ইসি-ঐক্যফ্রন্ট বৈঠকে উত্তাপ: সংলাপ শেষ হওয়ার আগে তফসিল না দেয়ার দাবি

সরকারের সঙ্গে সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করতে নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। গতকাল নির্বাচন ভবনে ঐক্যফ্রন্টের একটি প্রতিনিধি দল ইসি’র সঙ্গে বৈঠক করে এ আহ্বান জানায়। জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের অপর সদস্যরা হলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বরকতউল্লাহ বুলু, ডাকসু’র সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। অপরদিকে ইসি’র পক্ষে বৈঠকে নেতৃত্ব দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা।
এ সময় অপর চার  কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, শাহাদত হোসেন চৌধুরী ও কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সরকারের সঙ্গে সংলাপের ফল দেখে তফসিল ঘোষণার দাবি জানান ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। এছাড়া নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ারসহ সেনা মোতায়েন করার দাবি ও ইভিএম ব্যবহার থেকে বিরত থাকার দাবি জানানো হয়। ঐক্যফ্রন্টের এসব দাবির প্রেক্ষিতে সুস্পষ্ট কোনো আশ্বাস দেয়নি ইসি।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইসি জানিয়েছে, পরবর্তীতে ইসি সিদ্ধান্ত নেবে। যদিও বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা জানিয়েছেন আলোচনা ভালো হলেও তাদের নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি অব্যাহত রয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকের একপর্যায়ে ইসি’র ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা থাকা না থাকা নিয়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়।
ইসি’র ওপর আস্থা বিষয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, তারা ইসি’র ওপর অনাস্থা জানাতে আসেননি। তবে এই নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা নেই। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আস্থা নেই। নেতারা শুধু বড় বড় কথা বলেন। সিইসি’র এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান মান্না। তিনি সিইসিকে সংযতভাবে বক্তব্য দেয়ার জন্য আহ্বান জানান। বৈঠকে তিন সিটি নির্বাচনে ইসি’র ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলেন, দেশের মানুষ দেখেছে রাজশাহী সিটিতে কীভাবে নির্বাচন হয়েছে। একটি কেন্দ্রেও বিএনপি’র এজেন্টরা ঢুকতে পারেননি। নির্বাচন কমিশন এক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে বলে অভিযোগ উত্থাপন করেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়েও পাল্টাপাল্টি কথা হয় ইসি ও ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের মধ্যে। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, আইনে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে সেনা মোতায়েনের সুযোগ নেই। অতীতে যেভাবে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনা মোতায়েন হয়েছে সেভাবে হয়তো হতে পারে। কিন্তু সেটা তফসিল ঘোষণার পর কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। তার এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলেন, ভোটারদের আস্থা অর্জনের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন রয়েছে।
দুর্বৃত্তদের দমন করার জন্য সেনাবাহিনীকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতাও দেয়া প্রয়োজন। প্রতিনিধিদলের অপর সদস্য সুলতান মনসুর বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে এক দলের নেতা আরেক জেলায় জেলে। এভাবে চলতে পারে না। তিনি ইসিকে সতর্ক করে বলেন, ৫ই জানুয়ারির মতো নির্বাচন আর করা যাবে না। বৈঠকে ইভিএম নিয়েও পাল্টাপাল্টি চ্যালেঞ্জ ছোড়া হয়। ইভিএম’র ম্যানিপুলেট করা যায় এমন দাবি করেন মাহমুদুর রহমান মান্না।
এ সময় নির্বাচন কমিশনাররা চ্যালেঞ্জ করে বলেন, ইভিএম’র ফল ম্যানিপুুলেট করা সম্ভব না। প্রতিউত্তরে মান্না বলেন, তিনি দেখিয়ে দেবেন কীভাবে ইভিএম’র ফল ম্যানিপুলেট করা সম্ভব। বৈঠকে একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, রাজনৈতিক দল হচ্ছে ইসি’র মূল স্টেকহোল্ডার। ইসি যেন বিতর্কিত না হয় রাজনৈতিক দলগুলোর সেভাবেই সহযোগিতা করা উচিত। বৈঠকে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বুধবার সরকারের সঙ্গে সংলাপের ফল দেখে ইসিকে তফসিল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য অনুরোধ জানান।
কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তফসিল ঘোষণার আগে বৃহস্পতিবার সকালে বৈঠক করবে কমিশন। সেখানে সিদ্ধান্ত হবে তফসিল পেছাবে কি-না। বৈঠক শেষে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও জেএসডি সভাপতি আ স ম রব সাংবাদিকদের বলেন, সাত দফা কর্মসূচির আলোকে আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে ও সরকারের কাছে যে দাবিগুলো জানিয়েছি তার কিছু কিছু বিষয় উনারা কথা দিয়েছেন আজকেই রক্ষা করবেন। বাকি দুই একটি বিষয় উনারা চূড়ান্ত করতে পারেননি। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা বলেছি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৭ই নভেম্বর আমাদের সংলাপের ফলাফল না জেনে নির্বাচন কমিশন যেন কোনো তফসিল ঘোষণা না করেন। ২৮শে জানুয়ারি পর্যন্ত সংসদের মেয়াদ আছে। অনেক সময় এখনো রয়েছে।
ইতিপূর্বে বহুবার তফসিল পরিবর্তনের রেকর্ড আছে। অতএব এবারও ৮ তারিখে তফসিল ঘোষণা করতেই হবে- না হলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, এমন না। বরং নির্বাচন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে যদি রাজনৈতিক দলগুলো যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে তফসিল ঘোষণা করলে। তিনি বলেন, পোলিং এজেন্টদের নিরাপত্তা দেয়া হবে ইসি বলেছে। প্রতিটি কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট যাতে সাহসিকতার সঙ্গে উপস্থিত থেকে ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকতে পারে এর ব্যবস্থা করবে। ভোট শেষে ফলাফল ঘোষণা হওয়ার পর প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার স্বাক্ষরিত ফলাফল তৃণমূলে এবং সকল দলের এজেন্টকে সরবরাহ করবে।
ফল গণনার আগে কারচুপির জন্য এজেন্টদের কাছ থেকে কোনো ফরমে বা সাদা কাগজে আগেই স্বাক্ষর নেয়া হবে না। জেএসডি সভাপতি বলেন, অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য চেষ্টা করবে বলে ইসি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা বলেছেন, নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্র পরিচালনা করে না নির্বাচন করায়। আপনারা এদেশের জনগণ আমরাও এদেশের জনগণ, ভোটাররাও এদেশের জনগণ। নির্বাচনের পরেও আমাদের মা-বাবা, সন্তান-সন্ততি এদেশে থাকতে হবে। আমরা বলেছি, আপনারা ২০১৯ সালের নির্বাচনের পরে এদেশে থাকবেন সেভাবেই কাজ করবেন।
আ স ম রব আরো বলেন, ভোটার ও রাজনৈতিক দলগুলো ইভিএম চায় না এজন্য আমরা নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার দাবি জানিয়েছি। তারা ইভিএম ব্যবহারের বিভিন্ন যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে। কিন্তু ব্যবহার করবে না এমন নিশ্চয়তা দেয়নি। সেনাবাহিনীকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দিয়ে মোতায়েনের দাবি জানিয়েছি। সিইসি বলেছেন, অতীতে সব নির্বাচনে সেনাবাহিনী ছিল। এবার থাকবে না এমন কথা আমি বলিনি। ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবির মধ্যে নির্বাচন পুনর্গঠনের বিষয়টি ছিল। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমাদের এ দাবি অব্যাহত থাকবে।
ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ৭ তারিখে একটি আলোচনা আছে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা সেখানে নজর রাখতে বলেছেন। তফসিল ঘোষণার এখতিয়ার একমাত্র নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। ৮ তারিখে তফসিলের বিষয়ে যেহেতু সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। ৭ তারিখের বৈঠকের ফলাফল ৮ তারিখে প্রতিফলিত হবে। ৮ তারিখ সকাল ১০ টায় কমিশন সভায় সংলাপের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। ইসি’র ওপর ঐক্যফ্রন্টের আস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব বলেন, নির্বাচন কমিশন একমাত্র সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যারা নির্বাচন পরিচালনা করবে। উনারা বলেছেন ইসি’র প্রতি আমাদের আস্থা আছে এজন্য আলোচনা করতে এসেছেন এবং আন্তরিকভাবে আলোচনা করেছেন। বৈঠকে দু’পক্ষে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে কি-না জানতে চাইলে হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় নয়, ওনারা রাজনৈতিক নেতা। ভেতরে গলার আওয়াজ এমনই ছিল।

No comments

Powered by Blogger.