লন্ডনের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু কিছু নেপথ্য কথা

লন্ডনে থাকি। কিন্তু আজকাল বড় একটা ঘরের বাইরে যাই না। বার্ধক্য এবং জরা দুই-ই জড়িয়ে ধরেছে। তবু উইক এন্ডে (শনি ও রবিবার) মাঝে মাঝে বাজার-সওদা করতে ইস্ট লন্ডনে যাই। গেলে অধুনা একটা দৃশ্য চোখে পড়ে। তেতাল্লিশ বছর লন্ডনে আছি। আগে এই দৃশ্যটা চোখে পড়েনি। দৃশ্যটা হল ইস্ট লন্ডনের সিডনি স্ট্রিটে একটি বাড়ির সামনে একটি আবক্ষ মূর্তি। তাতে বাঙালি এবং বিদেশি মানুষের ভিড়। বিদেশিদের হাতেও ক্যামেরা এবং ফুল। আবক্ষ মূর্তিটি ফুলের মালায় আচ্ছাদিত। স্ট্যাচুটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এই স্ট্যাচুটি স্থাপিত হয়েছে এখনও বছর ঘোরেনি। এরই মধ্যে প্রতি শনি ও রবিবার এই স্ট্যাচুটি দেখতে এসে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য প্রচুর ভিড় জমে। কোনো কোনো দিন বিদেশি দর্শকরাই বেশি ভিড় জমায়। লন্ডন ট্যুরিস্ট গাইডেও এই স্ট্যাচুকে লন্ডনের দর্শনীয় ভাস্কর্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। ফলে শহরের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত এই স্ট্যাচু দেখার জন্য প্রতিদিন ভিড় বাড়ছে। এই স্ট্যাচুর প্রতিষ্ঠাতা আফসার খান সাদেক একজন তরুণ ব্যবসায়ী এবং আওয়ামী লীগ যুক্তরাজ্য শাখার একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী। বৃহত্তর সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার চারাবাই গ্রামের মানুষ। বয়স সাতচল্লিশ। ১৯৯০ সালে লন্ডনে আসেন। তার একেবারে বাড়ির সামনে দিন দিন ভিড় বাড়তে থাকায় সাদেকের পরিবার-পরিজন বিব্রত। এই হারে ভিড় বাড়লে তাদের পক্ষে বাড়িতে থাকা কষ্টকর হবে।
একেবারে বাড়ির দরজায় ভিড় বাড়তে থাকায় তারা আনন্দিত ও উৎসাহী হলেও ভবিষ্যতে এই স্ট্যাচু দর্শনের ভিড় অতিমাত্রায় বেড়ে গেলে এই বাড়ি ছেড়ে যেতে হয় কিনা তা ভেবে বিড়ম্বিত। সাদেকের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘকালের। বিয়ানীবাজারের চারাবাই গ্রামের শিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত খান পরিবারের সন্তান। নিজেও শিক্ষিত এবং লন্ডনে এসেছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। তারপর লন্ডনেই থেকে গেছেন। দেশে থাকতে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। লন্ডনে এসেও লন্ডন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। এখন লন্ডন আওয়ামী লীগের একজন নেতা। ১৯৯৪ সাল থেকে আফসার খান সাদেকের ইচ্ছা লন্ডনে হয় পার্লামেন্ট স্কোয়ারে অথবা মাদামতুসোতে অন্যান্য বিশ্ব নেতার পাশে বঙ্গবন্ধুর একটি লাইফ-সাইজ স্ট্যাচু স্থাপিত হোক। সারা বিশ্বের বিখ্যাত নেতানেত্রীদের স্ট্যাচু মাদামতুসোতে স্থাপিত হতে পারলে বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু স্থাপিত হবে না কেন? এখন তিনিও তো একজন বিশ্বনেতা। ব্রিটিশ রাজের শ্বেতাঙ্গ প্রতিনিধিরা দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে ২৭ বছর কারাগারে রাখার পর এখন লন্ডনে তার একাধিক মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে প্রায় পূজা করছে; তাহলে অধিকতর বর্ণাঢ্য চরিত্রের সংগ্রামী নেতা বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমানের স্ট্যাচু কেন লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কোয়ারে মাদামতুসোতে প্রতিষ্ঠা পাবে না? সেকথা বলার আগে একটু পেছনের কথা বলি। আমি যখন প্রথম লন্ডনে আসি, তখন লন্ডন আমার কাছে এক স্বপ্নের শহর। ব্রিটিশ শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রকে ঘৃণা করি; কিন্তু তাদের ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্পকলার দিকে গভীর অনুরাগ। পরিণত বয়সে লন্ডনে এসেছি; কিন্তু অপরিণত বয়সে, লন্ডনে আসার আগেই শহরটির রাস্তাঘাটের নাম, ঐতিহাসিক ব্যক্তি এবং তাদের বাড়িঘরের খবর আমার নখদর্পণে ছিল।
শেলী ও কীটসের বাড়ি, হাইগেটে কার্ল মার্কসের কবর, হাইড পার্কে চার্চিলের বাসভবন, পার্লামেন্ট স্কোয়ার এবং মাদামতুসোতে বিশ্বখ্যাত নারী-পুরুষের স্ট্যাচু দেখে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। ছুটে গেছি সোহতে কার্ল মার্কস যে বাড়িতে ছিলেন। গেছি রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের বাসভবনে। কৈশোরে যে শার্লক হোমসের গোয়েন্দা কাহিনী পাগলের মতো পড়তাম, তার স্রষ্টা স্যার আর্থার কেনান ডায়লের বেকার স্ট্রিটের বাড়িতে (এখন মিউজিয়াম) কয়েক দফা ঢুকেছি। বেকার স্ট্রিটের কাছেই মাদামতুসোতে গান্ধী, নেহেরু, জোমো কেনিয়াতা প্রমুখ এশিয়ান ও আফ্রিকান নেতাদের স্ট্যাচু দেখে আমার মনে হয়েছিল, এই মাদামতুসোতে বঙ্গবন্ধুর একটি লাইফ-সাইজ স্ট্যাচু নেই কেন? তিনি তখন জীবিত এবং বিশ্বনন্দিত। একাধিক জীবিত নেতার স্ট্যাচু তখন মাদামতুসোতে ছিল এবং এখনও আছে। আমি লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন হাইকমিশনার সৈয়দ আবদুল সুলতানকে আমার মনের কথাটি জানিয়েছিলাম। তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে আগ্রহী নন। তাছাড়া এই স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠায় বড় রকমের খরচপত্রও আছে। বঙ্গবন্ধু নিজের জন্য এই খরচপত্রে আগ্রহী নন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর যখন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন প্রয়াত গউস খান, তখন আবার মাদামতুসোতে বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। নানা কারণে উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। ২০১২ সালে অধ্যাপক সাইদুর রহমান যখন ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার, তখন লন্ডনের ক্যামডেন এলাকায় ব্রান্সউইক পার্কে বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন; কিন্তু বিএনপি ও জামায়াতপন্থীদের চক্রান্তে সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। সাদেক এসব কথা জেনেই নিজের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। আমাকে তিনি যখন সিদ্ধান্তটি জানান, তখন তাকে বলেছি, এই স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠা বিরাট খরচের ব্যাপার। তুমি ব্যক্তিগতভাবে এত খরচের ধাক্কা সামলাতে পারবে? সাদেক বলেছেন, ‘একটি আবক্ষ স্ট্যাচু বানানোর খরচ সামলাতে পারব। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, যারা বঙ্গবন্ধুর অনুসারী।’ বলেছি, তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠা করবে কোথায়? সাদেক বলেছেন, জায়গা না পেলে আমার বাড়ির সামনেই প্রতিষ্ঠা করব। লন্ডনে দেশ-বিদেশের এত নেতার স্ট্যাচু আছে, বঙ্গবন্ধুর নেই, এই দুঃখ থেকে আফসার খান সাদেক এই স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠার প্রজেক্ট হাতে নেন। তার বাড়িটি টাওয়ার হ্যামলেটসে অবস্থিত। সিডনি স্ট্রিটের ৫ নম্বর এলরিচ কটেজ। তিনি এই স্ট্যাচু তার বাড়ির সামনে নিজস্ব জমিতে প্রতিষ্ঠার জন্য টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে ২০০৯ সালে আবেদন জানান। কাউন্সিল জানায়, সাদেক নিজস্ব জমিতে স্ট্যাচু স্থাপন করলে তাদের পারমিশন লাগবে না। কিন্তু তার বন্ধু কয়েকজন কাউন্সিলর বলেন, এত বড় প্রজেক্ট, এজন্য কাউন্সিলের কাছ থেকে ফুল প্লানিং পারমিশন নিতে হবে। সাদেক ২০১৪ সালে ফুল পারমিশনের জন্য আবেদন জানান। সেজন্য প্রয়োজনীয় অর্থও জমা দেন। তার এই প্রজেক্টের ব্যাপারে কাউন্সিল পূর্ণ তদন্ত চালায়। জায়গাটি আবাসিক এলাকা বিধায় বাসিন্দাদের এই ব্যাপারে কোনো আপত্তি আছে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়। এখানে বিএনপি ও জামায়াতিদের কোনো ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দারা সানন্দে এই স্ট্যাচু স্থাপনে তাদের আপত্তি নেই বলে জানায়। সাদেকের প্রজেক্ট কাউন্সিলের অনুমোদন পায়। সিডনি স্ট্রিটে বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু স্থাপনের পারমিশন পাওয়ার পর সাদেক বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানার সঙ্গে দেখা করেন। রেহানা বলেন, ‘আমাদের হাইকমিশন যা পারেনি, তুমি তা করে ফেলেছ। তোমাকে অভিনন্দন।’
ওই বছর ২০১৪ সালেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডন সফরে আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠায় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের অনুমোদনপত্র দেখার পর সাদেককে তার প্রজেক্ট বাস্তবায়নের অনুমতি দেন। সাদেক কলকাতার এক ভাস্কর্যকে স্ট্যাচুটি নির্মাণের ভার দেন। এই স্ট্যাচু নির্মাণে সময় লেগেছে দু’বছর। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে এই স্ট্যাচু লন্ডনে এসে পৌঁছায়। সাদেকের বাড়ির সামনের জমিতে শুরু হয় স্ট্যাচুটি ইনস্টলেশনের কাজ। ১৩ জুন তা শেষ হয়। ওই বছর ১৭ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নির্দেশে স্ট্যাচুর আবরণ উন্মোচন করেন আওয়ামী লীগ নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের হাইকমিশনারসহ ব্রিটেনের বহু বিশিষ্ট বাংলাদেশি ও ব্রিটিশ নাগরিক। এই অনুষ্ঠানে একজন ব্রিটিশ এমপি বলেছেন, ‘মনে হতে পারে এটি একটি প্রাণহীন স্ট্যাচু; কিন্তু এই স্ট্যাচু যার অবয়ব ধারণ করেছে, তিনি ছিলেন শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম ও মুক্তির প্রতীক। তিনি ‘ছিলেন’ বলছি কেন, তিনি এখনও আছেন। নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষকে মুক্তির পথনির্দেশনা করছেন। মনে হতে পারে এটি একটি পাষাণমূর্তি। এই মূর্তির আড়ালেই রয়েছেন সেই চিরজাগ্রত মানুষটি। ব্রিটেনের মাটিতে তার অবস্থান আমাদের জন্য পরম গৌরবের (ইংরেজি বক্তৃতার অনুবাদ আমার)। সাদেকের আমন্ত্রণে তার বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচুতে ফুল রেখে শ্রদ্ধা জানাতে বহু মানুষের ভিড়ে আমিও গেছি। অবনত শিরে মনে মনে বলেছি : ‘মুক্তিদাতা, তোমারও দয়া, তোমারও ক্ষমা রবে চির পাথেয় চির যাত্রার।’ আফসার খান সাদেককে বলেছি, একদিন তোমার নামও লেখা হবে ব্রিটেনে বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু স্থাপনের প্রথম অগ্রদূত হিসেবে। তুমিও এক মহাজীবনের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলে!
লন্ডন, ১২ আগস্ট, শনিবার, ২০১৭

No comments

Powered by Blogger.