সাগরদাঁড়ি থেকে ভার্সাই by পার্থপ্রতিম মজুমদার

মানুষের তৈরি চার্চের আমি ধার ধারিনে। আমি আমার স্রষ্টার কাছে ফিরে যাচ্ছি। তিনিই আমাকে তাঁর সর্বোত্তম বিশ্রাম- স্থলে লুকিয়ে রাখবেন। আপনারা যেখানে খুশি আমাকে সমাধিস্ত করতে পারেন- আপনাদের দরজার সামনে অথবা কোনো গাছতলায়। আমার কঙ্কালগুলোর শান্তি কেউ যেন ভঙ্গ না-করে। আমার কবরের ওপর যেন গজিয়ে ওঠে সবুজ ঘাস।
-মাইকেল মধুসূদন দত্ত
‘যে দেশে একজন সুকবি জন্মে,
সে দেশের সৌভাগ্য যে দেশে
সুকবি যশঃ প্রাপ্ত হয়, সে দেশের
আরও সৌভাগ্য। ...যে দেশের
শ্রেষ্ঠ কবি যশস্বী হইয়া জীবন
সমাপন করেন, সে দেশ প্রকৃত
উন্নতির পথে দাঁড়াইয়াছ।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে যশস্বী
হইয়া মরিয়াছেন, ইহাতে বোঝা যায়
যে, বাঙ্গালা দেশ উন্নতির পথে
দাঁড়াইয়াছে’।...
- সাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
এই ক্ষণজন্মা মহাকবির (১৮২৪-১৮৭৩) জন্ম হয়েছিল আমাদেরই এই বাংলাদেশের কেশবপুর থানার অন্তর্গত যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে ২৫শে জানুয়ারি ১৮২৪ সালে। বাবা রাজ নারায়ণ দত্ত সেকালের রীতি অনুযায়ী ফার্সি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। কলকাতার সদর দেওয়ানী আদালতের ব্যবহারজীবীরূপে তিনি প্রভূত প্রতিষ্ঠা ও অর্থ উপার্জন করেছিলেন। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য কলকাতায় যখন পরিবার নিয়ে যান, কবির বয়স তখন মাত্র সাত বছর। নিজ গ্রাম সাগরদাঁড়িতে মা জাহ্নবী দেবীর তত্ত্বাবধানে তার শিক্ষা জীবনের শুরু। রামায়ণ মহাভারতের প্রতি আকর্ষণের বীজ সম্ভবত এই সূত্রেই তাঁর মনের কোণে সারা জীবন প্রজ্বলিত ছিল। এই ছোট্ট বয়সে তিনি ফার্সি ভাষার চর্চাও শুরু করেছিলেন। মাত্র সাত বছর বয়সে গ্রামছাড়া হলেও নিজের শিকড়ের প্রতি তাঁর আন্তরিক আকর্ষণ সারা জীবন তাঁর মধ্যে টিকে ছিল। তাঁর সাহিত্য এবং তাঁর জীবনের নানা ঘটনা বিশ্লেষণ করলে নিজের উৎসের প্রতি তাঁর এই দরদ কত আন্তরিক এবং শক্ত ছিল, নির্ভুলভাবে তা বোঝা যায়। সাগরদাঁড়ি থেকে চলে যাবার তেত্রিশ বছর পরেও ছয় হাজার মাইল দূরে বসেও তিনি তাঁর শৈশবের গ্রামের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করেছেন, বাল্য এবং কৈশোর কালে তাঁর মনে বিশেষ করে যা গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল, তা হলো গ্রামবাংলার নিসর্গ। যেসব সনেটে মাইকেল তাঁর বাল্যের লীলাক্ষেত্র ফেলে আসা সাগরদাঁড়ির স্বপ্ন দেখেছেন অথবা স্মরণ করেছেন স্বদেশের কথা, সেসব সনেটেই তাঁর ভাবাবেগ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। ‘কপোতাক্ষ নদ’ এই প্রসঙ্গে সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এ নদকে তিনি সতত মনে করেছেন এবং বিরলে বসে সতত এর কথা ভেবেছেন। তাঁর চেতনা এবং অবচেতনায় এই নদ, বস্তুত একাকার হয়ে গিয়েছিল। এই আন্তরিকতা এবং গভীরতা পাঠককে নাড়া না দিয়ে পারে না।
সতত (যেমনি লোক নিশার স্বপনে শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির চলনে।...
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতরূপী তুমি জন্মভূমি স্তনে।...
এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে...
এবার ভাবুন এই মানুষটি ১৮৬৩ সালের মাঝামাঝি সপরিবারে প্রায় শূন্য হস্তে ভার্সাই শহরের একটু গরিব এলাকায় অবস্থিত ১২নং রু দ্য-এতা জেনেরো (12  rue des Etals-Generaxu) আগের নাম মানে সে সময়ে এই রাস্তার নাম ছিল পাশের রেল স্টেশনের নাম অনুসারে 12 rue des Chantiers-এর দোতালার তিন কুঠুরির খুবই ছোট এপার্টমেন্টে যিনি কোনদিন টাকা গুনে খরচ করেননি তাঁকে প্রতিটি পয়সা গুনে গুনে চিন্তা করে খরচ করতে হচ্ছে। আমি ১৯৮২ সালে এই ফ্ল্যাটে গিয়েছি ঘরগুলো এত ছোট ভাবা যায় না। টয়লেট ছাড়া কোনো স্নানের ঘর আমার চোখে পড়েনি। রান্নার জায়গাটি এত ছোট যে দুজন এক সাথে দাঁড়ানো যায় না। তখন ওই ফ্ল্যাটের মালিক ছিলেন গ্রেগোরী নামের একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার। উনি আমার পরিচয় পেয়ে ও আমাদের এক মহাকবি এক সময় ১৮৬৩-১৮৬৫ এই ফ্ল্যাটে বাস করে গেছেন শুনে প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, ‘আমার স্ত্রীর বাচ্চা হবে তাই এটা আমাদের জন্য খুবই ছোট হয়ে যাচ্ছে তাই পুরো ফ্ল্যাটটা ঢেলে সাজিয়ে রং করে বিক্রি করবো, আপনি ইচ্ছা করলে কিনে নিতে পারেন অথবা আপনাদের দূতাবাসকে কিনতে বলতে পারেন’। হায় তখনতো আমি সদ্য এসেছি ছাত্র হিসেবে। উনি জানালেন ও পুরোনো কাগজপত্র দেখালেন ১৯০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৭ জন মালিক বদল হয়েছে। তার আগে কারা মালিক ছিলেন উনি জানেন না। গ্রেগোরী রাস্তার দিকের জানালার কাছে নিয়ে রাস্তার অপর পাড়ের বাড়িটি দেখিয়ে এবং তার বাইরের একটি স্মৃতিফলক দেখিয়ে বললেন, ‘ওপাশের বাড়িটি কি জানেন’? ওনার কাছেই প্রথম শুনলাম ১৭৮৯ এর ৫ই মে থেকে ১৫ই অক্টোবরের মধ্যে সামনের ওই বাড়িতে সারা ফ্রান্সের সর্বশ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্বকারীদের নিয়ে যেমন ধর্মযাজক, সাহিত্যিক ও সাধারণ মানুষ এদের নিয়ে ফ্রান্সের প্রথম সংবিধান রচনা করা হয়েছিল। এটা ফ্রান্সের ঐতিহাসিক স্থান।
কবি ১৮৬২ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে ইংল্যান্ড এসেছিলেন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ‘গ্রেজ-ইন’-এ যোগ দিয়েছিলেন, পরিবার তখন রেখে এসেছিলেন কলকাতায়। এক বছরও পূর্ণ হয়নি ১৮৬৩ সালের ২রা মে স্ত্রী হেনরিয়েটা সন্তানসহ ইংল্যান্ড চলে আসেন। কারণ যাদের ওপর তিনি বিষয় সম্পত্তির দায়িত্ব দিয়ে ইংল্যান্ডের পড়ার খরচ পাঠাবার ও পারিবারিক মাসিক টাকা দেয়ার ব্যবস্থা করে এসেছিলেন, তারা সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। কোনোভাবে ইংল্যান্ড আসার ভাড়া জোগাড় করে সন্তানসহ হেনরিয়েটা ইউরোপ এসে পৌঁছান। অর্থাভাবে মধুসূদন চরম বিপদে পড়লেন। বন্ধু-বান্ধবদের বহু চিঠি লিখেও কোনো ফল পাওয়া গেল না। ১৮৬৩ সালের মধ্যভাগে ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে কিছু কম খরচে জীবন সংগ্রাম চালাতে পারবেন ভেবে চলে আসেন। শোনা যায় প্রথম কিছুদিন প্যারিস শহরে ছিলেন (যার আজ পর্যন্ত কোনো সত্যতার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি), সেখানে অতিরিক্ত খরচ বিধায় ভার্সাই শহরে আগমন। ভার্সাই শহরের এই বাসাতে কেটেছে তাঁর জীবনের চরম দুঃখের দিনগুলো। অচেনা পরিবেশে কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারেননি অথবা হয়তো সম্মানে লাগবে ভেবে চেষ্টাও করেননি। সামান্য টাকা-পয়সা তখনো হাতে যা ছিল তা দিয়ে যাতে সবচেয়ে বেশি সময় টিকে থাকা যায়, তার জন্য তিনি অথবা হেনরিয়েটা চেষ্টার কোনো কসুর করেননি। জীবিকা নির্বাহের জন্য স্ত্রীর অলঙ্কার, গৃহসজ্জার উপকরণ এবং পুস্তকাদি বন্ধক বা বিক্রি করে চলতে হয়েছিল। এ সময় আশেপাশের মানুষের কাছে প্রচুর ঋণও জমে গিয়েছিল। বহু মাসের বাসা ভাড়া বাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানে বহু টাকা বাকি- পাগলপ্রায় অবস্থা ঋণের দায়ে একবার জেলে পর্যন্ত যাবার উপক্রম হয়েছিল সে সময় সুন্দরী এক ফরাসিনী তাঁকে জেলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচান। চাতক পাখির মতো প্রতিদিন ডাকের অপেক্ষা করতেন কলকাতা থেকে কখন তার প্রাপ্য টাকা এসে পৌঁছাবে। অথবা দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর কখন তাঁকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে অর্থ পাঠাবেন তার অপেক্ষায় বুকভরা আশা নিয়ে দিন গুনতেন। আর এ সময় তিনি প্রায় প্রতিদিনই তাঁর পাওনাদারদের কাছে এবং বিপদের দিনের গ্রেটবন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে চিঠি লিখতেন। তাঁর মত্তো এত্তো বড় অসাধারণ কবি ও বড়লোক বাড়ির ছেলে হয়ে (যিনি গুনে কোনোদিন টাকা কাউকে দেননি) এ সময়ে যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন তা ভাবলে আজও আমরা অবাক হই। দেনার দায়ে যখন নাভিশ্বাস উঠেছে একদিন রাগ করে বিদ্যাসাগরকে চিঠি লিখেছিলেন ‘কোনোভাবে টাকা জোগাড় করে আমি কলকাতা পৌঁছোবো, তারপর যারা আমার ন্যায্য টাকা দেয়নি তাদের একজন একজনকে খুন করে প্রয়োজনে ফাঁসিতে ঝুলবো’। এত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও তাঁর প্রতিভা থেমে থাকেনি। ভার্সাইতে অনাহার এবং অর্ধাহারের মধ্যেও নতুন ভাষা শিক্ষার অথবা সাহিত্যচর্চার উৎসাহ কখনোই তিনি হারাননি। ভার্সাই থাকাকালীন তাঁর জীবনের একটি মুখ্য রচনা ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’। তিনি এখানে বেশ কিছু সনেটও রচনা করেন। যা ইটালিয়ান সনেট থেকে অনুপ্রাণিত এবং নীতিগর্ভ কিছু কবিতাও রচনা করেন যা ফরাসি সাহিত্য ও কবিতা থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া। লেখার সাথে সাথে তা কলকাতায় পাঠিয়ে দিতেন ছাপার জন্য। নীতিগর্ভ কাব্যের প্রথম তিনটি কবিতা, চতুর্দশপদী কবিতাবলীর সমকালে রচিত। ফরাসি বিখ্যাত কবি জঁ-দে লা ফঁতেন (১৬২১-৯৫)-এর ্তুঞযব ঋধনষবং ড়ভ খধ ঋড়হঃধরহব্থ কবিতার আদর্শে এগুলি সে সময় ভার্সাইতে রচনা। ভার্সাইয়ে বসবাসকালে ইটালিয়ান বিখ্যাত কবি দান্তের ষষ্ঠ জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে একটি সনেট রচনা করে ইটালীয় ও ফরাসি নিজকৃত অনুবাদসহ ইটালির রাজা ভিক্টর ইমানুয়েলের কাছে পাঠিয়ে দেন। আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির ঐক্যের দিক থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর কবির এই প্রচেষ্টা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
‘কবিগুরু দান্তে’
নিশান্তে সুবর্ণ-কান্তি নক্ষত্র যেমতি
(তপনের অনুচর) সুচারু কিরণে
খেদায় তিমির-পুঞ্জে; হে কবি, তেমতি
প্রভা তব বিনাশিল মানস-ভুবনে
অজ্ঞান! জনম তব পরম সুক্ষনে।
নব কবি-কুল-পিতা তুমি, মহামতি,
ব্রহ্মাণ্ডের এ সুখণ্ডে। তোমার সেবনে
পরিহারি নিদ্রা পুনঃ জাগিলা ভারতী।
দেবীর প্রসাদে তুমি পশিলা সাহসে
সে বিষম দ্বার দিয়া আঁধার নরকে,
যে বিষম দ্বার দিয়া, ত্যজি আশা, পশে
পাপ প্রাণ, তুমি, সাধু, পশিনা পুলকে।
যশের আকাশ হতে কভু কি হে খসে
এ নক্ষত্র? কোন্‌ কীট কাটে এ কোরকে?
সনেট রচনায় তিনি গুরু মেনেছিলেন ইটালিয়ান পণ্ডিত কবি পেত্রার্কাকে (১৩০৪-১৩৭৪)। তাঁদের উভয়ের চরিত্রের মধ্যে মিল ছিল অনেক। পেত্রার্কা যেমন তার প্রেমিকাকে নিয়ে লেখা তাঁর কবিতায় রোম্যান্টিকতার ছড়াছড়ি করতেন-কিন্তু নিজে বিচরণ করতেন ধ্রুপদী সাহিত্যের জগতে। মাইকেলও ছিলেন হুবহু একই রকমের। মনে প্রাণে রোমান্টিক হওয়া সত্ত্বেও, তিনিও সারাক্ষণ চর্চা করতেন ধ্রুপদী ভাষা এবং সাহিত্য। সমকালীন ফরাসি কবি ভিক্টর হুগো এবং ইংরেজ কবি অ্যালফ্রেড টেনিসনকে উদ্দেশ্য করেও মাইকেল দুটি সনেট লিখেছিলেন। কারো কারো মনে হতে পারে যে, তিনি বোধ হয় এ দু’জন কবির ভক্ত ছিলেন অথবা তাঁদের কাব্য দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন (ভক্ত) সেটা আদপেই ঠিক নয়। ভিক্টর হুগো আর টেনিসন ছিলেন সে সময়কার যথাক্রমে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত কবি। ১৮৬৫ সালে এঁদের বয়স ছিল যথাক্রমে ৬৩ এবং ৫৬। ফ্রান্সের রোমান্টিক কাব্য আন্দোলনের প্রধান নায়ক হিসেবে ভিক্টর হুগোর নাম অবিস্মরণীয়। ঔপন্যাসিক এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধী রাজনীতিক হিসেবেও তাঁর নাম কম ছিল না। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা ধারার দরুণ তাঁকে দু’দশকের জন্য স্বেচ্ছা নির্বাসন নিতে হয়েছিল। মাইকেল তাঁকে নিয়ে সনেট রচনা করার পনেরো বছর আগে রাজকবি হিসেবে তিনি শিরোপা লাভ করেছিলেন। রাজকবিদের মাইকেল দেখতেন বিশেষ ঈর্ষা ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে। নিজেও কবি হবার স্বপ্ন দেখেছেন- বোধ হয় সারা জীবন।
বছর ঘুরতেই ১৮৬৪ সালের ৩রা আগস্ট মাইকেল মধুসূদন দত্তর স্ত্রী এমিলি হেনরিয়েটা সোফি হোয়াইট (২৭) এই বাড়িতেই একটি মৃত কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। মাইকেলের বয়স তখন তেত্রিশ।
এরপরের ঘটনা সবারই জানা। দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন সংগ্রহ বা টাকা আদায় করতে পেরেছেন সেই টাকা সাথে সাথে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে ভার্সাইয়ের ঠিকানায় ডাকযোগে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যেমন টাকা পৌঁছেছে দেনা শোধ করতে গিয়ে তা সাথে সাথেই শেষ হয়ে গিয়েছে। ‘গ্রেজ ইন এ’ যোগ দেবার মতো টাকা পাবার অপেক্ষা তাঁকে নিদারুণ দরিদ্রতার মধ্যে প্রায় দু’বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। অবশেষে বিদ্যাসাগরের পাঠানো বেশকিছু টাকা এক সাথে এসে পৌঁছলে ভার্সাই রাজবাড়ীর গা ঘেঁষে বনেদি পাড়ায় বাসা ভাড়া করে স্ত্রী সন্তানদের রেখে তিনি বিপদমুক্ত হতে আবার ‘গ্রেজ-ইনে’ যোগ দিতে ইংল্যান্ডের পথে পাড়ি জমান। ভার্সাই থাকাকালীন আরো কিছু কাহিনী কাব্য লিখতে শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষ করতে পারেননি। কবির পরিবার ভার্সাই থেকে যাবার কারণ হচ্ছে, কবির ইচ্ছা ছিল পুত্র-কন্যাদের ইউরোপীয় শিক্ষাদানে গড়ে তোলার। কবি সমন্ধে তাঁর এক জীবনীকার ক্ষেত্রগুপ্ত লিখেছেন, ‘যে ব্যক্তি একই সঙ্গে ক্ষুণ্নিবৃত্তির জন্য কাতর এবং সন্তানদের ইউরোপীয় শিক্ষা দিতে সংকল্পবদ্ধ, ঋণের দায়ে জেলে যেতে যেতে ফরাসি, ইটালীয় ও জার্মান ভাষা শিক্ষায় একাগ্রচিত্ত তাঁকে হয় পাগল না হয় প্রতিভাবান বলে ধরে নিতে হবে এবং পণ্ডিতদের মতে এ দুয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য আছে’। ইউরোপীয় সভ্যতাকে শুধু সাহিত্যিক আদর্শের মধ্যে নয়, জীবনাদর্শের মধ্যে কবি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন।
রাজবাড়ী ঘেঁষা নতুন বনেদি পাড়ার ফ্ল্যাটে ৬ rue Maurepase ২৬শে আগস্ট ১৮৬৭ ভোর চারটায় মাইকেল হেনরিয়েটার তৃতীয় পুত্র সন্তান আলবার্ট জর্জ নেপোলিয়ানের জন্ম হয়। সে সময় রাজপরিবার বা নেপোলিয়ান প্রবর্ত্তিত ফরাসিদের রাষ্ট্রসম্মান ‘শেভালিয়ে দ্য লা লিজিঁওনার’ প্রাপ্ত ডা. লুইস জুলিয়ান পারনার (৪৭) ও বাড়ির মালিক আনাবেল নিকোলা কারে (৬৯) উপস্থিত ছিলেন।
কবির ভার্সাইয়ের অবস্থান দীর্ঘ নয়। তার চিঠিপত্র থেকে জানা যায়, তার স্বপ্নের দেশ ছিল ইংল্যান্ড-
And oh! I Sigh for
Albion&_s Strond
As if She were my native land
যতই তিনি সাহেব সাজবার চেষ্টা করুন বার বার তিনি ফিরে গেছেন জ্ঞানে-অজ্ঞানে তাঁর আদি জন্মভূমি সাগরদাঁড়ি (কেশবপুর, যশোর) গ্রামে। তাইতো দেখি প্রবাসে বসেও তিনি লেখেন-
রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে
সাধিতে মনের সাদ    ঘটে যদি পরমাদ
মধুহীন করো না গো তব মনঃ কোকনদে।
প্রবাসে, দৈবের বসে,    জীব-তারা যদি খসে
এ দেহ-আকাশ হতে, -নাহি খেদ তাহে।
জন্মিলে মরিতে হবে    অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায়রে, জীবন-নদে?
কিন্তু যদি রাখ মনে,    নাহি, মা ডরি সমনে;
মক্ষিকাও গলে না গো, পড়িলে অমৃত হ্রদে।
লেখক : বিশ্বনন্দিত মুকাভিনয় শিল্পী। ফ্রান্স প্রবাসী
সূত্র- মানবজমিন ঈদ আনন্দ ২০১৭

No comments

Powered by Blogger.