জেরুজালেম এক ঐতিহ্যবাহী শহর by মো. সাফাক হোসেন

মানবসভ্যতার বহু ঐতিহাসিক শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ শহরের নাম জেরুজালেম। নানা ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সহ মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদি ধর্মের নানা অলৌকিক ঘটনা ও ধর্মীয় স্থাপনা এই একটি শহরের কেন্দ্রেই রয়েছে। জেরুজালেম হচ্ছে একটি শহর যেখানে এই তিনটি ধর্মের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
বিগত প্রায় ছয় হাজার বছর থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত এই অঞ্চলটিকে ঘিরে নানা ধরনের উত্তেজনা, সংঘর্ষ এবং বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনারও অবসান ঘটেছে। তাছাড়াও ধর্মযুদ্ধ বহুবার সংঘটিত হয়েছে যা ইতিহাসের পাতায় পাতায় বর্ণিত রয়েছে।
জেরুজালেম ইহুদিদের জন্য সর্বপবিত্র স্থান করেন হজরত দাউদ (আ.) বা কিং ডেভিড। এই স্থানেই যিশু খ্রিষ্টের ৩৫০০ বছর পূর্বে জয় করে ১২টি গোত্রকে একত্রিত করে এই নগরী স্থাপন করেছিলেন।
তিনি মুসলমানদেরও একজন নবী এবং যে কিতাব তার ওপর নাজিল হয়েছিল সেটিকে অনুসরণ করেই ইহুদি ধর্মের প্রচলন শুরু হয়। তার পুত্র সোলায়মান (আ.)-এর সময়কার কিছু অলৌকিক ঘটনাবলীতে বর্ণিত যে, তিনি সর্বপ্রথম ইহুদিদের জন্য একটি উপাসনালয় স্থাপন করেন যার বর্তমান নাম টেম্পল অব সোলেমান। সেটিকে ঘিরে দেয়াল নির্মিত হয়েছিল এবং এ দেয়াল ধ্বংস হওয়ার পরও কিছু অংশ এখনো দৃশ্যমান এবং বর্তমানে ইহুদিদের জন্য একটি মহা পবিত্র স্থান যেখানে প্রার্থনা করে থাকে।
দ্বিতীয়ত এই অঞ্চল খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ধর্মানুসারে যিশুকে এখানেই ক্রুসিফাইড করে হত্যা করা হয়েছিল। আনুমানিক জেরুজালেমের ওই স্থানেই গির্জা তৈরি করা হয়েছিল যা খ্রিষ্টান ধর্মানুসারীদের জন্য মহাপবিত্র স্থান। সর্বশেষ, মুসলমানদের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার বেশকিছু কারণ রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রথমদিকে নামাজের পবিত্র দিক হিসেবে মসজিদুল আকসা নির্ধারিত হয়েছিল যা পরবর্তীতে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মিরাজ গমনের পর নামাজ আদায়ের পূর্ণাঙ্গ নিয়ম ব্যবস্থা এবং নামাজকে উপহার হিসেবে মুসলমানদের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি যেই স্থান থেকে মিরাজে গমনে করেছিলেন সেটি ছিল মসজিদুল আল-আকসা যা এই জেরুজালেমেই নির্মিত এবং যে পাথর ছিল নবীজীর সফর সঙ্গী; সেই পবিত্র পাথর সংরক্ষিত রয়েছে জেরুজালেমের সোনালী গম্বুজের নিচে যা এখন ডোম অব রকস্‌ নামে পরিচিত। এসব ঘটনাবলীর কারণে শহরটি তিনটি বৃহৎ ধর্মের অনুসারীদের জন্য মহাপবিত্র স্থান।
ইতিহাস মোতাবেক শহরটি প্রথম স্থাপনা করেন দাউদ (আ.) বা কিং ডেভিড। পরবর্তী সময় থেকে শুরু হয় সংঘাত, দখল এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বিশেষ করে খ্রিষ্টধর্ম বিস্তৃত হওয়ার পরবর্তী বেশকিছু বছর পর থেকে। ৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাবিলনীয়দের হাতে ধ্বংস হয় নগরী এবং ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয়। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর পারস্য (বর্তমান ইরান) সম্রাট সাইরাস জেরুজালেম দখল করেন এবং ইহুদিদের পুনর্নিবাস করেন। পুনরায় ধ্বংসপ্রাপ্ত টেম্পল অব সোলেমান সহ বিভিন্ন স্থাপনার মেরামত করা হয়। তাছাড়াও পরবর্তীতে এই অঞ্চল বিভিন্ন সাম্রাজ্য, গোষ্ঠীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সকল ঘটনাকে একত্রিত করলে দাঁড়ায় এই শহর দুইবার ধ্বংস হয়, ৫২ বার আক্রমণ করা হয় এবং ৪৪ বার বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সাম্রাজ্য দ্বারা দখল করা হয়। যার মধ্যে সর্ব উল্লেখযোগ্য ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত হওয়ার কারণে লিপিবদ্ধ রয়েছে এমন শক্তি যারা এ শহর নিয়ন্ত্রণ করেছে তাদের মধ্যে রয়েছে রোমান, পারস্য রাজ্য, আরব, ফ্যাটিমিডস, সেলজুক তুর্ক, ক্রুসেডারস, মিশরের মামলুকস এবং পরবর্তীতে শক্তিশালী মুসলিম সাম্রাজ্য আইয়ুবীদ ও অটোম্যান সাম্রাজ্য এবং সর্বশেষ, ইসরাইল স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি।
মুসলমান শাসনামলের মধ্যে সর্ব উল্লেখযোগ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল ক্রুসেডার বনাম তৎকালীন দামাসকাসের রাজা সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর সঙ্গে। তিনি জেরুজালেম জয়ের পর সকল ধর্মাবলম্বীদের বসবাসের অনুমতি দিয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে এই সাম্রাজ্যের দুর্বল প্রশাসনিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ১১৮৭ সালে জেরুজালেম হাতছাড়া হতে শুরু করে। ১২২৯ থেকে ১২৪৪ পর্যন্ত পুনরায় খ্রিষ্টানদের দখলে চলে যায়। তারপর আবার শুরু হয় সংঘাত, বিদ্রোহ সহ নানা অস্থিরতা।
১৫১৭ সালের কথা। তৎকালীন সময়ের সর্ব আলোচিত এবং শক্তিশালী অটোম্যান সাম্রাজ্য গোটা আরব অঞ্চল, ইউরোপের প্রায় অর্ধেক এবং অন্যান্য অঞ্চল তাদের সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্পূর্ণ প্যালেস্টাইন সহ জেরুজালেমও ছিল অটোম্যান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। ১৯১৭ সালে অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের মুহূর্ত পর্যন্ত। তৎকালীন সময়ের অটোম্যান ১০ম সুলতান সুলেমানের শাসনকাল থেকেই জেরুজালেমে সকল ধর্মের ও গোষ্ঠীর সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। ইতিহাসের তথ্য মোতাবেক মধ্যযুগীয় সময় অটোম্যান রাজত্ব সময়কালই ছিল সর্বোত্তম সময় জেরুজালেমবাসীদের জন্য। সুলতান সুলেমানের সময়েই ধর্মীয় অঞ্চলগুলোর সুরক্ষার জন্য যে দেয়াল নির্মিত হয়েছিল তা এখনো দৃশ্যমান।
১৯১৭ সালের পর জেরুজালেম বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনস্থ হওয়ার পর থেকে পুনরায় জেরুজালেম ঘিরে সংঘাত ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয় যা আজও থামেনি। রক্তাক্ত হতে থাকে জেরুজালেমের মাটি। সংঘাত চরমে উঠে ১৯৪০ সালে। বেলফোর ঘোষণার পর। ওই ঘোষণায় ইহুদিদের জন্য বৃটিশ দখলকৃত প্যালেস্টাইনে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। এতে প্যালেস্টাইনে বসবাসরত গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮ সালে জেরুজালেমকে একবার ইসরাইলি রাষ্ট্রের রাজধানী করার ঘোষণা দিয়েছিলেন ডেভিড বেন গোরিথন। যদিও জাতিসংঘের এক ঘোষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, প্যালেস্টাইনে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের জন্য প্যালেস্টাইন এবং ইহুদিদের জন্য আলাদাভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র এবং জেরুজালেম আন্তর্জাতিক অঞ্চল হিসেবে স্থাপিত হবে। যাই হোক জেরুজালেমকে ঘিরে আজ পর্যন্ত যত রক্তপাতের ইতিহাসের ঘটনা ঘটেছে দুনিয়ার আর কোথাও এমন নজির নেই। যেহেতু তিনটি ধর্মের ধর্মাবলম্বীদের জন্যই জেরুজালেম একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরী এবং সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু তাই। এই নগরীকে বিশেষ আলাদা আলাদা অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া। যাতে সকলের যাতায়াত এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এই অঞ্চল সকলের জন্য উন্মুক্ত হওয়া উচিত। যদিও কিছু কিছু দেশের মধ্যে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্বের বড় বড় প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক শান্তির কথা বিবেচনা করেন তাহলে তা বাস্তবায়নে সম্ভব। কিছু দিন পূর্বে জেরুজালেমকে ইসরাইলের পূর্ণাঙ্গ রাজধানী হিসেবে ডনাল্ড ট্রাম্পের একক ঘোষণার পর নতুনভাবে সমগ্র বিশ্বে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে।
হাজার বছরের এই পুরাতন শহরের সংঘাতময় পরিস্থিতির সহজে সমাধান হবে বলে সন্দেহ রয়েছে। বর্তমানের সৃষ্ট এই উত্তেজনা রক্তক্ষয়ী সংঘাতের কারণে শহরের ঐতিহ্য পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস হতে পারে। বিলুপ্ত হতে পারে হাজার হাজার বছরের মানব সভ্যতার নিদর্শন।
লেখক: একজন তরুণ ব্যবসায়ী এবং ভ্রমণকারী

No comments

Powered by Blogger.