ব্যাংকিং খাতের পরিস্থিতি তুলে ধরবে বিএনপি by কাফি কামাল

অনিয়ম ও বিপর্যয়ের চিত্রসহ দেশবাসীর সামনে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরবে বিএনপি। আসন্ন ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বাজেট ও আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি সপ্তাহেই রাজধানীর কোনো হোটেল বা বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকিং খাতের এ চিত্র তুলে ধরা হবে। বিএনপির নীতি নির্ধারক ফোরামের এক সদস্য বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিকসহ প্রতিটি খাতের অভ্যন্তরীণ চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে চায় বিএনপি। সম্প্রতি দলের নীতি নির্ধারক ফোরাম ও সিনিয়র নেতাদের কয়েকটি বৈঠকে আলোচনা-পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। এরপর বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নেতৃত্বে ও সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে দলের সংশ্লিষ্ট সম্পাদকরা খাতওয়ারি নানা তথ্য-উপাত্ত ও ডকুমেন্ট সংগ্রহ করেন। সংশ্লিষ্ট খাতের নিরপেক্ষ ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সেসব তথ্য-উপাত্ত ও ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করছেন বিএনপি নেতারা। এ কাজে বিএনপিকে সহায়তা করছেন প্রতিটি খাতের সংশ্লিষ্টরা। সিপিডি, টিআইবি, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ), চেম্বারসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত এবং পরামর্শ-প্রস্তাবনাগুলোও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
আসন্ন জাতীয় বাজেটকে সামনে রেখে তাই প্রথমেই তুলে ধরা হচ্ছে ব্যাংকিং খাতের চিত্র। অন্যান্য খাতের অভ্যন্তরীণ চিত্র প্রকাশের প্রস্তুতিও চলছে সমানে। সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি কল্যাণকামী, দূরদর্শী ও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য কিন্তু বাস্তবসম্মত ইশতেহার তৈরি করবে বিএনপি। প্রতিটি খাতের অভ্যন্তরীণ চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ-প্রস্তাবনাও দেবে বিএনপি। অনিয়ম ও বিপর্যয় সম্পর্কে উত্থাপিত চিত্রের ব্যাপারে দেশবাসীর প্রতিক্রিয়া ও বিএনপির পরামর্শ-প্রস্তাবনার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই ইশতেহারে সংশ্লিষ্ট খাতের অংশ চূড়ান্ত হবে। সূত্র জানায়, পুরো প্রস্তুতি চলছে অত্যন্ত গোপনে এবং কৌশলে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ-অভিজ্ঞ ছাড়া দলের অনেক সিনিয়র নেতাকেও এ ব্যাপারে অবহিত করা হচ্ছে না। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব চায় না কোনোভাবেই এ ব্যাপারে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিবন্ধকতা তৈরি হোক। বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র জানায়, ব্যাংকিং খাতের অভ্যন্তরীণ সার্বিক চিত্র উত্থাপন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য ব্যাংকিং খাতের নিরপেক্ষ ও শুভাকাঙ্ক্ষী বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে লুটপাট, দুর্নীতি, ব্যাংকিং খাত পরিচালনায় পরিবারতন্ত্র কায়েম, আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য, গুণগত প্রবৃদ্ধি না হাওয়া ও বাজেট কাঠামো দুর্বলতা, কর্মসংস্থান ও বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা, সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংস্কারে উদ্যমের অভাব, সমন্বয়হীনতা, ব্যাংকের কুঋণ ও সঞ্চিতির ঘাটতি, ঋণ দেয়ার ক্ষমতা হ্রাস, অপরিশোধিত ঋণ বৃদ্ধি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দুর্বলতার মতো বিষয়গুলো তথ্য-উপাত্তসহ সবিস্তারে তুলে ধরা হবে। অর্থনৈতিক খাত নিয়ে কাজ করেন বিএনপির এমন এক নেতা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ তদারকির অভাবে ব্যাংকিং খাত নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। এতদিন সরকারি ব্যাংকের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ থাকলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকে। ব্যাংকিং খাতে এখন আতঙ্ক। ব্যাংকে নগদ টাকার সংকটের কারণে আমানত তুলে নেয়ার ঘটনা বাড়ছে। আতঙ্কের কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ব্যাংকাররা। আর এতে বিনিয়োগকারীরা হয়ে পড়েছেন বিভ্রান্ত। তিনি বলেন, ব্যক্তি খাতের ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনা ঘটলেও এমন অনিয়মের কোনো প্রতিষেধক ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার উল্টো ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে সেখানে পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছে। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে ব্যাংকিং খাত চরমভাবে বিপর্যয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আরেক নেতা জানান, বেসরকারি খাতের ফারমার্স ব্যাংকে রাখা টাকা ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। জলবায়ু তহবিল ৫০৮ কোটি টাকা ফেরত না পাওয়ার কথা আলোচনা হয়েছে খোদ জাতীয় সংসদে।
আস্থা সংকটের কারণে রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া নতুন কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরাপদ বোধ করছে না সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। পুরোনো বেসরকারি ব্যাংক থেকেও কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এতে তারল্য সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো। ব্যাংকিং খাতে ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক প্রভাব ও যোগসাজশের মাধ্যমে লাগামহীন জালিয়াতি, দুর্নীতি ও ঋণ খেলাপির দৌরাত্ম্য, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের অকার্যকর পদক্ষেপ ও দৃশ্যমান অসহায়ত্বের প্রভাব পড়েছে পুরো অর্থনীতিতে। আগে যে আতঙ্ক শেয়ারবাজারে ছিল, এখন সেটা চলে এসেছে ব্যাংকে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপের দিকে গেছে যে, কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রকাশ্যে অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। খোদ ব্যাংকাররাই অভিযোগ করেছেন, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে খেলাপি ঋণ অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়েছে। বেসরকারি ৪৮টি ব্যাংকের মধ্যে ১৩টির আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। সার্বিকভাবে ২০১৭ সালকে ব্যাংকিং খাতের কেলেঙ্কারির বছর হিসেবে আখ্যায়িত করেছে সকল মহল।

No comments

Powered by Blogger.