টার্গেট যখন সাংবাদিক

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বর্বর হামলার শিকার হয়েছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। শনিবার শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ছবি তুলতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো শিক্ষার্থীদের  ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
এ হামলার ছবি তুলতে গিয়ে ছাত্রলীগের রোষানলে পড়েন সাংবাদিকরা। এমনকি ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে গিয়েও অনেকে হামলার শিকার হন। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি হামলাকারীদের টার্গেট ছিলেন গণমাধ্যমকর্মীরা। মাথায় হেলমেট ও মুখে কাপড় বেঁধে রামদা, রড, লাঠিসোঁটা নিয়ে সাংবাদিকদের আক্রমণ করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর সিটি কলেজের সামনে সাংবাদিকদের ওপর এ হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এতে বার্তাসংস্থা এপির ফটোসাংবাদিক এএম আহাদ, জুমা প্রেসের রিমন, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আহমেদ দীপ্ত, জনকণ্ঠের জাওয়াদ, বণিক বার্তার পলাশ, সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক রাহাত করিম ও এনামুল হাসানসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।
গুরুতর আহত আহাদ, আহমেদ দীপ্ত ও রাহাত করিমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর ২টার দিকে ফটোসাংবাদিকরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ছবি তুলছিল। এ সময় ছাত্রলীগের কর্মীরা রড, লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রায় ৩০ জন সাংবাদিকদের একটি গ্রুপকে ধাওয়া দেয়। ধাওয়ার মধ্যেই প্রায় ৭ জন ফটোসাংবাদিক ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন। এ হামলায় এপির ফটোসাংবাদিক এএম আহাদ গুরুতর আহত হন। তাকে উদ্ধার করতে ঘটনাস্থলে সহকর্মীরা গেলে হামলাকারীরা তাদের ওপরও ইটপাটকেল ছুড়ে।
এতে আরো কয়েকজন সাংবাদিক আহত হন। প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আহমেদ দীপ্ত জানান, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ছিলেন ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কে। সেখানে তিনিসহ কয়েকজন সংবাদকর্মী দাঁড়িয়েছিলেন। এ সময় ঢাকা কলেজের দিক থেকে লাঠিসোঁটা হাতে আসা ছাত্রলীগের একটি মিছিল শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে। ধাওয়ায় সেখানে কর্মরত সংবাদকর্মীরা দৌড় দিলে হামলাকারীদের একজন তার পায়ে রড দিয়ে আঘাত করলে তিনি পড়ে যান। এরপর ২০-২৫ জন মিলে লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে ব্যাপক মারধর করে তাকে। মারের কারণে দীপ্তর মাথার হেলমেট ভেঙে যায়। মাথা বাঁচাতে গিয়ে হাতে আঘাত পান দীপ্ত।
তার পুরো শরীর রক্তাক্ত। আহাদের ওপর হামলার সময়ের একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, আহাদকে বেধড়ক পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে একদল যুবক। যাদের দুজনের মাথায় হেলমেট পরা। আর একজনের মুখে গামছা বাঁধা। এ সময় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন অপর ফটোসাংবাদিক রাহাত। তিনি সায়েন্সল্যাবের মোড়ে অবস্থিত ফুটওভার ব্রিজ থেকে হামলার ছবি তুলছিলেন। ছাত্রলীগ কর্মীরা তাকে দেখতে পেয়ে নেমে আসতে বলে। নিচে নামার পর পরই তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়।
পরে রড ও লাঠিসোঁটা নিয়ে ওই ফটোসাংবাকিকে প্রহার করা হয়। আক্রান্ত সাংবাদিকরা অভিযোগ করেন, ছবি তুললেই মারধর করা হয়েছে, মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে এবং তা পুলিশের উপস্থিতিতেই। এমনকি ফোনে কথা বললেও লাঠি নিয়ে ছাত্রলীগকর্মীরা তেড়ে আসে। শুধু সাংবাদিক নয়, সাধারণ মানুষ ছবি তুললেও তাদের পেটানো হয়েছে। পুলিশের সামনে হামলার ঘটনা ঘটলেও পুলিশ তাদের বাধা দেয়নি বলে আক্রান্ত সাংবাদিকরা অভিযোগ করেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশের রমনা জোনের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার সাংবাদিকদের তোপের মুখে পড়েন। দেশীয় অস্ত্রে কারা হামলা করছে- জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমি কোনো অস্ত্র দেখিনি।
কোনো সাংবাদিক যদি আহত হয়ে থাকে, আমার কাছে কোনো সাংবাদিক অভিযোগ করেনি। কেউ অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার করতাম। পুলিশ সামনে থাকার পরেও অভিযোগ করতে হবে কেন?- এমন প্রশ্নে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কে ছাত্র, কে সাংবাদিক আমরা এটা বের করতে পারছি না। মাঝে মাঝে আমরা নিজেরাই বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, আমরা কোনো লাঠিচার্জ করিনি। শুধু কয়েকটি টিয়ারশেল মেরেছি।
যারা জিগাতলার দিকে আটকা পড়েছিল তাদের বের হয়ে আসার সুযোগ দিয়েছি। মারুফ হোসেন সরদার কথা বলার সময় ঠিক ২০০ গজ দূরেই সিটি কলেজের সামনে ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীরা অবস্থান করছিল। এই বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি কোনো জবাব দেননি। লাঠিসোঁটা নিয়ে যারা অবস্থান করছে তাদের কেন ছত্রভঙ্গ করা হলো না জানতে চাইলে পুলিশের উপ-কমিশনার বলেন, যারা আমাদের দিকে ঢিল ছুড়েছে আমরা তাদের ছত্রভঙ্গ করছি।
এর বাইরে আমরা কোনো অ্যাকশন নিচ্ছি না। হামলার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাংবাদিকরা। তারা প্রশ্ন রাখছেন, গণমাধ্যমকে কেন টার্গেট করা হচ্ছে? গেল দুই-তিনদিন ধরে গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। ভেঙে ফেলা হচ্ছে ক্যামেরা, গাড়ি। করা হচ্ছে মারধরও। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা শুরু হয় শুক্রবার থেকে। ওইদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে ধানমন্ডিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউল্যাবের মানববন্ধনে বাধা দেয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। এ সময় প্রিয় ডটকমের রিপোর্টার প্রদীপ দাস ঘটনার ছবি তুলতে গেলে ছাত্রলীগ তার ওপর হামলা করে।
ঘটনাটি দেখতে পেয়ে প্রিয় ডটকমের হেড অব নিউজ রফিকুল রঞ্জু প্রদীপকে উদ্ধার করতে যান। তখন দুর্বৃত্তরা তাকেও ধাওয়া দেন। রফিকুল রঞ্জু ও প্রদীপ দাস দৌড়ে অফিসে প্রবেশ করেন। তখন ছাত্রলীগ প্রিয় ডটকমের অফিসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। রঞ্জু অভিযোগ করেন, হামলার পর পর ধানমন্ডি থানায় ফোন করে জানালেও থানা থেকে ঘটনার ৪০ মিনিট পার হয়ে গেলেও কোনো পুলিশ আসেনি। শনিবার জিগাতলায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিকরা ছাত্রলীগ যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হন।
সংঘাতের ছবি তোলার সময় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য সংগঠনের নেতা কর্মীরা সাংবাদিকদের বাধা দেয়। যারা গোপনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ যুবলীগের হামলার ছবি ক্যামেরা বা মোবাইলের মাধ্যমে ধারণ করে ছাত্রলীগ ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের মোবাইল থেকে ছবি মুছে দেয়। কারও কারও ক্যামেরা ভেঙে ফেলে। অনেককে মারধর করে। কোনো কোনো সাংবাদিক ছাত্রলীগের হামলায় আহত হন। কেউ কেউ হাসপাতালেও চিকিৎসা নেয়।
জানা গেছে, ছাত্রলীগের হামলায় আহত হয় দৈনিক যুগান্তরের সাংবাদিক আরমান ভূঁইয়া, দৈনিক আমার সংবাদের সিনিয়র ফটো সাংবাদিক খোকন সিকদার, পরিবর্তন ডটকমের স্টাফ রিপোর্টার ফররুখ বাবু, মানবজমিনের ফটো সাংবাদিক শাহীন কাওসার, রিপোর্টার সুদীপ অধিকারী। রাজধানীর ধানমন্ডির রাইফেলস স্কয়ারের সামনে আক্রান্ত হন ডেইলি স্টারের শায়ের রিয়াজ, রাফি হোসেন, সুস্মিতা এস পৃথা, বিডিমর্নিং এর ফটোসাংবাদিক আবু সুফিয়ান জুয়েল, কালেরকণ্ঠের ফটোসাংবাদিক নিশক তারেক আজিজ, টাইমস বিডি জার্নালের ফটোসাংবাদিক অরণ্য জিয়া ও একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক।
আক্রান্তরা অভিযোগ করেন, সাংবাদিক পরিচয় দিলে তার ওপর আরো বেশি হামলা হয় এবং নানা ধরনের গালাগালি করা হয়। ছাত্রলীগ কর্মীরা মারধরের পর অনেকের ক্যামেরা ভাঙচুর করে। মোবাইলে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার ছবি ধারণ করলেও মোবাইল কেড়ে নিয়ে ছাত্রলীগ তা মুছে ফেলে। শনিবার বেলা সোয়া তিনটার দিকে সেখানে দায়িত্বপালনরত প্রথম আলোর প্রতিবেদকের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় হামলাকারী যুবকেরা। ফোন ফেরত চাইতে গেলে কয়েকজন যুবক প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বলেন, আওয়ামী লীগের স্থানীয় কার্যালয়ে গিয়ে তিনি নিয়ে আসতে পারেন। অবশ্য আধা ঘণ্টা পর তারা ফোনটি ফেরত দিয়ে দেয়। সাংবাদিকদের হেলমেট ও মোটরসাইকেলের চাবিও নিয়ে যায় তারা। আক্রান্ত এক সাংবাদিক অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাকে মিথ্যা লাইভ দিতে বাধ্য করে।

No comments

Powered by Blogger.