ঘাতক পিন্টুর কথিত ‘বড় ভাই’ ও পরকীয়া প্রেমিকা গ্রেপ্তার

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর চন্দ্র ঘোষ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর যেসব তথ্য বেরিয়ে আসছে অনেকটা ‘কেঁচো-খুঁড়তে অজগর’ বেরিয়ে আসার মতো। প্রবীর ঘোষ হচ্ছে পিন্টু দেবনাথের শেষ শিকার। এরআগে স্বপন দাস নামে তাদের আরেক বন্ধু গুম হয়। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে স্বপন দাস গুমের পেছনে পিন্টু দেবনাথের হাত রয়েছে। তার বিরুদ্ধে নতুন করে স্বপন অপহরণের মামলা হয়েছে। অথচ প্রবীর ঘোষের মতো স্বপন দাসও ঘাতক পিন্টুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল।
এদিকে  প্রবীর হত্যাকাণ্ডের সেই তৃতীয় পক্ষ ও ঘাতক পিন্টুর শেল্টারদাতা কথিত ‘বড় ভাই’ মৃত মহসিন মোল্লার পুত্র মামুন মোল্লা (৫০) এবং পিন্টুর পরকীয়া প্রেমিকা রত্না চক্রবর্তীকে ৩ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ডিবি। গতকাল বিকালে নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে শুনানি শেষে তাদের তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরআগে রোববার গভীর রাতে শহরের আমলাপাড়ার মোল্লা বাড়ি থেকে মামুন মোল্লা ও গতকাল সকালে রত্না চক্রবর্তীকে আটক করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় দুটি মোবাইল ফোন।
প্রবীর হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মফিজুল ইসলাম পিপিএম জানান, পিন্টু দেবনাথ আদালতে স্বীকারোক্তিতে ‘বড় ভাই’ মানে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে মামুন মোল্লার নাম বলেছে। তার তথ্যের ভিত্তিতেই রোববার রাত ২টায় মামুন মোল্লাকে আটক করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অপহৃত স্বপন দাসের বাড়ি শহরের নিতাইগঞ্জ এলাকায়। সেও শহরের কালীরবাজারে ব্যবসা করতো। স্বপন দাস ছিল প্রবীর ও পিন্টুর ঘনিষ্ঠজনদের একজন। গত প্রায় এক বছর ধরে সে নিখোঁজ রয়েছে। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে পিন্টু জানিয়েছে স্বপন ভারতে চলে গেছে। কিন্তু ডিবির ধারণা, এক বছর ধরে নিখোঁজ স্বপনের ভাগ্যেও হয়তো নির্মম কোনো পরিণতি ঘটে থাকতে পারে।
নিখোঁজ স্বপন দাস পাসপোর্টের ব্রোকারি করতেন। ধর্মে হিন্দু হলেও তিনি ফতুল্লার কাশীপুর এলাকার একটি মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। স্বপনের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল।
১৪ই জুলাই বিকালে নারায়ণগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসানের আদালতে পিন্টুর ১৬৪ ধারায় দীর্ঘ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। এরআগে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদেও বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য।
পিন্টু জানায়, প্রায় দেড় বছর আগে তার এক বড় ভাই মামুন মোল্লা তাকে ডেকে নিয়ে প্রবীরের ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিল, প্রবীর তোর বন্ধু না শত্রু? পিন্টু নির্দ্বিধায় প্রবীরকে বন্ধু বলে স্বীকার করলে মামুন মোল্লা পিন্টুকে চড় মারে ও গালি দিয়ে বলে প্রবীর তোর বন্ধু না। এরপর মামুন মোল্লা প্রবীরকে ফোন করে মোবাইলে লাউড স্পিকারে পিন্টুর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতেই প্রবীর বলেছিল, ‘ওরে মাইরালান লোক দিয়া... কইরা র‌্যাব দিয়া ধরাইয়া দেন দাদা। ওর টাকা পয়সা বাইরা গেছে, অর্ডারও বাইরা গেছে। ওর দোকানডা আমার লাগব।’
প্রিয় বন্ধুর মুখে এমন কথা শোনার পরই ক্ষোভ জন্মে পিন্টুর মধ্যে। শুধু প্রবীরই নয়, তাদের বন্ধু স্বপন, উত্তমসহ কয়েকজনের সঙ্গে মামুন মোল্লা কথা বললে তারাও পিন্টু সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলে।
মামুন মোল্লা প্রবীরের হাত থেকে তার ব্যবসা বাঁচিয়ে দেবে বলে পিন্টুর কাছ থেকে কয়েক দফায় ৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। আবারো টাকা চাওয়ার কারণে পিন্টু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় প্রবীরকে হত্যার।
যদিও অর্থ, বন্ধকী স্বর্ণালংকার ও দোকান আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই নারায়ণগঞ্জের স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষকে হত্যা করেছেন বলে জানিয়েছেন পিন্টু দেবনাথ। ১৪ই জুলাই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বর্ণনা করেন প্রবীরের ওপর পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকেই পরিকল্পনা করে তার ফ্ল্যাট বাসায় প্রবীরকে ডেকে নিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে লাশ ৭ টুকরো করেছে। চেষ্টা করেছিল লাশ গুম করতে ও পুরো বিষয়টি ভিন্ন দিকে ধাবিত করতে।
উল্লেখ্য, ১৮ই জুলাই রাতে কালিরবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষকে মোবাইল ফোনে নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে খুন করে পিন্টু দেবনাথ। এরপর লাশ ৭ টুকরো করে সেপটিক ট্যাংকি ও ড্রেনে ফেলে দেয়। ঘটনার ২১ দিন পর ৯ই জুলাই রাতে ও ১০ জুলাই রাতে পিন্টুর দেয়া তথ্য মতে, শহরের আমলাপাড়া কেসিনাগ রোডের রাসেদুল ইসলাম ঠান্ডু মিয়ার বাড়ির নিচতলার সেপটিক ট্যাংকি থেকে প্রবীরের ৫ টুকরো লাশ এবং বাড়ির অদূরে একটি ড্রেন থেকে দুই পা উদ্ধার করে ডিবি। ঠান্ডু মিয়ার বাড়িতে ২২ বছর ধরে ভাড়া থাকে পিন্টু দেবনাথ।

No comments

Powered by Blogger.