেই কার্যকর ধরা হবে। বর্ধিত অংশের টাকা ফেব্রুয়ারির বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। আগামী সাত দিনের মধ্যে সংশোধিত কাঠামোর গেজেট প্রকাশ করা হবে জানিয়ে শ্রমিকদের কাজে ফেরার আহ্বান জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, শ্রমিকদের অধিকাংশই ভাঙচুর চায় না। কাজ করতে চায়। আমি আশা করবো, তারা সবাই শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগ দেবেন।
তিনটির বদলে ৬টি গ্রেড পর্যালোচনার কারণ ব্যাখ্যা করে বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ১০ তারিখে যখন আলোচনা হয়েছিল তখন শুধু ৩, ৪, ও ৫ নম্বর গ্রেড নিয়ে আলোচনার করার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু আমরা মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বললাম যে ১ থেকে ৫ পর্যন্ত করবো, তাহলে ৬ কেন বাদ যাবে। এজন্য আমরা ছয়টি গ্রেড সমন্বয় করে দিয়েছি।
বৈঠকে উপস্থিত শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিনও সংশোধিত মজুরি কাঠামোকে স্বাগত জানিয়ে শ্রমিকদের কাজে ফেরার আহ্বান জানান। আরেক শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার বলেন, প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন আমরা তা মেনে নিয়েছি। তবে শ্রমিকরা এখন কি সিদ্ধান্ত নেবেন তা তাদের ব্যাপার।
বৈঠক শেষে পোশাক মালিকদের পক্ষে শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, গত কয়েকদিনে আন্দোলনের নামে যারা পোশাক কারখানা ভাঙচুর করেছে তাদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। সম্পদ রক্ষায় সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। সরকার যেন কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়। এ সময় পোশাক শ্রমিকদের অনতিবিলম্বে কাজে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বেতন কাঠামো সংশোধনের প্রস্তাবে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের সভাপতিত্বে বৈঠকে বাণিজ্য সচিব মফিজুল ইসলাম, পোশাক কারখানা মালিকদের পক্ষে বিজিএমই’ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, সালাম মুর্শেদী, আতিকুর রহমান, শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, এ কে আজাদ এবং শ্রমিকদের পক্ষে নাজমা আকতার, ফজলুল হক মন্টু, আমিরুল হক আমিন উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা নির্ধারণ করে গত ২৫শে নভেম্বর গেজেট প্রকাশ করে সরকার। ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে তা কার্যকর করার নির্দেশনা দেয়া হয় সেখানে। ওই মজুরি কাঠামোর কয়েকটি গ্রেডে বেতন কমে যাওয়ার অভিযোগ জানিয়ে বিক্ষোভ করে শ্রমিকরা। এরপর শ্রম সচিবকে প্রধান করে ১২ সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি করে শ্রম মন্ত্রণালয়। ওই কমিটি গতকাল নতুন করে মজুরি কাঠামোর সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত জানান।
আশুলিয়ায় শ্রমিক বিক্ষোভ অব্যাহত, পাঁচ শতাধিক কারখানা বন্ধ ঘোষণা
ঘোষিত মজুরি কাঠামোতে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে টানা ৭ম দিনের মতো আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন তৈরিপোশাক শ্রমিকরা। এসময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন কারখানায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে ভাঙচুর চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ শ্রমিকদের বাধা দিলে দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে আহত হয়েছে অন্তত ২০ শ্রমিক। এছাড়া শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনায় জামগড়া, নরসিংহপুর, জিরাবো, কাঠগড়াসহ বিভিন্ন এলাকার পাঁচ শতাধিক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ। ওদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বৈষম্য দূরীকরণে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হলে গাজীপুর, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকার শ্রমিকরা কাজে যোগদান করেছেন। তবে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় শ্রমিকদের আন্দোলনে ঘি ঢেলে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে ভূঁইফোড় শ্রমিক সংগঠন, স্থানীয় ঝুট ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, ভূঁইফোড় শ্রমিক সংগঠন এবং পদবঞ্চিত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
গতকাল  জামগড়া এলাকার শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করে কাজ না করে শুধু হাজিরা কার্ড পাঞ্চ করে বের হয়ে যান। পরবর্তীকালে তারা সড়কে অবস্থান নিয়ে যানবাহনে ভাঙচুরের চেষ্টা চালান। এ ঘটনায় পুলিশ বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ারশেল ও জলকামান ব্যবহারসহ লাঠিচার্জ করে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এভাবে উভয়পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় চলা সংঘর্ষের ঘটনায় কমপক্ষে আহত হয়েছে অন্তত ২০। তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে টানা শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তৈরিপোশাক  মালিকরা। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেছে তৈরিপোশাক মালিক রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। সংবাদ সম্মেলন থেকে বিজিএমইএ’র সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান শ্রমিকদের সোমবারের মধ্যে কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। এসময় সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পোশাকশিল্পকে ধ্বংস করার জন্য একটি মহল শ্রমিকদের সরলতার সুযোগ নিয়ে কারখানায় ভাঙচুর-হামলা করেছে।
এ ঘটনায় তিনি সরকারের কাছে জানমালের নিরাপত্তা চেয়ে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবি জানান। ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান বলেন, টানা শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায়  রোববার শিল্পাঞ্চলের পাঁচ শতাধিক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধের চেষ্টা করলে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ও বিজিবির টহলের পাশাপাশি প্রতিটি কারখানার সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.