বইমেলা ও বোধের জাগরণ by বিনয় দত্ত

ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। এ মাসজুড়ে চলে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। সারা বছর এ মেলার জন্য বইপিপাসুরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। এ মেলা থেকে লেখক, প্রকাশক ও পাঠকরা সারা বছর বেঁচে থাকার সঞ্জীবনী শক্তি সঞ্চয় করেন, যে শক্তি সবাইকে চালিত করে।
এ একটি মাসের প্রায় প্রতিটি দিনেই ঢাকাসহ দেশের সব জেলাশহরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকলেও সবার দৃষ্টি এবং অংশগ্রহণ থাকে অমর একুশে গ্রন্থমেলার দিকে। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তধারার প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহার কল্যাণে ছোট পরিসরে এ মেলা শুরু হলেও এখন তার বিস্তৃতি বিশাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউসের সামনে বটতলায় এক টুকরো কাপড় বিছিয়ে মাত্র ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলা শুরু করেছিলেন। মূলত তিনিই এই মহান উদ্যোগের পথিকৃৎ। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি একাই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা চালিয়ে যান। তিনি তার দূরদৃষ্টি দিয়ে মেলার বিশালতার কথা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই একাই এ মহান উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন এবং হাল ছেড়ে দেননি। পরে ১৯৭৬ সালে তাকে দেখে অন্য প্রকাশকরাও অনুপ্রাণিত হয়ে এগিয়ে আসেন বইমেলায়। এরপরের ঘটনা সবারই জানা। বইমেলার পরিধি অনেক ছোট ছিল, এখন তা বিশাল আকার ধারণ করেছে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও যুক্ত হয়েছে। শুরুর দিকে এ মেলার ব্যাপ্তি ছিল ১৪ দিন। পরে ২১ দিন করলেও এখন মেলা চলে গোটা মাসজুড়ে। এত বড় পরিসরে মেলার আয়োজন দেখে বোঝা যায় আমরা কতটা অগ্রসর হয়েছি।
২. বইমেলার বিশাল পরিসরজুড়ে এখন ভিন্নরকম আয়োজনের ছড়াছড়ি। ছোট-বড় সব প্রকাশনার শৈল্পিক সাজসজ্জার আয়োজন, গণমাধ্যমগুলোর নিজেদের সম্প্রচারের জন্য আলাদা স্টল, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা স্টল, লিটল ম্যাগের আলাদা পরিসর, সাংস্কৃতিক ও নাটকের প্রকাশনার আলাদা স্টল, লেখকদের জন্য আলাদা কর্নার, শিশুদের জন্য আলাদা কর্নার, শিশু-কিশোররা যেন আলাদাভাবে তাদের প্রয়োজনীয় বই নিতে পারে তার জন্য আলাদা সময়সীমা, বিভিন্ন জায়গায় বসার জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা প্রাঙ্গণের মধ্যে পথনাটকের আয়োজন, শারীরিক বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা, মোড়ক উন্মোচনের জন্য আলাদা মঞ্চ, গণমাধ্যমকর্মীদের কাজ করার জন্য আলাদা সুযোগ-সুবিধা, খাবার বা পানীয়ের জন্য আলাদা আয়োজন, মলমূত্রের জন্য আলাদা ব্যবস্থা, গোটা পরিসর সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসা, নিরাপত্তাকর্মীদের কড়া নজরদারিসহ ব্যাপক পরিসরে এখন অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়। এ মহান উদ্যোগের পথিকৃৎ চিত্তরঞ্জন সাহা এখন এ আয়োজন দেখলে একদিকে যেমন আনন্দিত হতেন, অপরদিকে দুঃখও পেতেন, কারণ এ মেলা থেকে বের হওয়ার পথে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আজাদ এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়কে আততায়ীর ভয়ানক আঘাতের শিকার হয়েছিলেন। সেই আঘাত হুমায়ুন আজাদকে স্বল্প আয়ু দিলেও অভিজিৎ রায়ের আয়ু সঙ্গে সঙ্গেই কেড়ে নেয়। মননশীল ও সৃজনশীল জাতি গঠনের, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বোধের জায়গাটা গভীর করার জন্য, সর্বোপরি এ নবীন প্রজন্মকে আলোর পথ দেখানোর আশায় এ অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। এ আয়োজনের বড় উদ্দেশ্য ছিল আমাদের দেশের লেখক, শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, গবেষকরা যেন নিজেদের মেধা, মনন ও চিন্তাভাবনা পাঠকদের জানাতে পারেন, সবার মাঝে বিস্তার ঘটাতে পারেন তাদের সুন্দর বোধ। মূলত পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের একচেটিয়া আধিপত্য ঠেকাতে চিত্তরঞ্জন সাহা আমাদের দেশের লেখকদের লেখা প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে এ অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু করেছিলেন। তখন আমাদের দেশে প্রথিতযশা অনেক লেখকই ছিলেন যাদের লেখা অনেক মূল্যবান, কিন্তু তখন পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই আমাদের দেশে সহজেই চলে আসত এবং বিক্রি হতো। মুক্তধারার প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা ভাবলেন এভাবে চলতে থাকলে আমাদের দেশের কোনো লেখক নিজেদের আলাদা স্বাক্ষর রাখতে পারবেন না, ফলে একসময় আমাদের দেশে আর সৃজনশীল লেখক তৈরি হবে না। তাই তিনি এ আয়োজন শুরু করেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, এখনও অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই অবাধে পাওয়া যাচ্ছে। যা পাওয়ার কথা ছিল না। অনেকেই বিষয়টি ভুলও বুঝতে পারেন। আমি কোনোভাবেই এ ধরনের বইমেলার বিপক্ষে নয়। তবে এ ধরনের বইমেলার নাম হওয়া উচিত আন্তর্জাতিক বইমেলা। তখন বিভিন্ন দেশের প্রকাশনীগুলো তাদের বইয়ের পসরা নিয়ে আসবেন এবং পাঠক তাদের পছন্দমতো বই কিনবেন। তখন শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন, সব দেশের লেখকদের বই, অনুবাদ, কবিতা পাওয়া যাবে এবং আমাদের পাঠকরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের সাহিত্য তুলনা করতে পারবেন। এটাই হওয়া স্বাভাবিক ছিল। অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুধুই আমাদের দেশের লেখকদের মেলা। এই মেলাতে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই আসাটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এতে করে আমরা নিজেরাই আমাদের দেশের লেখকদের এবং চিত্তরঞ্জন সাহার উদ্দেশ্যকে অসম্মান জানাচ্ছি। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
৩. দিনকে দিন বইমেলার প্রসার ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হচ্ছে। আয়োজনের পরিধি, সাজসজ্জা ক্রমেই বাড়ছে। প্রতি বছর মেলায় বইয়ের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, আবার বাড়ছে লেখকের সংখ্যাও। উপন্যাস, কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, শিশুতোষ, ছড়া, মুক্তিযুদ্ধ, গবেষণা, ভ্রমণ, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সায়েন্স ফিকশন, রহস্য, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য, অনুবাদ, নাটক, সঙ্গীত, রাজনীতি, রম্য, ধর্ম ও বিবিধ বিষয়ের ওপর লেখকরা বই লেখেন। এতেই বোঝা যায় বই লেখার পরিসর এবং ক্ষেত্র কতটা বেড়েছে। ২০১৭ সালে মেলায় নতুন ৩ হাজার ৬৪৬টি বই এসেছে। গুণীজনরা সব সময় বলেন, মানসম্মত বইয়ের সংখ্যা কম। হয়তো আরও মানসম্মত বই আসবে এ আশার কথাও তারা বলেন। একই সঙ্গে বইমেলার বিক্রিও বেড়েছে বহুগুণ। ২০১৭ সালে বইমেলায় ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে, যা ২০১৬ সালের চেয়ে ২৩ কোটি টাকা বেশি। প্রতিবছর বইয়ের বিক্রির পরিমাণ দেখেই বোঝা যায় বইপিপাসু লোকের সংখ্যা কী পরিমাণে বেড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও ভার্চুয়াল সময়ে এসেও আমাদের বই বিক্রি কমেনি। প্রশ্ন হল, যে পরিমাণ বইপিপাসু লোক বই পড়ছেন, তাতে কি আমাদের মনন বা বোধের জায়গাটা অনেক সুদৃঢ় হয়েছে? যদি তাই হতো তবে ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু করে নিছক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্ট্যাটাস দেখে কেন আমাদের ক্রোধ এতো বাড়ছে? কেন তরুণরা ছোট বিষয় নিয়ে নিজেদের কলহে লিপ্ত করে খুনে মেতে উঠছে?
কেন সহনশীলতার মাত্রা আমাদের মধ্যে কমে যাচ্ছে? এ প্রশ্নগুলো আমাদের প্রতিনিয়ত ভাবায়। এর অর্থ দাঁড়ায়, আমাদের শিশুকিশোর থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত সবার মননের জায়গাটা এখনও উন্নত হয়নি, আরও উন্নত করতে হবে। তা হবে কিভাবে? যদি আমরা গোটা বছরকে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড দিয়ে ভাগ করে তা প্রতিটি জেলা শহর থেকে শুরু করে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে দিতে পারি, তবেই এ থেকে উত্তরণ পাওয়া যাবে। যদি প্রতিটি জেলা শহরে অমর একুশে গ্রন্থমেলার মতো বড় আয়োজন হয় এবং এ মেলার পাশাপাশি সংস্কৃতির চর্চা, কবিতা আবৃত্তি, পথনাটক, মঞ্চনাটকের ব্যবস্থা করা যায়, তাতে করে সবার মধ্যে নতুন বোধ জাগ্রত হবে। এ আয়োজনগুলো বছরব্যাপী রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে করে বিভিন্ন জেলাশহর থেকে মননশীল, সৃজনশীল মেধাবী তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা একদিকে যেমন বাড়বে, অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যও সাধিত হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জঙ্গিবাদসহ সব অশুভ শক্তি বিতাড়িত হবে মন থেকে।
বিনয় দত্ত : গণমাধ্যমকর্মী
benoydutta.writer@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.