বার্নিকাটের অনন্য কূটনীতি by মিজানুর রহমান

চলনে একেবারেই সাদামাটা। মিশতে পারেন সবার সঙ্গে, খোলা মনে। কিন্তু ব্যক্তিত্বে তার অবস্থান অনন্য উচ্চতায়। এসব গুণেই ছোট-বড় সব সহকর্মীর মনে জায়গা করে নেন অল্প সময়ে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট সম্পর্কে এভাবেই বলছিলেন তার অধঃস্তন এক সহকর্মী।
২০১৫ সালের বসন্তের এক বিকালে দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশে আসা রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট সম্পর্কে তার সহকর্মী যে বাড়িয়ে বলেননি, তার প্রমাণ মিললো সেগুনবাগিচার এক আড্ডায়। সেখানে ঢাকার এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকের মূল্যায়ন ছিল এমন- মার্কিন দূত মানেই হাইপ্রোফাইল। এটা প্রতিষ্ঠিত।
কিন্তু বার্নিকাট তার ব্যক্তিত্ব এবং পেশাদারিত্ব দিয়ে সবাইকে জয় করেছেন। সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা যেমন করেছেন অকপটে, তেমনি সমালোচনাতেও ছাড় দেননি। সরকার ও বিরোধী মহলে তার যোগাযোগে একধরনের ভারসাম্য ছিল। এটাই পেশাদারিত্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যেমন গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সহিংসতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ- প্রায় সব ইস্যুতেই তিনি সরব ছিলেন। তার অনেক বক্তব্য বা প্রতিক্রিয়া সরকার পছন্দ করেনি। বিশেষ করে গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে তার মন্তব্য, কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবির প্রতি যুক্তরাষ্ট্র তথা কূটনীতিকদের সমর্থন প্রশ্নে সরকারের প্রচ- আপত্তি ছিল। সেই সময় বার্নিকাটকে পররাষ্ট্র দপ্তরে ডেকে মন্ত্রী-সচিব কথাও বলেন। সরকারের অনেকে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিন্তু তাতে বার্নিকাট কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেননি বরং এটাই ‘গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য’ বলে এটি এড়িয়ে যান।
তিনি মার্কিন সরকারের বার্তাগুলো পৌঁছিয়েছেন অত্যন্ত পেশাদারির সঙ্গে। এটাই তার সৌন্দর্য্য। লক্ষণীয় বিষয় ছিল জুলহাস মান্নান এবং তার বন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডে বার্নিকাটের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখেছে বাংলাদেশ। সেই সময়ে অর্ধশত মার্কিন কর্মকর্তা বিভিন্ন টিমে ঢাকা সফর করেছেন। কিন্তু খোদ তার ওপর হামলার পর তিনি পরিস্থিতি বা প্রতিক্রিয়া সামলেছেন নিঃশব্দে। ওই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে একটুও চিড় ধরতে দেননি। এটা বার্নিকাটের কারণেই সম্ভব হয়েছে- বলছিলেন ওই কর্মকর্তা। তার মতে, সেদিন তিনি বিতর্কে জড়ালে আজ হয়তো তার এমন উজ্জ্বল বিদায় হতো না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশের চরম সংকট রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের একনিষ্ঠ সমর্থন আদায়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা বন্ধু বার্নিকাটকে যথাযথভাবে বিদায় জানাতে চায় সেগুনবাগিচা। সেই প্রস্তুতিই নেয়া হচ্ছে।
সূত্র মতে, আজ দিনের শুরুতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ হবে তার। সেখান থেকে ফিরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপির সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করবেন তিনি। কাল প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেবেন। পরদিন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক তার সম্মানে একটি ভোজের আয়োজন করছেন। মূলত এটিই হবে তার বিদায়ী ভোজ। ২রা নভেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাকে বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানাবেন। অবশ্য মার্কিন দূতাবাস জানিয়েছেÑ আজ মধ্যাহ্নে রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেবেন। সূত্র বলছে, সেখানে তিনি তার ঢাকা মিশনের সফলতা ব্যর্থতার খতিয়ান দেবেন। উত্থাপিত সব প্রশ্নের জবাবও দেয়ার ইচ্ছা রয়েছে তার। অবশ্য সেদিন এক অনুষ্ঠানে বার্নিকাট তার ঢাকা মিশনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন।
সেখানে তিনি তার কর্মের মূল্যায়নের ভার বাংলাদেশের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। বলেন, এখানে আমি কী করেছি তা বাংলাদেশের মানুষই বলবে। বার্নিকাট বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা যা কিছু বলেছি, আর যা কিছু করেছি, তা ভেবে দেখতে আপনাদের আর আপনাদের পাঠক-দর্শককে আহ্বান জানাব। তারপর আপনারাই বিচার করুন। রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এবং আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে সরকারসহ সর্বমহলে আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা সংলাপকে উৎসাহ দিচ্ছে। এসব নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। সমালোচনা করেন মার্কিন দূত মার্শা বার্নিকাটের। এ নিয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় বার্নিকাট বলেন, দেখুন, আমরা যা কিছু করেছি, ব্যক্তিগতভাবে আমি যা কিছু করেছি, আপনাদের সহযোগী হিসেবেই আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছি। এ দেশের অংশীদার হয়ে ওঠার চেষ্টায় আমি অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। ‘কেন? কারণ একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ শুধু বাংলাদেশিদের নয়, বিশ্বকেও চমৎকার একটি স্থান হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। আমরা এবং অন্যান্য দূতাবাসগুলো এদেশে সার্বিক নীতির কথাই বলি; বাকস্বাধীনতা, সংসদ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ- এসব নিয়েই পরামর্শ দিই আমরা। রাষ্ট্রদূত বলেন, ঢাকায় গত সাড়ে তিন বছর কাজ করছি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য যোগাযোগ তথা অংশীদারিকে পোক্ত করাতেই ছিল আমার পূর্ণ মনোনিবেশ।
বার্নিকাটের কাজে স্টেট ডিপার্টমেন্টের স্বীকৃতি: মার্কিন কূটনীতিক হিসেবে বিভিন্ন দেশে কাজ করেছেন বার্নিকাট। এটাই তার শেষ কূটনৈতিক অ্যাসাইনমেন্ট। এখান থেকে তিনি অবসরে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার মনোনয়ন দিয়েছিলেন  প্রেসিডেন্ট ওবামা। আর সফলভাবে মিশন শেষ করতে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে। প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তন হলেও তার দায়িত্ব পালনে কোনো তারতম্য হয়নি। পেশাগত জীবনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বিভিন্ন পদে দায়িত্বপালনকারী বার্নিকাট বাংলাদেশে আসার আগে ২০১২ সাল থেকে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবসম্পদ বিভাগের ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট  সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর আগে ২০০৮  থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি সেনেগাল ও গিনি-বিসাউয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন। জ্যেষ্ঠ ওই কূটনীতিক তার কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। সর্বশেষ তার অর্জন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সর্বোচ্চ অ্যাওয়ার্ড বা সম্মান। ঢাকায় এটি গ্রহণ করেই বিদায় নিচ্ছেন বাংলাদেশের ওই উন্নয়ন বন্ধু।
বার্নিকাটের উত্তরসূরি মিলার আসছেন আগামী মাসে: ঢাকায় পরবর্তী মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কূটনীতিক আর্ল রবার্ট মিলারের নাম ঘোষণা হয়েছে কয়েক মাস আগে। এই ক’দিনে তার নিয়োগের প্রক্রিয়া তথা আইনসভার উচ্চকক্ষ সিনেটের অনুমোদনও সম্পন্ন হয়েছে। মিলার বতসোয়ানায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন শেষে আগামী ১৮ই নভেম্বর বাংলাদেশে আসছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন কর্পস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারী মিলার বতসোয়ানায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার আগে ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে কনসাল জেনারেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি মিশনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা এবং নয়া দিল্লি¬, বাগদাদ ও জাকার্তায় আঞ্চলিক নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। মিলার যুক্তরাষ্ট্রের  মেরিন সেনা হিসেবেও তিন বছর কর্মরত ছিলেন। ফরাসি, স্প্যানিশ ও ইন্দোনেশীয় ভাষায় দক্ষ আর্ল রবার্ট মিলার স্টেট ডিপার্টমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ফর হিরোইজমসহ সামরিক বাহিনীর একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.