ট্রেনে কাটা পড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ২ জনের বেশি by শুভ্র দেব

ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হচ্ছে। রেলওয়ে পুলিশ সূত্র বলছে, দিনে গড়ে দুজনের বেশি লোক ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাচ্ছে। বেশির ভাগ ঘটনাই অসচেতনতা, রেললাইনের পাশে অবৈধ স্থাপনা, অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ের জন্য হচ্ছে। নানা উদ্যোগ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে সুফল  আসছে না। পরিসংখ্যান বলছে বছরের পর বছর ধরে সমানতালেই ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রেনে ভ্রমণ করা যতটা নিরাপদ তার চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকি রেললাইন দিয়ে চলাচল। বিষয়টি নিয়ে রেল সংশ্লিষ্টদের আরো তৎপর হওয়া দরকার।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী ট্রেনে কাটা পড়ে দেশে গত সাড়ে ৫ বছরে ৪ হাজার ৮২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটা ঘটনায় রেলওয়ে থানায় অপমৃত্যু মামলা করা হয়েছে। এর বাইরে কিছু হত্যা মামলাও রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ সালে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে ৯০২ জনের। ২০১৪ সালে ৮৯৮ জন। ২০১৫ সালে ৮২১ জন। ২০১৬ সালে ৯৭১ জন। ২০১৭ সালে ১ হাজার ২২ জন এবং ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ৭৪ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৪ জন, মার্চ মাসে ৮৫ জন, এপ্রিল মাসে ৬৬ জন, মে মাসে ৯০ জন ও জুন মাসে ৮৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে শুধু ঢাকা অঞ্চলে মৃত্যু বরণ করেছেন ১ হাজার ৭৩৪ জন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৩১৮, ২০১৪ সালে ৩০৫, ২০১৫ সালে ২৮৫, ২০১৬ সালে ৩০৫, ২০১৭ সালে ৩৪৬ ও ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত ১৭৫ জন। যারা মারা গিয়েছেন তাদের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটার কারণে ৩৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। রেললাইনের ওপর বসা বা চলাচলের জন্য ৪৩৮ জন, রেলওয়ে ক্রসিং ও পারাপারের চেষ্টায় ৮৮৬ জন, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ৯৬ জন ও অন্যান্যভাবে ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
রাজধানীর চকবাজারের হুসেনি দালান এলাকার বাসিন্দা ফরিদ মিয়া (৬০)। পরিবারপরিজন নিয়ে তিনি সেখানেই থাকতেন। ভাঙাড়ির এই ব্যবসায়ী গত ২৮শে জুন মালামাল কিনতে এসেছিলেন মালিবাগ এলাকায়। রেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় কমলাপুরগামী একটি ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। গত ১০ই জুন জারিয়া-ময়মনসিংহ রেলপথের ১৮ নম্বর সেতুর পাশে বালুঘাটা এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান আব্দুর রহিম (৫৫)। তার বাড়ি বালুঘাটা এলাকায়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আব্দুর রহিম রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন। এসময় ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা ২৭২ নম্বর ডাউন ট্রেনটি তাকে কেটে চলে গেলে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। চলতি মাসের ২ তারিখে গাইবান্ধায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন এক স্কুল শিক্ষার্থী। তার নাম মনিরা আক্তার। ওই দিন সদর উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নের হাজী গেট সংলগ্ন রেললাইনে এই ঘটনা ঘটে। মনিরা একই ইউনিয়নের উজির গ্রামের মোফাজ্জর মিয়ার মেয়ে। শুধু তাই নয় ১৩ই মে গাইবান্ধায় ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাত আরো এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, ওইদিন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলায় ঘটনাটি ঘটে। সান্তাহার থেকে দিনাজপুরগামী দোলনচাপা এক্সপ্রেস ট্রেনটি মহিমাগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে বোনারপাড়া যাওয়ার পর দেওয়ানতলা ব্রিজ এলাকায় ওই যুবকে ট্রেনটি কেটে চলে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে।
রেলওয়ে পুলিশ ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছে। তার মধ্যে কানে ইয়ার ফোন দিয়ে রেললাইনে চলা, রেল লাইনের ওপর বসা বা হাঁটা-চলা করা, রেলওয়ে ক্রসিং ও পারাপারের চেষ্টা, ট্রেনের ছাদে উঠে ভ্রমণ ছাড়াও আরো কিছু কারণ। আর যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রী, কর্মজীবী, চাকরজীবী, ছোটখাটো ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য পেশার মানুষ রয়েছেন। তবে রেলওয়ে ক্রসিং পারাপারের চেষ্টা ও রেললাইনের ওপর বসা বা চলাচলরত অবস্থায় বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া রেললাইনে কাটা মৃত্যুতে পুরুষের সংখ্যা বেশি। এর বাইরে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে রেললাইনে ফেলে রাখার কিছু ঘটনা ও রেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে কিছু যানবাহনের সংঘর্ষে আরো কিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াসিন ফারুক মানবজমিনকে বলেন, আমাদের অন্যান্য কাজের মতো ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু রোধ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। রেললাইনের আশপাশের এলাকায় মাইকিং, রেল বস্তি ও রেললাইন দিয়ে চলাচলরত মানুষকে নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করি। লিফলেট বিতরণ, পোস্টারিং করা হয় নিয়মিত। তিনি বলেন, এত কিছুর পরও মানুষকে সচেতন করা যাচ্ছে না। অনেকেই শখ করে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করে। আবার কানে হেডফোন দিয়ে গানশুনে কথা বলে রেললাইন ধরে হাটে। এসব কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই আমাদের সচেতনতার সৃষ্টির পাশাপাশি রেললাইনে চলাচলকারীদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে। না হলে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু বন্ধ করা যাবে না। ইয়াসিন ফারুক বলেন, ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পরিবার থেকে অনেক সময় হত্যার অভিযোগ করেন। এসব বিষয় আমরা খতিয়ে দেখি। ফরেনসিক রিপোর্ট দেখে যদি হত্যার আলামত পাওয়া যায় তবে এক্ষেত্রে আমরা হত্যার তদন্ত করে থাকি।
রেললাইনে ট্রেনে কাটা পড়েই মৃত্যু হচ্ছে হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে দুর্বৃত্তরা মানুষ হত্যা করেও অপরাধ ঢাকতে রেললাইনে মরদেহ ফেলে রেখে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা। ১৪ই জুন রাজধানীর খিলগাঁও বাগিচা মসজিদ সংলগ্ন রেললাইন থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভিনের ছেলে সুমন জাহিদের মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা রেলওয়ে পুলিশ। বাসা থেকে ডেকে নেয়ার দুই ঘণ্টার মাথায় তার মরদেহ রেললাইনের পাশে পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে ট্রেনে কাটা পড়েই তার মৃত্যু হয়েছে। তবে পরিবারের অভিযোগ তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে রেললাইনে ফেলে রেখে গেছে। পরে ট্রেন এসে কেটে চলে গেছে। কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন সুমন জাহিদ। এরপর থেকে অজ্ঞাতনামা লোকেরা তাকে নানাভাবে হুমকি দামকি দিয়ে আসছিল বলে অভিযোগও করেন তার পরিবার। গত বছরের ২৯শে নভেম্বর কোটচাঁদপুরে রেললাইনের ওপর থেকে শফিউদ্দিন শফি (২৮) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে জিআরপি পুলিশ। উদ্ধার করা লাশের দুই পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং দেহের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন রয়েছে। তিনি উপজেলা শহরের গাবতলাপাড়ার মৃত মনিরুদ্দিনের ছেলে। নিখোঁজ থাকার পর তার মরদেহ রেললাইনে পাওয়া যায়। পুলিশের ধারণা, হত্যার পর লাশটি পরিকল্পিতভাবে রেললাইনের ওপর ফেলে রাখা হয়েছিল।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, শখের বশে, সিট সংকট অথবা প্রচণ্ড গরমে বাতাসের জন্য অনেকেই ট্রেনের ছাদে উঠেন। এর বাইরে অপকর্ম করতে অনেকেই ছাদে উঠে। বিশেষ করে মাদকসেবীরা নির্বিঘ্নে সেখানে বসে মাদক সেবন করে। ছিনতাইকারীরা ছিনতাই করে। আবার পূর্বশত্রুতার জের ধরে অনেকেই ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছে। আবার অন্যত্র হত্যা করে ট্রেনের ওপর থেকে ফেলে দেয়া। অপরাধ ঢাকতে এমন পথ অবলম্বন করে অপরাধীরা। কারণ ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যুতে সাধারণত আসামিকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগে অনেক সময় থানায় মামলা হয়। তবে মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি থাকে না।
দিন পার হলে ঘটনাটিকে শুধুই অসাবধানতা বশত মৃত্যু হিসাবে ধরে নেয়া হয়। সূত্র বলছে, এসব অভিযোগে প্রত্যক্ষদর্শী বা সাক্ষী খোঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। চলতি বছরের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয় নরসিংদির ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থী সাকিব খান। সে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। পরে ওই দিনই রেলওয়ে পুলিশ ঢাকার বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কর্ণফুলী এক্সপ্রেসের ছাদ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে। সাকিব নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামের হোমিও চিকিৎসক মো শরফুউদ্দিনের ছেলে। মা পারুল বেগম ফুলবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। সাকিবের বাবার অভিযোগ ছিল, স্থানীয় এক ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে তার ছেলেকে খুন করা হয়েছে। ফেসবুকে নরসিংদীর স্থানীয় এমপির ছবির নিচে খারাপ কমেন্টস করার জেরে তাকে হত্যা করা হয়েছে। 
বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. শামসুউদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, অসচেতনতার জন্যই রেললাইনে ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এ নিয়ে রেলওয়ে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। জনসচেতনতার জন্য লিফলেট, মাইকিং, পোস্টারিং, সভা করা হয়। আর হত্যার অভিযোগ এলে তদন্তও রেলওয়ে পুলিশ করে।

No comments

Powered by Blogger.