প্রকাশ্যে আন্দোলন গোপনে সমঝোতার চেষ্টা?

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষুব্ধ সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রকাশ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে আন্দোলনের পাশাপাশি বিচার বিভাগের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টাও রয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, সমঝোতার এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শনিবার রাতে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বাসভবনে যান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এর আগে গত সপ্তাহে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মতিন খসরুসহ দলীয় সমর্থক সিনিয়র আইনজীবীরা। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু রোববার যুগান্তরকে বলেন, আমরা কোনো অবস্থায় বিচার বিভাগের সঙ্গে বৈরিতা ও সাংঘর্ষিক অবস্থায় যেতে চাচ্ছি না। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করতে চাই। কারণ বিচার বিভাগ আমাদের শত্রু নয়। আলোচনার পাশাপাশি কি তাহলে আন্দোলনও চলবে? এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, একতরফা মন্তব্যে কেউ বিক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিক্রিয়া তো দেখাতেই পারেন। তবে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, ‘আদালতের রায় নিয়ে ভিন্নমত থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা করা, বিচারককে অপমান করা, অপমানসূচক মন্তব্য করা, রাজনৈতিক রেষারেষি, পাল্টাপাল্টি অবস্থান- দেশের আইনের শাসন, আইনের প্রতি সম্মান এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, যা জাতির জন্য অমঙ্গলজনক।’ আওয়ামী লীগ আন্দোলনের পাশাপাশি গোপনে সমঝোতার চেষ্টা করছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ‘তারা রায়ের বিষয়ে দ্বিমত করতে পারে, সংক্ষুব্ধ হতেই পারে। প্রকাশ করার পথ আছে। কিন্তু আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এদিকে অতীতে বিচারকদের যে সংস্কৃতি দেখেছি- তারা কোনো অনুষ্ঠানে যেতেন না, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা দিতেন না। কিন্তু যেটা ঘটেছে সেটা অস্বাভাবিক। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক প্রধান বিচারপতির সঙ্গে নৈশভোজ করেছেন। এটা আমি কাক্সিক্ষত মনে করি না।’ উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদ থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে ফিরে যাওয়ায় সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ। তার চেয়েও বেশি ক্ষোভ তাদের রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের পর্যবেক্ষণে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রসঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাকে খাটো করা হয়েছে- এমন অভিযোগ করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহল। ৭ আগস্ট সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রায়ের পর্যবেক্ষণের ‘আপত্তিকর’ বক্তব্যগুলোর বিষয়ে সারা দেশে জনমত তৈরির নির্দেশ দেন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের। এরপরই সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা রায়ের পর্যবেক্ষণের কিছু বিষয়ে নিজেদের দ্বিমত ও ক্ষোভের কথা তুলে ধরে তাদের পক্ষে জনমত শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন। এই ইস্যুতে ক্ষমতাসীন দল এখন সারা দেশে প্রতিবাদমুখর। শনিবার বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘আপত্তিকর’ বক্তব্য এক্সপাঞ্জ (প্রত্যাহার) চেয়ে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এই কর্মসূচি অনুযায়ী রোববার ঢাকায় সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণসহ সারা দেশের আইনজীবী সমিতিগুলোতে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আগামী ১৬ ও ১৭ আগস্ট সারা দেশে একই ধরনের প্রতিবাদ সমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের। ঢাকায় সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির দক্ষিণ হলে প্রতিবাদ সমাবেশে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সমাবেশে সংগঠনের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, একটি অপশক্তি দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। যখনই দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সংবিধান ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে, আইনজীবী সমাজ তখনই জেগে উঠেছে, রুখে দাঁড়িয়েছে। আজ সেই ষড়যন্ত্র দানা বেঁধেছে, তাই আইনজীবী সমাজের এই প্রতিবাদ সমাবেশ। বিএনপিও বসে নেই। ২০ দলীয় জোটপন্থী আইনজীবীরা পূর্বঘোষণা অনুযায়ী পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় আছেন। এছাড়া রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণ অনভিপ্রেত ও রাজনৈতিক। সেই পর্যবেক্ষণ আজকে বিএনপিকে উল্লসিত করেছে। সভা-সমাবেশ ও সেমিনারে প্রতিবাদের পাশাপাশি বিচার বিভাগের সঙ্গে সমঝোতার জন্য আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শনিবার রাতে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সঙ্গে তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। রোববার বিকালে শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে হ্যান্ডবল ফেডারেশনের উদ্যোগে রাজধানীর শেখ রাসেল রোলার স্কেটিং কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমি মাননীয় প্রধান বিচারপতির বাড়িতে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমি তার সঙ্গে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের যে পর্যবেক্ষণ বা অবজারভেশন সেগুলো নিয়ে আমাদের পার্টির বক্তব্য তাকে জানিয়েছি। তার সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আরও আলোচনা হবে। আলোচনা এখনও শেষ হয়নি। শেষ হওয়ার আগে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। সময়মতো সব কথা আপনারাও জানবেন, আমিও বলব।’ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের সাক্ষাতের ঘটনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিস্ময় ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রোববার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায় পরিবর্তনের জন্য সরকার নানাভাবে বিচার বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। কেননা এ রায়ের পর প্রধান বিচারপতিকে এত অশালীন ভাষায় আক্রমণ করার পর ওবায়দুল কাদের প্রধান বিচারপতির বাসভবনে নৈশভোজ করেছেন। এতে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগ এ রায় পরিবর্তনের জন্য প্রধান বিচারপতির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপিরা যে অশালীন বক্তব্য দিচ্ছেন তার নিন্দা জানান বিএনপি মহাসচিব। সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম রোববার রাতে যুগান্তরকে বলেন, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে উত্তেজনা ও দ্বন্দ্ব বন্ধ হওয়া দরকার। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ (সংসদ) ও নির্বাহী বিভাগ সংবিধানের সৃষ্ট। সুতরাং কোনো একটা আরেকটার ওপর আধিপত্য দাবি করতে পারে না। সবাইকে বিতর্ক বন্ধ করতে হবে। এদিকে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া কি? এ বিষয়ে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা এখনও রায়ের সত্যায়িত কপি পাইনি। আশা করছি এ সপ্তাহে পেয়ে যাব। কপি পাওয়ার পর আমরা দেখব আমাদের যুক্তিতর্ক সব ঠিকঠাক এসেছে কিনা। দেখে এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’ রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রায়ের সত্যায়িত কপি পাওয়ার পর এক মাসের মধ্যে আইনে রিভিউ করার সুযোগ রয়েছে। উভয়পক্ষ রিভিউ করতে পারবে।’ রায়ের মধ্যে যেসব বিষয় নিয়ে সরকারি দলের আপত্তি এবং তা প্রত্যাহারের কথা বলা হচ্ছে- সে বিষয়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘রিভিউ ছাড়া তাদের আর কোনো সুযোগ নেই। রায় নিয়ে তাদের যেসব আপত্তি তা ওই রিভিউতেই বলতে হবে।’ এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা রিভিউ করব এবং রিভিউর মধ্যেই আমাদের আপত্তির বিষয়টি উল্লেখ করা হবে।’

No comments

Powered by Blogger.