১২টায় ব্যালট শেষ, বুলবুলের অন্যরকম প্রতিবাদ by আসলাম-উদ-দৌলা ও প্রতীক ওমর

নগরীর ইসলামিয়া কলেজ কেন্দ্রে দুপুরেই শেষ হয়ে যায় মেয়র প্রার্থীর ব্যালট পেপার। পরে এ পদে ভোট দেয়ার জন্য ভোটাররা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু তারা আর মেয়র পদের ব্যালট পাননি। বেলা ১২টায় এই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় মেয়র পদে ভোট পড়েছে ৪৫ ভাগ এবং কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোট পড়েছে ১৮ ভাগ। খবর পেয়ে ওই কেন্দ্রে ছুটে যান বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। ঘটনার প্রতিবাদে তিনি ওই কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নেন। ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। এদিকে কেন্দ্র দখল ও জালভোট দেয়ার প্রতিবাদে বুলবুল নিজেও ভোটাধিকার প্রয়োগ করেননি। বিকালে তিনি সাংবাদিকদের জানান, মূল্যহীন হয়ে পড়ায় তিনি আর ভোট দেননি।
ইসলামি কলেজ কেন্দ্রে আসা ভোটার বাবুল জানান, তিনি দু’দফা ঘোরাঘুরি করে শুধু কাউন্সিলর পদে ভোট দিতে পেরেছেন। মেয়রের ব্যালট না থাকায় ওই পদে ভোটটি দিতে পারেননি। তিনি তার ভোটের অধিকার ফিরে পেতে চান।
অবশ্য ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল শাফি বলছেন ভিন্ন কথা। তার দাবি, এমন ভোটার আছেন যারা শুধু কাউন্সিলর পদে ভোট দিয়েছেন। এজন্য ভোটের শতাংশ কাউন্সিলর এবং মেয়র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন এসেছে। ব্যালট পেপার সংকট নেই। একজন মেয়র প্রার্থী কেন্দ্রে অবস্থান করায় ভোট গ্রহণে একটু বিঘ্ন ঘটেছে মাত্র।
এদিকে ভোর থেকেই নগরীজুড়ে গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছিল। কেন্দ্রগুলোর বাইরে ধানের শীষের কোনো নেতাকর্মীকে দেখা যায়নি। রাতে অনেক পোলিং এজেন্টের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেয়ার অভিযোগ ছিল। তালাইমারী বাদুরতলা এলাকার একটি ভোটকেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্টকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ৩ নম্বর ওয়ার্ডে মহিলা কমপ্লেক্স ভোটকেন্দ্রে এমন অভিযোগ পেয়ে গেলে সেখানে বিএনপির কোনো পোলিং এজেন্টকে পাওয়া যায়নি। সকাল সাড়ে ৮টার থেকে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের সাহেববাজার এলাকার মুন্নুজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিএন সরকারি গার্লস হাইস্কুল, শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ স্কুল ভোটকেন্দ্রে একজনও ধানের শীষের ব্যাজধারী ব্যক্তিকে দেখা যায়নি। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের সামনে যেতেই মহানগর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মামুন অর রশিদ মামুনকে আওয়ামী লীগসমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আব্দুল মোমিন সরকারের ব্যাচ গলায় পরে থাকতে দেখা যায়। ষষ্ঠীতলা এলাকা বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হলেও চিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। নাজমুল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে বিএনপির পোলিং এজেন্ট থাকলেও বাইরে থেকে বোঝা কঠিন ছিল নৌকা ব্যতীত অন্য কোনো প্রার্থী মেয়র ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন। ভোটের রব কাউন্সিলরকে ঘিরে।
সকাল ১০টা পর্যন্ত ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের অধিকাংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। তার প্রমাণ মেলে নৌকা প্রতীকের ভোটার সংবলিত স্লিপ নিয়ে কেন্দ্রে ঢুকতে দেখে। তেরখাদিয়া এলকায় দুপুর ১২টার দিকে বিভাগীয় স্টেডিয়াম ভোটকেন্দ্রের বাইরে তিনমাথার মোড়ে ভোটের আমেজ চোখে পড়ে। যার পুরোটাই ছিল কাউন্সিলর প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের অবস্থান, ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের নিয়ে আসার প্রচেষ্টা। 
প্রথমে বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত মতিহার থানার ২৮ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। বুধপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রধানফটক বন্ধ করে নৌকা মার্কায় সিল মারার খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হলে ঢাকা রেঞ্জের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসে মানবজমিনের দুই প্রতিবেদককে ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা প্রদান করেন। এ সময় কথা হয় প্রিজাইডিং অফিসার বদিউজ্জামানের সঙ্গে। সকাল ১১টায় ২৬৭০ ভোটের মধ্যে ভোট পড়ে ২০ শতাংশ, ভোট শেষে তা প্রায় ৭০ শতাংশে দাঁড়ায়। দীর্ঘ লাইন দেখতে পেলেও সে হারে ভোট গ্রহণ না করায় বাইরে দাঁড়ানোর প্রার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিশেষ করে ওই সেন্টারের মোহনপুর এলাকার বুথে চাপ কম থাকলেও বাইরে থেকে ভোটারদের বুথে নিতে অজানা কারণে বিলম্ব হচ্ছিল। বুধপাড়া এলাকার আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের ভোটার নম্বর সংবলিত স্লিপধারী আজিজ নামের একজন ভোটার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রায় আধাঘণ্টা ধরে ভোটকেন্দ্রের বাইরে থাকলেও তিনি গেটের ভেতরেই যেতে পারেননি। 
ইসলামিয়া কলেজ কেন্দ্রে ব্যালট পেপার বাইরে নিয়ে সিল মারার অভিযোগ নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর কর্মীদের বিরুদ্ধে। এই কেন্দ্রের বুথে সাংবাদিকদের ঢুকতে বাধা দেন ঢাকা রেঞ্চের এক পুলিশ কর্মকর্তা। প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুল্লাহ হিল শাফির সঙ্গে দেখা করলে তিনি বলেন, বুথের ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেয়া যাবে না। ওপর থেকে নিষেধ আছে। রিটার্নিং অফিসারের লিখিত অনুমতি লাগবে। পরে তিনি বুথ প্রদর্শনে নিয়ে যেতে রাজি হলেও ওই ঢাকা রেঞ্চ কর্মকর্তার তার সঙ্গে গোপনে কিছু বললে তিনি আর রাজি হননি। এরই মধ্যে নৌকা সমর্থকদের ১০-১৫ জনের একটি গ্রুপ পকেট ভর্তি করে ব্যালট পেপার নিয়ে ওপরে ওঠে। পরে ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের শাহারা খাতুন নিম্ন উচ্চ-মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভেতরেও সাংবাদিকদের ঢুকতে দেননি প্রিজাইডিং অফিসার রঞ্জিত কুমার শাহ। এ কর্মকর্তা বলেন, আপনাদেরকে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। এছাড়া বুথের ভেতরে যেতে পারবেন না। এ সময় ঢাকা রেঞ্চের এক কর্মকর্তা তার নামের ব্যাচ খুলে রেখে সেখানে অবস্থান নেন।
সকাল থেকে রাজশাহী সিটির ৩০নং ওয়ার্ডের বুধপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২নং ওয়ার্ডের গুড়িপাড়া, ৩নং ওয়ার্ডের মহিলা কমপ্লেক্স, তালাইমারী এলাকার বাদুড়তলা, বিনোদপুর এলকার ইসলামিয়া কলেজ, ১২নং ওয়ার্ডের পিএন গার্লস স্কুল, পিএসপি স্কুল, ১৩নং ওয়ার্ডের রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ, কাদিরগঞ্জ এলাকার শহীদ নাজমুল হক বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, দারুস সুন্নাহ্‌ দাখিল মাদরাসাকেন্দ্র ঘুরে ভোটের বিচিত্র দৃশ্য চোখে পড়ে। সকাল ৯টা পর্যন্ত কিছু কেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশে কোনো বাধা না থাকলেও পরে এই বাধা তীব্র হয়। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রে ঢুকতে পদে পদে বাধা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা রেঞ্জের কিছু পুলিশ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেননি।
ভোট দেননি বুলবুল:  নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল নিজেই ভোট দেননি। ভোট দেননি সদ্য বিদায়ী মেয়রের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট তোফাজ্জল হোসেন তপুও। সোমবার সকালে বরিশাল, সিলেটের পাশাপাশি রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেই বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শনে বের হন প্রার্থীরা। তবে এদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন বুলবুল। নিজে ভোট না নিয়ে কেন্দ্র পরিদর্শনে বের হন তিনি।
বেলা দুটার পর বুলবুল এ তথ্য নিশ্চিত করেন, তিনি ভোট দিচ্ছেন না। কারণ, জানতে চাইলে তিনি তার এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ এনে বলেন, ‘এই বিপন্ন গণতন্ত্রে আমার পোলিং এজেন্টরা ভোট দিতে পারেনি, সেখানে আমার ভোট দিয়ে লাভ কী?’ তিনি আরো বলেন, মেয়র পদের ভোট বেলা ১১টার মধ্যেই শেষ হয়েছে। এখন শুধু কাউন্সিলরদের ভোট হচ্ছে।
নির্বাচন প্রত্যাখ্যান পুনরায় তফসিল দাবি: রাজশাহী সিটি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে পুনরায় নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। তিনি গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় দলীয় কার্যালয়ে নির্বাচন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
এসময় তিনি আরো বলেন, অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশনের  মেয়র পদে অবৈধ, নিয়ম-বহির্ভূত ভোট ডাকাতি হয়েছে। এই ডাকাতির সঙ্গে নির্বাচন কমিশন প্রিজাইডিং অফিসার এবং আইশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা সরাসরি জড়িত ছিলেন। ঢাকা থেকে আসা একটি বিশেষ বাহিনী এই ডাকাতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। 
বুলবুল বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তর, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং পুলিশ বিভাগ নির্বাচনের তফসিল পর থেকে প্রকাশ্যে অনিয়ম, বে-আইনি কার্যকলাপ এবং পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছেন যেগুলো আমরা লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনকে বারবার জানানো হয়েছে এবং মৌখিকভাবে ও মিডিয়াতে জানানো হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টি অভিযোগ জানানো হয়েছে, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সমর্থন করেছেন নির্বাচন কমিশন অফিস। সরকারদলীয় প্রার্থীর পছন্দমতো বেছে বেছে কট্টর আওয়ামীপন্থী ‘প্রিজাইডিং অফিসার’, ‘সহকারী প্রিজাইডিং নিয়োগ দিয়েছেন এবং বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও (লিখিত) আমাদেরকে তার তালিকা দেয়া হয়নি।
সকাল ১০টা হতে দুপুর ১২টা পর্যন্ত প্রিজাইডিং অফিসার, পুলিশ কর্মকর্তারা এবং আওয়ামী লীগ যৌথভাবে মোট ৭৭টি কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বলপূর্বক বের করে দেয়। প্রিজাইডিং অফিসারগণ, এজেন্টদের ব্যালট বাক্স হিসাব, ব্যালট পেপারের হিসাব দেয়নি এবং তাদের কাছে রক্ষিত ফর্মে আমাদের এজেন্টদের স্বাক্ষর নেয়নি; যা নির্বাচনী বিধানের পরিপন্থি।
তিনি এই অবৈধ নির্বাচন বাতিল এবং পুনরায় আইনসঙ্গতভাবে নির্বাচন দেয়ার দাবি জানান।

No comments

Powered by Blogger.