ময়মনসিংহ টু ঢাকা: ১৪ বার পথরোধ এক অ্যাম্বুলেন্সের by পিয়াস সরকার

পরনে সাদা টি-শার্ট সঙ্গে হালকা নীল রংয়ের লুঙ্গি। পোশাকে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। বাম হাতে ও দু’পায়ে ব্যান্ডেজ। সাদা ব্যান্ডেজও ছাপিয়ে গেছে রক্তের দাগে। ব্যথায় কাতরাচ্ছেন আমিরুল ইসলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। ময়মনসিংহ থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নিয়ে আসেন স্বজনরা। ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে আমিরুলকে ঢাকায় নিয়ে আসা অ্যাম্বুলেন্স চালক মান্না জানান, সকাল ৬টায় রোগীকে নিয়ে রওনা দেন তারা।
সাধারণত সকাল বেলা ঢাকা আসতে ৪ ঘণ্টার মতো লাগলেও লেগেছে প্রায় ৬ ঘণ্টা। রাস্তায় কোনো যানজট ছিল না। তবে পথে আন্দোলনরত শ্রমিকরা বারবার পথ আটকিয়েছে। পথরোধ করে পরীক্ষা করেছে অ্যাম্বুলেন্সে রোগী আছে কিনা। অ্যাম্বুলেন্স চালক মান্না গুনে গুনে জানালেন ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা আসতে ১৪ স্থানে তাদের পথ রোধ করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দূরত্ব প্রায় ১২১ কিলোমিটার। অর্থাৎ প্রতি ৮ দশমিক ৬ কিলোমিটার অন্তর অন্তর গতিরোধ হয়েছে। এমন অভিযোগ পাওয়া যায় আরো অনেক অ্যাম্বুলেন্স চালকের কাছ থেকে। কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে রোগী নিয়ে আসতেও পড়েছেন ৭ থেকে ৮ বার গতিরোধের মুখে, জানান অ্যাম্বুলেন্স চালক ফিরোজ মাহমুদ।
কথা হয় রোগী আমিরুল ইসলামের ভাই আমজাদ ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, বাড়ির চার তলার কাজ চলছে তাদের। তিন তলার ছাদ থেকে হঠাৎ পড়ে যান তার ভাই। ভেঙে যায় বাম হাত ও দুই পা। ব্যথা পেয়েছেন মাথাতেও। রোববার সকালের সেই ঘটনার পর নিয়ে যান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ভাঙা হাত-পা ও মাথায় প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসেন তাদের পরামর্শ মতো।
তিনি বলেন, আজ (গতকাল) সকাল ৬টায় রওনা দিয়েছি। পৌঁছলাম সকাল ১২টায়। রাস্তায় যতবার আটকিয়েছে ততবার নিজেকে অসহায় লেগেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, অ্যাম্বুলেন্স কেন আটকাবে? তাদের উচিত ছিল দ্রুত রাস্তা ছেড়ে দেয়া। বরং উল্টো অ্যাম্বুলেন্স আটকালো বারবার।
ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগের সামনে রাস্তায় বসে কাঁদছিলেন রাহেলা বেগম (ছদ্মনাম)। সঙ্গে তার স্বামী ও ছোট মেয়ে। সান্ত্বনা দিচ্ছেন স্বামী রফিক মিয়া (ছদ্মনাম)। স্ত্রী শান্ত হবার পর জানার চেষ্টা কান্নার কারণ। রফিক মিয়া জানান, তার শ্বশুরকে হাজত থেকে আজ সকালে ডাক্তার দেখানোর জন্য নিয়ে আসা হবে। খবর পেয়ে সকাল ৭টার সময় বের হন তারা। খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের পরিবারটি জানতো না চলছে ধর্মঘট। ঘণ্টাখানেক রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষার পর জানতে পারেন তারা। এরপর অটোরিকশা ও ভ্যানে করে এসেছেন গাবতলীতে। গাবতলী থেকে হেঁটে মেডিকেলে। পৌঁছানোর পর জানতে পারেন ডাক্তার দেখিয়ে চলে গেছে তার শ্বশুর। ধামরাই থেকে বাসে আসতে সাধারণত সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। তাদের সময় লেগেছে ৪ ঘণ্টা। অনেক ঝামেলা পার করে বাবাকে দেখতে না পারার কারণেই এই কান্না।
গ্লাসের টুকরা দিয়ে পা কেটে গিয়েছে রাইসা হকের। তিনি এশিয়া প্যাসেফিক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। মেসমেটদের নিয়ে সকাল ১০টার দিকে এসেছেন অ্যাপভিত্তিক কার সেবা উবারে করে। ব্যান্ডেজ করানোর পর এবার ফেরার পালা। ঢাকা মেডিকেল থেকে বেরিয়ে তিনটি মোবাইল থেকে চেষ্টা করেও মিলছিল না কোনো গাড়ি।
তখন ঘড়িতে সময় সকাল ১২টা। শহীদ মিনারের সামনে উবার কার চালক রাশেদ হোসেন চা ও রুটি দিয়ে সারছিলেন সকালের নাস্তা। পাশেই রাখা তার গাড়ি। তিনি জানান, সকাল থেকেই যাত্রীর চাপ। ভোরবেলা বের হয়েছি এখন পর্যন্ত দম ফেলার সময় পাইনি। ৫ ঘণ্টায় পেয়েছি ৮টি ট্রিপ। অন্যদিন ট্রিপের জন্য অপেক্ষা করতে হলেও আজ মিলছে সঙ্গে সঙ্গেই। মোবাইল দেখিয়ে বলেন, দেখেন এখনো রয়েছে ৪টি রিকোয়েস্ট।
তবে পাশেই মেলে ভিন্ন চিত্র। অ্যাপভিত্তিক বাইকাররা খুঁজছেন খেপ। উবার, পাঠাও, ওভাই’র চালকরা শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। তাদের পাশ দিয়ে যেতেই ভাই যাবেন। বললাম কাওরান বাজার কত? একজন বললেন ১০০। আরেকজন বললেন ৮০ টাকা। শেষে একজন ৬০ টাকায় যেতে রাজি হলেন। তখন অ্যাপে কাওরান বাজারে ছাড় ছাড়া দেখায় ৭০ টাকা এবং ছাড়সহ ৪০ টাকা।
ইব্রাহীম কার্ডিয়াক (বারডেম) হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখা যায় অন্যান্য দিনের তুলনায় ডাক্তারের কাছে আসা রোগীর সংখ্যা কম। প্রতিমাসে চেকআপ করাতে আসেন মৃণ্ময় সেন। বয়স আনুমানিক ৭০। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে পেয়েছেন বিআরটিসি দোতলা বাস। এখন তারা চিন্তিত যাবেন কীভাবে। একই রকম সমস্যায় পড়েছেন আরো অনেকে। আদাবর ১৪ যাবার জন্য রিকশা খুঁজছিলেন আরেক ব্যক্তি, সঙ্গে  তার স্ত্রী। অনেক রিকশা দাঁড়ানো থাকলেও মিলছে না ভাড়ায়। সাধারণত ১০০ থেকে ১২০ টাকা ভাড়া হলেও সবাই চাইছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যালেও দেখা যায় অভিন্ন চিত্র। রোগী ও স্বজনরা আসা যাওয়ায় ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। নীলফামারী জেলার ডোমার থেকে আসা রোগী আসমা খাতুন কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। দীর্ঘ ১৭ দিন হাসপাতালে থেকে ছাড়া পেয়েছেন গতকাল। এতদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পরেও যেতে পারছেন না বাড়িতে। তার ছেলে আতিকুর রহমান বলেন, অ্যাতদিন পর যাওয়ার কথা আইল। আর আটকা পড়নো হরতালোত। অ্যাম্বুলেন্সত করি যাইতে ম্যালা ট্যাকা লাগে। এলা হরতাল খুললে বাসত করি যামো।

No comments

Powered by Blogger.