একদিন না পড়িয়েও অধ্যাপক হওয়ার দৌড়ঝাঁপ: ১০৯১ জনের খসড়া তালিকা by নূর মোহাম্মদ

ড. মাহবুবা ইসলাম। বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের সহযোগী অধ্যাপক। মূল পদ সরকারি কলেজ হলেও মাউশির (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর) মনিটরিং-উইং-এ উপ-পরিচালক পদে বর্তমানে কর্মরত। উদ্ভিদবিদ্যার এই শিক্ষক চাকরি জীবনে এক বছরের কম সময় কলেজে থাকলেও ক্লাসে যাননি একদিনও। তবুও সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির তালিকায় (গ্রেডেশন লিস্ট) তার  নাম ২য় স্থানে রয়েছে। ১৪তম বিসিএস ব্যাচের এ শিক্ষক চাকরির শুরুর দিকে কিছু দিন একটি সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করলেও ১৯৯৮ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে বদলি হয়ে আসেন। এর মাঝখানে পিএইচডি ডিগ্রির ডেপুটেশন নেন। আর ২০০১ সালের পর মাউশির সহকারী পরিচালক পদ দিয়ে শুরু করে বর্তমানে উপ-পরিচালক। একই উইংয়ে ১৭ বছর চাকরি করে শিক্ষা প্রশাসনে রেকর্ড গড়েছেন তিনি।
একই অবস্থা মাউশির আরেক উপ-পরিচালক খুরশেদ আলমের। তিনিও চাকরি জীবনে কলেজে না পড়িয়ে ২০০৩ সাল থেকে শিক্ষা ভবনে আছেন। অর্থনীতির এ শিক্ষক অধ্যাপক পদে পদোন্নতি তালিকায় ২৫ নম্বরে আছেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব শাহেদুল খবির চৌধুরী। তিনি ২০০৯ সাল থেকে শিক্ষা বোর্ডের আগে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে ঘুরে ফিরে চাকরি করছেন। অর্থনীতির সহযোগী এই অধ্যাপক পদোন্নতির তালিকায় ৯ নম্বরে রয়েছেন। একই ভাবে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক বাংলার শিক্ষক মো. আবুল বাশার ১১ নম্বরে, দর্শনের শিক্ষক নায়েমের কাল চাঁদ শীল ১১ নম্বরে, অর্থনীতির শিক্ষক ইমরুল হাসান ৫ নম্বরে, ডিআইএ থেকে সম্প্রতি বদলি হওয়া ব্যবস্থাপনার শিক্ষক রাশেদুজ্জামান ১১ নম্বরে।
বাংলাদেশ সার্ভিস রুল (বিএসআর) ১৯৮১ এর ৫, ৬ ও ৭ বিধি অনুযায়ী, শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদোন্নতির জন্য পাঁচ বছর, সহযোগী অধ্যাপকের জন্য ৩ বছর এবং অধ্যাপক পদের জন্য ২ বছর অর্থাৎ ফিডার পদে ১০ বছর থাকতে হবে। ফিডার সার্ভিস বলতে শিক্ষা ক্যাডারের মূল পদ সরকারি কলেজে কর্মরত থাকতে হবে। এছাড়াও সব ক্যাডার পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের শুরুতে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস ও শিক্ষানবিশকাল শেষ করে চাকরি স্থায়ীকরণ বাধ্যতামূলক। পদোন্নতির জন্য পরীক্ষায় পাসও বাধ্যতামূলক। যারা এসব যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হবেন তাদের চাকরির মেয়াদ ১৫ বছর পূর্ণ হলে পরীক্ষা প্রমার্জন সাপেক্ষে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হবেন। কিন্তু আইন ভঙ্গ করে ২০০৬ সাল থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষা ক্যাডারে চরম অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। আদালতে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। তারপরও মাউশি আবারো বিধি লঙ্ঘন করে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির খসড়া তালিকা চূড়ান্ত করেছে।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে ‘বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি)’ সভা হয়েছে। তালিকা থেকে বিষয়ভিত্তিক ২০ শতাংশ সহযোগী অধ্যাপককে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত হয়েছে। তালিকায় পদার্থ বিদ্যার ৪৯ জন, পরিসংখ্যানের দুইজন, প্রাণিবিদ্যায় ৬৩ জন, বাংলায় ৮০ জন, ব্যবস্থাপনায় ৬৯ জন, ভূগোলে সাত জন, মৃত্তিকা বিজ্ঞানে তিনজন, মনোবিজ্ঞানে চার জন, রসায়নে ৪২ জন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ৭৮ জন, সমাজবিজ্ঞানে ১৩ জন, সমাজকল্যাণে ২৯ জন, সংস্কৃতে একজন, হিসাব বিজ্ঞানে ৬৩ জন, অর্থনীতিতে ৮১ জন, আরবিতে আট জন, ইসলামী শিক্ষায় ২৭ জন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতে ৭২ জন, ইংরেজিতে ৭৯ জন, ইতিহাসে ৭৯ জন, উদ্ভিদবিদ্যায় ৭৮ জন, গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে ছয় জন, গণিতে ৫৯ জন, দর্শনে ৮৫ জন। এছাড়া টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ইতিহাসে একজন, ভূগোলে একজন, বিজ্ঞানে একজন, শিক্ষায় নয় জন, গাইডেন্স অ্যান্ড কাউন্সেলিংয়ে একজন রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বর্তমানে তার নির্বাচনী এলাকায় রয়েছেন। তিনি ফিরলেই আবার ডিপিসির সভা করে পদোন্নতির তালিকা প্রকাশ করা হবে।
মাউশির দেয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অধ্যাপকদের অবসরে যাওয়ার হিসাব করে ১৯টি বিষয়ের অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য ১০৯১ জনের একটি খসড়া তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সারা দেশের সরকারি কলেজের বর্তমানে ৯৮টি অধ্যাপক পদ শূন্য রয়েছে। আর ডিসেম্বরে ৮০ জন অবসরে যাবেন। মাউশির হিসাব মতে ১৭৮টি পদে অধ্যাপকের পদোন্নতি যোগ্য। তবে গত বছরের ১০ই নভেম্বর ২৭৪ জনকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৫৮ জন গতকাল পর্যন্ত আগের পদে বহাল আছেন। 
বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষা ক্যাডারটি পার্শ্ব (লেটারাল এন্ট্রি) প্রবেশের। অর্থাৎ বিসিএস পরীক্ষায় পাস না করেও আত্তীকৃত শিক্ষক, পরিদর্শক থেকে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন ভাবে এ ক্যাডারে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। বিধি অনুযায়ী শিক্ষা ক্যাডারের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত পদে যোগদানের তারিখ থেকে। পদোন্নতির খসড়া তালিকা করার ক্ষেত্রে এ বিধানও মানা হয়নি। নিয়ম মেনে পদোন্নতি না দেয়ায় ৭ম থেকে ১৪তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। এবারের পদোন্নতির তালিকায় বিভাগীয় পরীক্ষায় পাসসহ নিয়মিত পদোন্নতিপ্রাপ্ত ও মেধাবীদের নাম রয়েছে অপেক্ষাকৃত নিচের দিকে। এতে করে তারা পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। মাউশির এক শ্রেণির কর্মকর্তা অর্থের বিনিময়ে অযোগ্যদের তালিকার শীর্ষে রাখার অভিযোগ করেছেন শিক্ষকরা।
এ ব্যাপারে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, এখনো কিছুই হয়নি। শুধু এসিআর (বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন) যাচাই বাছাই হয়েছে। কোনো চূড়ান্ত তালিকাও করা হয়নি। কিছু ব্যক্তি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। পদোন্নতির যোগ্যতায় কারো ঘাটতি থাকলে তাকে পদোন্নতি দেয়া হবে না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো রকম অনিয়ম হবে না।
চাকরি বিধি ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে গত সাত বছরে প্রায় এক হাজার বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় ফেল করেছেন। কারো আবার চাকরিই স্থায়ী হয়নি। তবুও অধ্যাপক হয়েছেন। এরমধ্যে আছেন অধ্যাপক ফারহানা হক। তিনি টানা ১৮ বছর শিক্ষা প্রশাসনে ছিলেন। গত বছর সর্বশেষ পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে ১০% কোটায় উপ-সচিব হয়েছেন। মাউশির মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যুলয়েশন উইং ২০০৮ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পরিচালক ছিলেন প্রফেসর দিদারুল আলম। তিনি ৩৩ বছর চাকরি জীবনের মাত্র ৬ মাস ক্লাসে পড়িয়েছেন। সেসিপের উপ-পরিচালক ড. শামসুন নাহার ২০০১ সাল থেকে টানা মাউশিতে বিভিন্ন পদে আছেন।
সেসিপের আরেক উপ-পরিচালক সাইফুদ্দিন চৌধুরী ১৯৯৮ সাল থেকে টানা মাউশিতে আছেন। মাউশির সাবেক উপ-পরিচালক মেজবাহ উদ্দিন সরকার মাউশিতে ছিলেন ১০ বছর আর প্রশিক্ষণ শাখার উপ-পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন টানা ১৩ বছর। সম্প্রতি তাদের অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর সাবেক এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ ১৯৯১-৯৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন শিক্ষা প্রশাসনে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ছিলেন তৎকালীন সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের পিএস। আর ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন এপিএস। ২০১৫ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপ-কলেজ পরিদর্শক হিসেবে ছিলেন। কিছুদিন আগে তাকে রাজশাহীতে বদলি করা হলেও বেশির ভাগ সময় পার করেন ঢাকায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাউশির একটি সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে কলকাঠি নেড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে অবৈধভাবে পদোন্নতি দিতে গিয়ে বলি দেয়া হয়েছে পদোন্নতি যোগ্য প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তাকে।
২০০৬ সাল থেকে ২০১৭ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জ্যেষ্ঠতা তালিকা, ফিট লিস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর ও ২৩শে অক্টোবর দুই দফায় ৫৮৭ জন পদোন্নতিপ্রাপ্ত অধ্যাপকের মধ্যে ১৫৪ জন বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় ফেল করা। ২০১৪ সালের ১৪ই অক্টোবর পদোন্নতিপ্রাপ্ত ৩৬৭ জন অধ্যাপকের মধ্যে দুই শতাধিক ফেল করা ও ১৪৮ জন পদোন্নতির অযোগ্য ছিলেন। শর্ত পূরণ না করায় তাদের চাকরিও স্থায়ী হয়নি। তবুও তারা অধ্যাপক হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.