হাসপাতালে অবহেলা: লজ্জায় ডাক্তারি ছাড়তে চান চিকিৎসক বাবা

রোববার সকাল সকাল তেহট্ট যাচ্ছিলাম, আমাদের গ্রামের বাড়ি। ৮টা ৪০ মিনিটের দিকে ফোন পেয়েই গাড়ি ঘোরালাম। ছোট ছেলে সায়ন্তন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এর ২০ মিনিটের মাথায় আবারও ফোন এলো। অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক। তখন সত্যিটা আমাকে বলা না হলেও বুঝতে পেরেছিলাম-ছেলে আর নেই। বাড়ি গিয়ে, টাকাপয়সা নিয়ে, স্ত্রীকে আর বড় ছেলে সৌম্যজিৎকে সঙ্গে করে যখন বাইপাসের মেডিকায় পৌঁছলাম, তখন দুপুর হয়ে গেছে। গিয়ে শুনলাম, সত্যিই সব শেষ। প্রথমেই ছেলের সহপাঠী শুভদীপের মুখোমুখি হই আমি। জানতে চাই, ঠিক কী হয়েছিল। ও অনেকটাই সুস্থ তখন। শুভদীপ আমাকে বলে, দুর্ঘটনার পর ওরা সঙ্গে সঙ্গে সকালে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে পৌঁছলেও অনেক ক্ষণ ধরে মেঝেতেই পড়েছিল। প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুর পর আর কিছুই করা হচ্ছিল না। তখনও বেঁচে ছিল আমার ছেলেটা। কেন আর কিছু করা হচ্ছে না জিজ্ঞেস করলে এক চিকিৎসক নাকি শুভদীপকে বলেন, ‘এখানে এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা নেই। চাইলে অন্য কোথাও চলে যেতে পার।’ আমি নিজেও পেশায় চিকিৎসক। হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের এমন আচরণ আমার অচেনা-অজানা। আর সরকারি হাসপাতালে ‘পরিকাঠামো নেই’ মানে কী! রাজ্যের সেরা পরিকাঠামো তো এখানেই থাকার কথা! স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসকের মুখে ওই কথা শুনে ঘাবড়ে যায় শুভদীপ, প্রশ্ন করে কোথায় যাবে ওরা। ওদের বলা হয়, বাইপাসেই তো বেশ কিছু ভালো বেসরকারি হাসপাতাল আছে। এর পরেই মেডিকা যায় ওরা। আর সেই যাওয়ার পথেই...।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, এই ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজেই পাঁচ বছর পড়েছি আমি। ইন্টার্নশিপ চলার সময়ে অনেকবার এ রকম ইমার্জেন্সি কেস সামলেছি। কখনও বলিনি, ‘আমাদের পরিকাঠামো নেই’ অথবা ‘আমরা পারব না’। সবসময় সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়ে গেছি, আর সেই আশ্বাসই দিয়েছি রোগী ও রোগীর পরিজনদের। ওদের যে ধরনের কথা বলা হয়েছে, তা তো অন্য জায়গায় নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য এক রকম জবরদস্তি করা! হাসপাতাল বলছে, শুভদীপের কথায় এবং ওর সই করা রিস্ক বন্ডের ভিত্তিতে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে ছেলেকে। কিন্তু পরিকাঠামো না থাকার কথা শুনে শুভদীপের আর কী ই বা করার ছিল? এটি তো হাসপাতালের দায় এড়ানো মানসিকতার পরিচয়। হাসপাতাল চিকিৎসাও করল না, আবার ‘রেফার’ করার দায়িত্বও নিজের ঘাড়ে রাখল না। এমনকি একটি ভালো অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত দেয়নি হাসপাতাল। রাস্তা থেকে সাধারণ অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে শুভদীপরা। তাতে লাইফ সাপোর্ট ছিল না। ওটুকু থাকলেও হয়তো ছেলেটা...। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, যে মেডিকেল কলেজ থেকে আমি পাস করলাম, সেখানেই আমার ছেলের সঙ্গে এমনটি হল! আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। কিন্তু ঘটনা পরম্পরা শোনার পর তো স্পষ্ট বুঝতে পারছি, ওর সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। গাফিলতিতেই মারা গেল ও। এর তদন্ত হোক, বিচার হোক। এই লজ্জায়, এই যন্ত্রণায় আমার ডাক্তারি ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে।

No comments

Powered by Blogger.