যে কারণে শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতে মায়েদের অনীহা by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

দেশে শিশুদের মায়ের বুকের দুধ পান করানোর ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে। নানা কারণে এই অনীহা অনেক মায়ের ক্ষেত্রে কাজ করছে। এর মধ্যে সচেতনার অভাব, চাকরিজীবী মায়েদের কাজে ব্যস্ততা, কিছু অসৎ ব্যবসায়ীদের কারণে বাজারের কৌটার দুধে মায়েদের আসক্ত এবং কখনও কখনও কিছু মায়েদের সৌন্দর্যের বিষয়টিও পরিলক্ষিত হয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ফলে দেশে মাতৃদুগ্ধ পানের হার আশানুরূপ নয়। গত চার বছর ধরে এই হার একই অবস্থায় স্থির রয়েছে। ১৯৯৪ সালে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানোর হার ছিল ৪৬ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা বেড়ে উন্নীত হয় ৫৫ শতাংশে। এরপর চার বছর পেরিয়ে গেলেও এই হার বাড়েনি। তা ৫৫ শতাংশেই স্থির রয়েছে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, বিশ্বের সর্বত্র এ হার হওয়া উচিত ৯০ শতাংশ। আর তাই পুষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আগের থেকে কিছুটা উন্নতি করলেও এখনো অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে। এদিকে চলতি বছরের মে মাসে প্রকাশিত ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের শিশুরা মাতৃদুগ্ধ পানের সুযোগ কম পায়। এ খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন দেশে মাতৃদুগ্ধ পানের হার বাড়তে প্রয়োজন মায়েদের কাউন্সিলিং ও প্রশিক্ষণ। মায়েদের আরো সচেতন হলেই এই হার বেড়ে যাবে বলে তারা মন্তব্য করেন।
ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভুটান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় ৯৯ শতাংশ এবং আফগানিস্তানে ৯৮ শতাংশ শিশুকে শিশুকালে বুকের দুধ খাওয়ানো হয়। বাংলাদেশ ছাড়া এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশে এই হার ৯৪ থেকে ৯৭ শতাংশ। বাংলাদেশে নবজাতকদের মাত্র ৫১ শতাংশকে জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করা হয় এবং ছয় মাসের কম বয়সী ৫৫ শতাংশ শিশুকে কেবল বুকের দুধ খাওয়ানো হয়। তবে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, এ হার আরো বেশি হবে। সমপ্রতি এ সংক্রান্ত কোনো জরিপ না হওয়ায় এই হার এত কম।
ইউনিসেফের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের (বিবিএফএফ) চেয়ারপারসন ডা. এস কে রায় এই বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, দেশে নিরবচ্ছিন্ন মাতৃদুগ্ধ পানের হার যে ৫৫ শতাংশের কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে তা আরো বেশি। ওই প্রতিবেদনকে আমরা পান্থা দেই না। বিবিএফএফের ভাইস চেয়ারপারসন ও শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সুফিয়া খাতুন মানবজমিনকে বলেন, শিশুকে মাতৃদুগ্ধ পানের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে সচেতনতা আছে। তবে একজন মা সমস্যায় পড়লে কোথায় যাবেন- সেই জায়গা খুব কম। বিবিএফএফের মাধ্যমে ‘মাদার সাপোর্ট গ্রুপ’ কাজ করছে। এর সুফল পাওয়ার আশা করছেন এই বিশেষজ্ঞ। এই বিষয়ে হাসপাতালে নার্স, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ইউনিসেফের প্রতিবেদনটা ঠিক না। এ বিষয়ে নতুন কোনো গবেষণা না থাকায় পুরনো তথ্যই আমাদের উপস্থাপন করতে হচ্ছে। তাই এ সংখ্যা একই জায়গায় রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। কোনো সমস্যা হলে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে সমস্যা দূর করতে হবে এবং প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তিনি বলেন, বাচ্চা প্রসবের পর মায়েরা বাড়ি যাওয়ার পর আর হাসপাতাল আসতে চান না। তিনি বলেন, কোম্পানির লোকরা কৌটার দুধ খাওয়ানোর জন্য উদ্ধুদ্ধ করেন। এটা ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ। তারা চিকিৎসকদের মটিভেটেড (প্ররোচনা) করে থাকেন। যা তাদের অসৎ উদ্দেশ্য বলে এই চিকিৎসক মনে করেন।
ইউনিসেফের ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বুকের দুধ খাওয়ানোর অভ্যাস যাতে কমে না যায় তার জন্য সংস্থাটি বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে অনেক সহায়ক উদ্যোগ নিয়েছে। সংস্থাটি মনে করে, শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেড়ে ওঠা এবং মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার জন্য জন্মের পর থেকে প্রতিটি শিশুকে দুই বছর এবং সম্ভব হলে আরো বেশি সময় বুকের দুধ খাওয়ানো প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ সময় ধরে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো মায়ের স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। একজন মা যদি এক বছর তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান তাহলে তার স্তন ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি ৬ শতাংশ কমে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের বুকের শাল দুধ পান করালে শতকরা ৩১ ভাগ নবজাতকের মৃত্যুরোধ হতে পারে। পূর্ণ ৬ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করালে ১৩ শতাংশ শিশুমৃত্যু এবং ৬ মাস বয়সের পর মায়ের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি বাড়তি খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করলে শতকরা ৬ ভাগ শিশুমৃত্যু হার কমানো সম্ভব। এ পরিস্থিতে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে আগামী ১লা আগস্ট থেকে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ-২০১৮ পালন করা হবে দেশে। শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর উৎসাহ দিতে এবং শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাতে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন করা হয়। এবার প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘মায়ের দুধ পান, সুস্থ জীবনের বুনিয়াদ।’

No comments

Powered by Blogger.