যে কারণে ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হবে -রয়টার্সের বিশ্লেষণ

ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞা আজ থেকে কার্যকর হয়েছে। প্রধানত ইরানের তেল ও গ্যাস শিল্পকে টার্গেট করে এসব নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির আওতায় ইরান এসব নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পেয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন ছয় মাস আগে জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন, সংক্ষেপে জেসিপিওএ নামে পরিচিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেয়। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আবারো পূর্বের নিষেধাজ্ঞা আরোপের নীতি অনুসরণ করতে শুরু করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যাওয়ার পরেও চীন, রাশিয়াসহ ইউরোপের দেশগুলো জেসিপিওএ চুক্তি বহাল রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মূলত জেসিপিওএ চুক্তিকে পুরোপুরি অকার্যকর করতে চাচ্ছেন। এ ছাড়াও তিনি ইরানের অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বংস করতে চান, আঞ্চলিক যুদ্ধগুলোতে ইরানের সংশ্লিষ্টতা কমিয়ে আনা ও সে দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের পতন উদ্‌যাপন করতে চান।
যদিও এ ধরনের বক্তব্য হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। প্রকাশ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দপ্তরের অবস্থান হলো, তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে ইরানকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করতে চান। যেখানে জেসিপিওএ’র পরিবর্তে নতুন একটি চুক্তির বিষয়ে আলোচনা হবে, যাতে ট্রাম্পের নাম থাকবে। কিন্তু এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ট্রাম্পের অনুসৃত নীতি ব্যর্থ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেল রপ্তানির পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনতে চান। কিন্তু এটা এখন পরিষ্কার যে, যুক্তরাষ্ট্রের এ চাওয়া অবাস্তব। কেননা, ইরান প্রতিদিন যে ২৫ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি করে, বাজারে এর টেকসই কোনো প্রতিস্থাপক নেই। যদিও সৌদি আরব বলেছে, ইরানের তেল বিক্রি বন্ধ করা হলে বাজারে যে ঘাটতি দেখা দেবে, রিয়াদ অতিরিক্ত তেল রপ্তানি করে তা পুষিয়ে দেবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানি তেলের চাহিদা পূরণ করার সামর্থ্য রিয়াদ ও এর মিত্রদের নেই। এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ফলে যদি ইরানের তেল রপ্তানি ২৫ লাখ ব্যারেল থেকে ১৫ লাখ ব্যারেলে নেমে আসে, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ১০০ ডলারেও পৌঁছতে পারে, যার বর্তমান মূল্য ৭৬ ডলার। এমন অবস্থায় ইরান যদি তাদের তেল রপ্তানি ১০ লাখ ডলারেও নামিয়ে নিয়ে আসে, তার পরেও মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে ইরান তাদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। এ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর কার্যত তেমন প্রভাব ফেলবে না।
দ্বিতীয়ত, চীনের সঙ্গে ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ ও রুশ অর্থনীতির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে ইরান ইস্যুতে মস্কো ও বেইজিং ওয়াশিংটনের পক্ষে কাজ করতে অপেক্ষাকৃত কম স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকেও ইতিবাচক সাড়া পাবে না যুক্তরাষ্ট্র। কেননা, ইউরোপীয় দেশগুলো ট্রাম্প বেরিয়ে যাওয়ার পরেও জেসিপিওএ চুক্তি কার্যকর রাখার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া, ইউরোপের দেশগুলো বাইরের কোনো দেশের নিষেধাজ্ঞাকে নিজেদের আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার জন্য হুমকি বলে মনে করে। সম্প্রতি ফরাসি অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লি মাইরে বলেছেন, ইরান সংকটের ফলে ইউরোপের সামনে স্বনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরির সুযোগ তৈরি হয়েছে। যেন আমরা পছন্দ মতো যে কারো সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারি। ইইউ’র প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্সের এমন অবস্থান স্পষ্টই বুঝিয়ে দেয়, তারা মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে ইরানের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় বদ্ধপরিকর।
তৃতীয়ত, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন আনার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। দশকের পর দশক ধরে, মার্কিন ডলার আন্তর্জাতিক বাজারে কর্তৃত্ব করেছে। এখন জেসিপিওএ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যাওয়ার ফলে রাশিয়া, চীন, ভারত ও তুরস্কের মতো দেশগুলো নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন করতে উৎসাহিত হয়েছে। ইউরোপ যদি যুক্তরাষ্ট্রকে বাইরে রেখে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে সফল হয়, তাহলে অন্য দেশগুলো ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য করতে ডলারের পরিবর্তে ইউরো ব্যবহার করবে। এর ফলে বিশ্ব বাজারে মার্কিন ডলার কর্তৃত্ব হারাবে।
চতুর্থত, জেসিপিওএ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অবশিষ্ট দেশগুলো এই চুক্তিকে একতরফা মার্কিন কর্তৃত্ববাদ প্রতিহত করার অন্যতম উপায় হিসেবে দেখছে। কেননা, জেসিপিওএ জাতিসংঘ সিকিউরিটি কাউন্সিল রিজল্যুশন-২২৩১ অনুসারে স্বাক্ষরিত একটি বহুপক্ষীয় চুক্তি। যে চুক্তি থেকে ট্রাম্প একতরফাভাবে বেরিয়ে গেছেন। শুধু তাই না, যে দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই জেসিপিওএ চুক্তি এগিয়ে নিতে চাচ্ছে, ট্রাম্প তাদের শাস্তি দেয়ার চেষ্টা করছেন।
এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী মনোভাব আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে। তা এড়ানোর জন্য কৌশলগত প্রয়োজন হিসেবেই ইরান ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জেসিপিওএ চুক্তি বহাল রাখার চেষ্টা করবে।
পঞ্চমত, ইইউ ও জাপানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশগুলোও জেসিপিওএ চুক্তির প্রতি সমর্থন দেয়া অব্যাহত রেখেছে। সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও ইসরাইলের মতো গুটিকয়েক আঞ্চলিক মিত্র দেশ ট্রাম্পের পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে। অন্যদিকে, তুরস্ক, ওমান ও ইরাক চুক্তি বহাল রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এমন অবস্থায় আঞ্চলিক সংকটগুলো যেভাবে মোড় নিচ্ছে, তা কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ইরান ও রাশিয়াসমর্থিত বাশার আল আসাদ বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছেন। আফগানিস্তানে মার্কিন মিশন ব্যর্থ হয়েছে। ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট। এ ছাড়া, সৌদি জোটের অবরোধ সত্ত্বেও কাতার বেশ উন্নতি করেছে। এমন বিশ্ব পরিস্থিতি ইরানকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় সহায়তা করবে। এসব অঞ্চল প্রায় ছয় দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। কিন্তু ট্রাম্পের একতরফা কর্তৃত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ট্রান্স আটলান্টিক মিত্র দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের হিসাব-নিকাশ বদলে যাবে। ইস্টার্ন ব্লক ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। একই সঙ্গে ইউরোপের সঙ্গে ইরান, তুরস্ক ও ইরাকের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ঘনিষ্ঠতা বাড়বে।
যাহোক, জেসিপিওএ চুক্তি অন্য বিশ্বশক্তিগুলোকে পথ দেখিয়ে দিয়েছে যে, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই আন্তর্জাতিক সমঝোতা চুক্তি বহাল রাখা যায়। বিশ্ব পরিসর থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক শক্তির রাজনীতি বহুমাত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় রূপান্তরিত হতে পারে। যেখানে আঞ্চলিক শক্তিগুলো আরো কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

No comments

Powered by Blogger.