ম্যাজিক দুনিয়ার কিংবদন্তি by মোশাররফ রুমী

মঞ্চে চলছে আলো-আঁধারের খেলা। এরইমধ্যে অসাধারণ নৈপুণ্যে বাঁশি বাজাচ্ছেন তিনি। পাশে দাঁড়ানো তার স্ত্রী বিপাশা বাঁশির সুরে মন্ত্রমুগ্ধ। ধীরে ধীরে তার চোখ বুজে এলো। বাঁশির সুর ক্রমশই হয়ে উঠলো আরো বেশি মোহনীয়। সেই সুরে সম্মোহিত হয়ে শূন্যে ভাসলেন বিপাশা। শুধু তাই নয়, গিলোটিনের ভেতর ঘাড় পেতে দিলেন তিনি। বংশীবাদক বাঁশি ছেড়ে হাতে তুলে নিলেন ঝকঝকে ইলেকট্রিক করাত। কি করতে যাচ্ছেন তিনি?  ইলেকট্রিক করাত দিয়ে কি স্ত্রীর গলা কাটবেন? এমন সব জিজ্ঞাসার রেশ কাটার আগেই বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে প্রিয়তমা স্ত্রীর ঘাড় বরাবর নামিয়ে আনলেন ধারালো করাত। আতঙ্কে শিউরে উঠলো হলভর্তি দর্শক। কিন্তু কী বিস্ময়কর ঘটনা, অক্ষতই রইলেন বিপাশা। হাসি মুখে গিলোটিন থেকে ঘাড় সরিয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে মাথা নোয়ালেন। অভিভূত দর্শক দেখলো গিলোটিনের ওপর আর নিচের ফুটোয় রাখা কিছু গাজর করাত-কাটা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। একই মানুষ ইলেকট্রিক করাত দিয়ে স্ত্রী বিপাশাকে দ্বিখণ্ডিত করে আবার তাকে সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনার ম্যাজিকেও মুগ্ধ করে চলেছেন জাদুপ্রেমীদের। এই হলেন ম্যাজিক দুনিয়ার কিংবদন্তি বিশ্বনন্দিত স্বনামধন্য জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, যিনি জাদুকে বিনোদন থেকে শিল্পের মর্যাদায় উন্নীত করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে সুপরিচিত ও সম্মানিত করেছেন। একজন ব্যতিক্রমী প্রতিভাবান, দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত, স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। তার রয়েছে দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করার এক অনন্য ক্ষমতা। যা তার জাদু প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে সবসময় দেখা যায়। জুয়েল আইচ তার বড় ম্যাজিকগুলো প্রদর্শনের সময় মিউজিকের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে থাকেন। ফলে দর্শক-শ্রোতা চমৎকৃত ও বিমোহিত হন। বিশ্বে জুয়েল আইচই একমাত্র জাদুশিল্পী, যিনি তার জাদুর আবহ সংগীত হিসেবে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুলগীতি, খেয়াল, অতুল প্রসাদী, সেতার ইত্যাদি ব্যবহার করেন। মিউজিকের সঙ্গে আলোর অর্থপূর্ণ ব্যবহারও তার জাদুতে এক অকল্পনীয় মাত্রা যোগ করে। জুয়েল আইচ শুধু জাদুশিল্পী বা বাঁশিবাদকই নন, একাধারে চিত্রশিল্পী-সমাজসেবী এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। চমৎকার করে কথা বলেন তিনি। আর তার হাসি যেন মায়ার আধার। কথা বললে কিংবা হাসলেও মনে হয় সে সবই যেন জাদু। তার সুনিপুণ বাঁশি বাজানো আর ছবি আঁকাতেও জড়িয়ে থাকে দুর্দান্ত ম্যাজিকেরক আবহ। শিল্পনৈপুণ্যে ভরপুর তার জাদুর অনবদ্য উপস্থাপন দর্শককে করে দারুণভাবে পুলকিত এবং আনন্দিত। আর এসব কারণেই জুয়েল আইচ দেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে এক আলেচিত নাম। প্রশংসনীয় মুখ। বিশ্ববিখ্যাত জাদু গবেষক জেমস র‌্যান্ডি সারা পৃথিবীর জাদুর ইতিহাসের আদিকাল থেকে আধুনিককালের উল্লেখযোগ্য সব জাদুশিল্পীর ওপর একটি গবেষণা করেন। অবশেষে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জাদুশিল্পীদের একটি তালিকা করেন তিনি। এতে জাদুর সব শাখা যেমন ক্লোজআপ, ক্যাবারে, কমেডি, মেন্টাল ম্যাজিক, বন্ধন মুক্তি, ভেন্ট্রিলোকুইজম এবং বৃহদাকার মঞ্চমায়া সৃষ্টিকারীদের নাম স্থান পায়। সেই সংক্ষিপ্ত তালিকায় ২৯৫ জন জাদুশিল্পীর নাম আছে। সেখানে জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের প্রশংসা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। জাদু বিশ্বের এক বড়মাপের প্রকাশনা ‘হুজ হু ইন ম্যাজিক’-এ লেখা হয়েছে, জুয়েল আইচের আবিষ্কৃত মঞ্চ মায়াগুলো এবং সম্পূর্ণ নতুন রূপে সাজানো ক্ল্যাসিক জাদুগুলো বিশ্ব জাদুভাণ্ডারে মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকবে। বাংলা সাহিত্যের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ তার ‘ম্যাজিক মুনশি’ উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে লিখেছেন- জুয়েল আইচ, জাদুবিদ্যার এভারেস্টে যিনি উঠেছেন। এভারেস্ট জয়ীরা শৃঙ্গ বিজয়ের পর নেমে আসেন। ইনি নামতে ভুলে গেছেন। বিশ্ববরেণ্য জাদু বিশেষজ্ঞ ডোনাল্ড ডিউইন্টার লন্ডনের বিখ্যাত ডমিনিয়ন থিয়েটারে জুয়েল আইচের শো দেখে লেখেন, এ এমনই এক অবিস্মরণীয় অনুভূতি যা বর্ণনা করা যায় না, যা শিখে আয়ত্ত করা যায় না। এ একান্তই সহজাত প্রতিভা, যা নিয়ে জন্মাতে হয়। ম্যাজিক দুনিয়ার কিংবদন্তি জুয়েল আইচ ম্যাজিকে আকৃষ্ট হলেন কিভাবে জানতে চাইলে বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম স্বপ্নবিলাসী। অনেক কিছুই হওয়ার স্বপ্ন আমায় ঘিরে রাখতো। বিশেষ করে ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক তৈরি হয় খুব। আমার বাবার শখ ছিল ছবি আঁকা। তার দেখাদেখি আমিও ছবি আঁকা শুরু করি। সেই অভ্যাস এখনো আছে। গ্রামের মেলায় একবার দেখলাম এক বাঁশিওয়ালাকে, বাজিয়ে বাজিয়ে বাঁশি বিক্রি করছে। আমারও ইচ্ছে হলো বাঁশিওয়ালা হওয়ার। শুরু হলো আমার বাঁশি বাজানোর কসরত। একবার আমাদের গ্রামে বেদে দল এসেছিল। সে দলের একজনের কাছ থেকেই আমি প্রথম জাদু দেখি। বেদে জাদুকরের সেই জাদু দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম যারপরনাই। কাঠের তিনটি বাটির নিচে কাপড়ের তিনটি বল রেখে সুন্দর একটি জাদু দেখিয়েছিলেন তিনি! আর তখন থেকেই জাদু শেখার বাসনা আমার মনের মধ্যে অনবরত ডানা ঝাপটাতে থাকে। কিন্তু বেদে জাদুকরের তেল চিটচিটে কাপড়ের বল, আর তার অনাহারি রুগ্‌ণ-ভগ্ন শরীর এবং ভয়ঙ্কর দারিদ্র্যের অসহায়ত্বের যে ছাপ চেহারায় ফুটে উঠেছিল তা দেখে ওর মতো ম্যাজিশিয়ান হওয়ার ইচ্ছে তখন মনের কোনেই চাপা পড়ে যায়। অবশ্য জাদুর প্রতি আমার মূল আকর্ষণটা তৈরি হয় আরো অনেক পরে। বানারীপাড়া সার্কাস দলের এক জাদুকরের জাদু দেখে তো আমি হতবাক। সেই জাদুকর একটা ছেলের গলা কেটে ফেলছে, আবার জাদু দিয়ে গলা জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছে। ঠিক করলাম, আমিও জাদু শিখবো। ছোটবেলায় রূপকথা পড়তে আমি খুব পছন্দ করতাম। বন্দে আলী মিয়ার রূপকথা ছিল আমার খুব প্রিয়। প্রায় স্বপ্নে দেখতাম, আমি বন্দে আলী মিয়ার রূপকথার জাদুর দেশে চলে গেছি। জাদু দিয়ে পাল্টে দিচ্ছি সবকিছু। জাদুর প্রতি আমার আকর্ষণটা উন্মাদনায় পরিণত হয় সিরাজগঞ্জের জাদুকর আবদুর রশিদের জাদু দেখে। সময়টা ১৯৬৫ সাল। আমি তখন পিরোজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। সে সময়ে পিরোজপুরে তাবু ফেলে বিখ্যাত ‘সাধনা লায়ন সার্কাস’। জাদুশিল্পী হিসেবে এ সার্কাস দলের নিয়মিত পারফরমার ছিলেন জাদুশিল্পী প্রফেসর আবদুর রশিদ। তার অসাধারণ জাদু দেখে আমি বিস্মিত হই। তার ওপর  জাদুসম্রাট পিসি সরকারের (সিনিয়র) লেখা ‘ম্যাজিকের খেলা’, জাদুগির আলাদেনের লেখা ‘অভিনব ম্যাজিক’ গ্রন্থ দুটি পড়েও অনুপ্রাণিত হই। একজন শিক্ষিত মানুষ হয়েও জাদুশিল্পকে পেশা হিসেবে নিয়ে পিসি সরকার দিব্যি জীবনযাপন করছেন জানতে পেরে ভীষণভাবে উৎসাহিত হই আমি। সচেতনভাবে একজন জাদুশিল্পী হওয়ার স্বপ্নটা বোধহয় তখন থেকেই দেখতে শুরু করি। ম্যাজিক সম্পর্কিত রাজ্যের বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে শুরু করলাম ম্যাজিক প্র্যাকটিস। তবে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাকে সেই স্বপ্ন নিয়ে তখন বেশি দূর যেতে দেয়নি। ১৯৭১ সালে স্নাতক পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল জুয়েল আইচের। কিন্তু সে সময় দেশমাতৃকার সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করতে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে গিয়ে তিনি যোগ দেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। তাই সে বছর আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি। ৯ নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত স্বরূপকাঠি এবং ঝালকাঠির সুবিশাল পেয়ারা বাগানের গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণে পাক বাহিনী ছিল ভীতসন্ত্রস্ত। জুয়েল আইচ ছিলেন বিশাল বিস্তৃত সেই পেয়ারা বাগানের গেরিলা যুদ্ধের সাহসী এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কোন তাগিদ থেকে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আসলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কোনো পূর্ব প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা ছাড়াই সংঘটিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ করবো, এরকম চিন্তাভাবনা আমার আগে থেকে ছিল না। কারণ আমি প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে কখনোই যুক্ত ছিলাম না। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মনে হলো, দেশে থাকলে মরতে হবে। মরতে যখন হবেই তো এভাবে মার খেয়ে কাপুরুষের মতো মরে যাওয়া ঠিক হবে না। মরবো যখন লড়াই করে মরবো, যুদ্ধ করে মরবো। অবশ্য আগেই উপলব্ধি করেছিলাম, পাকিস্তান কিছুতেই আমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেবে না। তারা আমাদের অধিকারবঞ্চিত করে রাখবে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম করতে হবে। জুয়েল আইচ জানান, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তার জীবনে আঘাত হানে এক মারাত্মক দুর্ঘটনা। তার পিরোজপুরের বাড়ির সব জিনিসপত্র প্রথমে লুট করে নেয় দুর্বৃত্তরা। তাদেরই এক প্রতিবেশী দালাল পরিবার এ কুকর্মটি করে। এর পর পালাক্রমে বাড়ির ফার্নিচার এবং সবশেষে ঘরের মেঝের সিমেন্ট পর্যন্ত খুঁড়ে বাড়িটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। দুর্বৃত্তদের ধারণা ছিল সচ্ছল পরিবার, অনেক স্বর্ণালঙ্কার আছে- আর এ সম্পদ হয়তো মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হতে পারে। এ সময় তার ম্যাজিকের সব যন্ত্রপাতি, বাঁশি, ছবি আঁকার ইজেল, রং-তুলি, ক্যানভাস, বইয়ের লাইব্রেরি, যাবতীয় পুরস্কার, নিজের আঁকা সব চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, তিল তিল করে জমানো জীবনের সব সঞ্চয় লোপাট হয়ে যায়। দুর্বৃত্তরা দেশময় লাখ লাখ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা বা ধর্ষণের পর বাড়িঘর দোকানপাট সব পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। এ পরিস্থিতিতে স্বরূপকাঠির পেয়ারা বাগান ছেড়ে বাধ্য হয়ে অসুস্থ অনাহারী জুয়েল অচেনা গ্রামের পথে হেঁটে ভারতের হাসনাবাদে গিয়ে উপস্থিত হন। সে সময়ে তার মারাত্মক রক্ত আমাশয় দেখা দেয়। ক্যাম্পের চিকিৎসকরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধের ময়দানে যেতে তাকে বারণ করেন। বরং অপেক্ষাকৃত হালকা কাজ বাহাদুরপুর (নদীয়া) শরণার্থী ক্যাম্পের স্কুলে তাকে শিক্ষকতা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি ম্যাজিক জানেন এ কথা ছড়িয়ে পড়ায় বাহাদুরপুর এলাকার কয়েকজন শৌখিন ভারতীয় ম্যাজিশিয়ান ক্যাম্পের স্কুলে এসে তার সঙ্গে দেখা করেন। তাদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে তিনিও কলকাতার কয়েকজন ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তবে এসপ্ল্যানেড এলাকায় কয়েকজন ফুটপাতের ম্যাজিশিয়ানের ম্যাজিক দেখে তিনি মজা পান। সে সময় মৃণাল রায়, ও পি আগরওয়াল, মার্কাস, সুবীর সরকারসহ বেশ কয়েকজন জাদুশিল্পীর প্রদর্শনী দেখার সৌভাগ্যও হয় তার। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ১৭ই ডিসেম্বর তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরেই তিনি ঢাকায় না থেকে চলে যান গ্রামে। উদ্দেশ্য গরিবদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করা। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে সমদেকাঠি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন জুয়েল আইচ। তিনি পড়ানোর সময় রাগারাগি না করে সুন্দর সুন্দর গল্প বলে, উপমা দিয়ে, ছবি এঁকে, অভিনয় করে, জাদু দেখিয়ে প্রয়োজনে কৌতুক বলে, নিজের তৈরি নানা রকম খেলনা ও সরঞ্জামের সাহায্যে কিছুটা খেলা এবং কিছুটা কাজের মাধ্যমে শৃঙ্খলাবোধ এবং আশা জাগিয়ে তোলেন ছাত্রদের মধ্যে। স্কুলবিমুখ নিঃস্ব ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহী হয়ে উঠতে শুরু করে স্কুলে আসার জন্য। দূর-দূরান্তের ছাত্ররা এসে দলে দলে ভর্তি হতে শুরু করে সমদেকাঠি হাইস্কুলে। স্কুল ভরে ওঠে কানায় কানায়। জুয়েল আইচ গড়ে তোলেন পাবলিক লাইব্রেরি। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও নতুন প্রাণের জোয়ার আসে চারদিকে। এলাকাবাসীর জোর দাবির মুখে মাত্র তিন বছরের মধ্যে তাকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে হয়। এরপর ভালোই চলছিল শিক্ষকতার পাশাপাশি ম্যাজিক নিয়ে জুয়েল আইচের পথচলা। এরমধ্যে হঠাৎই ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। এ প্রসঙ্গে জুয়েল আইচ বলেন, ১৯৭৭ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি একদল দুর্বৃত্ত আমার ম্যাজিকের সরঞ্জামাদি পুড়িয়ে দেয়। সেসময় আমি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিটুল করের বাড়িতে রিহার্সাল করতাম এবং জাদু নিয়ে গবেষণা ও পড়াশোনা করতাম। ওই বাড়িতেই থাকত আমার জাদুর সব সরঞ্জাম ও প্রদর্শনীর উপকরণ। নির্বাচন নিয়ে নিটুলের সঙ্গে স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার দ্বন্দ্ব বাধে। একপর্যায়ে রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা ওই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় নিটুল করের বাড়িঘরসহ আসবাবপত্র। এর সঙ্গে রেহাই পায়নি আমার জাদুর সরঞ্জামও। ফলে দ্বিতীয় দফায় (প্রথমবার মুক্তিযুদ্ধের সময়) আবার নিঃস্ব হই আমি। জুয়েল আইচ জানান, এরপর তিনি স্কুল শিক্ষকতার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আবার ম্যাজিকের সরঞ্জাম নতুনভাবে তৈরি করার কাজে মনোযোগী হন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের আহ্বানে আবার ফিরে আসেন ঢাকায়। এ দেশের জাদুশিল্পের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে জাদুবিদ্যার সূতিকাগার হিসেবে চেনে। তাই তিনি জাদুশিল্পের পুনঃজাগরণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুরু করেন নিরলস সাধনা। তিনি শুধু একজন বিশ্ববিজয়ী জাদুশিল্পীই হতে চাননি। আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জাদুর পুনঃজাগরণ চেয়েছেন। একদিকে জাদুর শৈল্পিক উৎকর্ষের জন্য কাজ করেছেন, অন্যদিকে গণচেতনা জাগানোর জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। আর এভাবেই ক্রমশ তিনি তার চমক আর ব্যতিক্রমী বিস্ময়ে ভরপুর সব ম্যাজিকের খেলা নিয়ে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বময় নিজেকে এবং দেশকে পরিচিত ও জনপ্রিয় করে তুলতে শুরু করেন। ১৯৮০ সালে ‘সোসাইটি অব আমেরিকান ম্যাজিশিয়ানস’ তাদের আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে তাকে আমন্ত্রণ জানায় সদলবলে জাদু প্রদর্শনের জন্য। ১৯৮১ সালের ২৮শে জুন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে যাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হয় জাদুর মাধ্যমে তার বিশ্বজয়ের পথচলা। ওই বছর ৪ঠা জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে অনুষ্ঠিত হয় বিদেশের মাটিতে জুয়েল আইচের প্রথম অনুষ্ঠান। আর এ প্রথম অনুষ্ঠানেই বাজিমাত করেন তিনি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ম্যাজিশিয়ান হিসেবে জুয়েল আইচ অসংখ্য দেশে ভ্রমণ করেছেন। সবখানেই তিনি জয় করে নিয়েছেন লাখো মানুষের হৃদয়। বিশ্বের যে জায়গাতেই তিনি একবার তার মন কেড়ে নেয়া জাদু প্রদর্শন করেছেন, সেখান থেকেই আবার শো করার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন। তিনি অসংখ্যবার আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, আরব আমিরাত, কুয়েত, উত্তর কোরিয়া, কাতার, থাইল্যান্ড, বাহরাইন, ইরাক, সুইডেন, ভারত, নেপালসহ আরো বহু দেশে বারবার জাদু প্রদর্শনী করেন এবং দেশের জন্য বয়ে আনেন বিরল সম্মান। তার স্ত্রী বিপাশা আইচ এবং একমাত্র কন্যাসন্তান খেয়া সহশিল্পী হিসেবে দেশ-বিদেশের মঞ্চে তার সঙ্গে পারফরম করে থাকেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রেষ্ঠ সব থিয়েটার এবং টেলিভিশন চ্যানেলে অসংখ্যবার সেসব দেশের দর্শকদের জাদু দেখিয়ে মুগ্ধ করেছেন জুয়েল আইচ। এর মধ্যে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ‘চ্যানেল ফোর’ দীর্ঘদিন ধরে তার জাদুর ধারাবাহিক অনুষ্ঠান ‘হিয়ার অ্যান্ড নাউ’ প্রচার করে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের পাশাপাশি দেশের সব টিভি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এ যাবৎ অসংখ্য অনুষ্ঠানে জাদু প্রদর্শন করেছেন তিনি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ঈদের বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘আনন্দমেলা’ উপস্থাপনা করে এ অনুষ্ঠানটিতে তিনি সংযোজন করেছেন নতুন ও ভিন্নমাত্রা। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাকে নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশ হয়েছে প্রশংসাসূচক অসংখ্য আর্টিকেল। দেশের অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হন। বাংলাদেশের প্রায় সব রাষ্ট্রপ্রধানই তার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে ম্যাজিকের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনেক রাষ্ট্রপ্রধান, মঞ্চে তার জাদু দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। অনেকে তাদের প্রাসাদে তাকে রাজকীয় ভোজে আপ্যায়ন করেছেন। উপহার দিয়েছেন অনেক মূল্যবান উপঢৌকন। জুয়েল আইচ বাংলাদেশের যোগ্যতম সাংস্কৃতিক দূত। তিনি  ইউনিসেফের একজন অ্যাডভোকেট হিসেবে শিশুদের পক্ষে জনমত ও সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে নিয়মিত কাজ করে থাকেন। এসবের পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখিও করেন জুয়েল আইচ। তার লেখা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ হয়। এ ছাড়া ‘অন্তরালের আমি’ নামে আত্মজীবনীমূলক একটি তথ্যবহুল সুখপাঠ্য বই লিখেছেন তিনি। জাদুশিল্পে আকাশছোঁয়া সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ কিংবদন্তি এ ম্যাজিশিয়ান এ পর্যন্ত দেশ-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। দেশে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক পেয়েছেন তিনি। একজন জাদুশিল্পী হিসেবে জুয়েল আইচ বরাবরই ব্যতিক্রমী পরিবেশনা করে থাকেন। যাতে থাকে বৈচিত্র্য ও নতুনত্বের ছোঁয়া। ১৯৮৬ সালের ২৬শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে সর্বসাধারণের সামনে খোলা মঞ্চে জাদু দেখানোর আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সেই জাদু প্রদর্শনী টিভিব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের ধারাবিবরণীতে কোনরকম সম্পাদনা না করে পুরোটাই বাংলাদেশ টেলিভিশনে সেদিনই দেখানো হয়েছিল। স্টেডিয়াম ঠাসা দর্শক ছাড়াও  টেলিভিশনের মাধ্যমে সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ বিশ্ববরেণ্য জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের জাদু দেখে বিমোহিত হয়েছিলেন। বিদেশের মাটিতেও এমন ব্যতিক্রমী অনেক ঘটনা রয়েছে জুয়েল আইচকে ঘিরে। তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল লন্ডনে ১৯৮৮ সালের ১৮ই আগস্ট। একদল সাংবাদিক এবং পাঁচ শতাধিক দর্শকের সামনে বিশ্বনন্দিত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের চোখে প্লাস্টার লাগিয়ে ভালো করে ডাক্তারি ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়। চোখ বন্ধ অবস্থায় তিনি লুকিয়ে রাখা গাড়ির চাবি খুঁজে বের করেন। এর পরে অসংখ্য গাড়ির মধ্য থেকে তার জন্য রাখা নির্দিষ্ট গাড়িটি খুঁজে বের করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে চোখ প্লাস্টার এবং ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা অবস্থায়ই গাড়িটি নিয়ে লন্ডনের রাস্তায় বের হয়ে যান। হাজার হাজার মানুষকে অবাক করে দিয়ে সব ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে লন্ডন শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলো ঘোরেন। অবশেষে আগের জায়গায় ফিরে আসেন। যে ডাক্তাররা তার চোখে ব্যান্ডেজ করেছিলেন তারা ভালোভাবে পরীক্ষা করে বলেন, আমরা যেভাবে তার চোখ বেঁধে দিয়েছিলাম, তা ঠিক তেমনি আছে। এ অবস্থায় একজন মানুষের পক্ষে কিছুই দেখা সম্ভব নয়। মেন্টালিজমে দারুণ দক্ষ জুয়েল আইচ। ১৯৯৬ সালের ঘটনা। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জ্বরে কাঁপছে সারা বিশ্ব। চারদিকে তুমুল উত্তেজনা। কারা যাবে ফাইনালে, কারা হবে চ্যাম্পিয়ন। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনার শেষ নেই। মানুষের চাপে পড়ে জুয়েল আইচ বাধ্য হলেন ফাইনালের সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে। ঢাকা  প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জ সেদিন কানায় কানায় পূর্ণ। বিশিষ্ট সাংবাদিকদের সামনে জুয়েল আইচ ফাইনালের বেশ আগে তার ভবিষ্যদ্বাণী লিখলেন। কারা চ্যাম্পিয়ন হতে পারে শুধু তা-ই তিনি লিখলেন না, কত উইকেটে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা অথবা কত রানে তাও লিখলেন। লিখলেন কার সেঞ্চুরি করার সম্ভাবনা, কার ভাগ্যে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, কার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়ার সম্ভাবনা, সবই তিনি আগাম লিখে দিলেন। ফাইনাল খেলা হওয়ার পরে দেখা গেল তার ভবিষ্যদ্বাণী শতকরা প্রায় একশ’ ভাগ মিলে গেছে। জাদু দুনিয়ার জীবন্ত কিংবদন্তি জুয়েল আইচের জন্ম ১৯৫২ সালের ১০ই এপ্রিল, বরিশালে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার সমদেকাঠি গ্রামে। তার পিতা বি কে আইচ ছিলেন ব্যবসায়ী আর মাতা সরযূ আইচ ছিলেন গৃহিণী। জুয়েল আইচের সাহসী ভূমিকায় জাদু এখন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং  রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত শিল্প। এর মাধ্যমে অসামপ্রদায়িক চেতনা, দেশপ্রেম, প্রকৃতি প্রেম, মানব সেবা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, সমকালীন সমস্যা সমাধানে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন তিনি। শিক্ষামূলক ম্যাজিকের ধাঁধা, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, নারীর ওপর অবিচার, ড্রাগ থেকে মুক্তিসহ অগণিত বিষয়কে উপজীব্য করে জাদু প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বিনোদনের পাশাপাশি বিশ্বনন্দিত জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ মানুষকে সচেতন করে চলেছেন নিয়মিত।
সূত্র- মানবজমিন ঈদ আনন্দ ২০১৭

No comments

Powered by Blogger.