বাংলাদেশে প্রয়োজন আরেক নজরুল
আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। সম্ভবত বাংলাদেশেই গুণীজনের জন্ম ও মৃত্যু দিবস নিয়ে এত উৎসাহ। সেই গুণীজন যদি জাতীয় জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যান, মানুষের মনোজগৎকে আচ্ছন্ন করে রাখেন, তাহলে উৎসাহের মাত্রা অবশ্য আরও গতিশীল হয়। যেমনটি ঘটেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে। একজন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, অন্যজন জাতীয় কবি। আমাদের প্রজন্মের কেউ রবীন্দ্রনাথকে জীবিত এবং নজরুলকে সুস্থ দেখেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে আমাদের কাছে কাজী নজরুল ইসলামের জীবনও ছিল ছবিতে সীমাবদ্ধ, যদিও ততদিনে দেশের সচেতন মানুষের মনোজগতে নজরুলের একটা ছবি তৈরি হয়ে গেছে। যারা স্কুলে গেছে তারাই নজরুলের এক ধরনের ছবির সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। কখনও ঝাঁকড়া চুলওয়ালা, কখনও বাঁশরির বাঁশি হাতে, কখনও হাবিলদারের পোশাকে। মায়ের কাছে নজরুলের কথা শুনেছি। রাজনৈতিক কারণে নানার বাড়ি সন্দ্বীপে তিনি বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। নানা কমরেড মুজফফর আহমদের সঙ্গে বন্ধুত্বই তাকে সন্দ্বীপযাত্রী হতে উৎসাহ জোগায়। মা বলতেন কেমন করে ঝাঁকড়া চুলের ওই মানুষটি মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতেন; আর মা-খালারা তা অবাক বিস্ময়ে শুনতেন। এই বাড়িতে বসেই নজরুল লিখেছিলেন তার একটি বিখ্যাত কবিতা- বাতায়ন পাশে গবাক তরুর সারি। সন্দ্বীপের সঙ্গে যারা পরিচিত তারা জানেন সেখানে সুপারি আর নারিকেল গাছের ছড়াছড়ি।
সন্দ্বীপে অবশ্য আরও একটি গাছ জন্মায়- পুন্যাল, যার তেল একসময় ব্যবহৃত হতো বাতি জ্বালানোর জন্য। মায়ের মুখে শোনা নজরুলের সেই স্মৃতি এখনও মনে আছে, তবে নজরুলের মূল্যায়নের জন্য তা যথেষ্ট নয়। বাস্তব হলেও সত্য, এদেশের সুধী সমাজে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে আকুতি, নজরুলের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। হতে পারে নজরুল নিন্মবর্গের মানুষ হয়েও সৃজনশীলতার জগতে এক ভিন্ন পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথ জমিদার পরিবারের সন্তান- তাই এলিটদের কাছে তার মর্যাদা বেশি। রবীন্দ্রনাথ, না নজরুল- কে বড় এ বিতর্ক অর্থহীন। আজ যখন নজরুলের জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হবে তখন এই তুলনার প্রশ্ন সামনে আসবে না- আলোচিত হবে তার রাজনৈতিক বিশ্বাস, সাহিত্যকর্ম এবং টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে গীত হবে তার লেখা গান। কিন্তু নজরুলের সমাধি থেকে শুরু করে সর্বত্র কেমন যেন একটা দারিদ্র্যের ভাব স্পষ্ট- এই দারিদ্র্য অর্থনৈতিক নয়, প্রাণের উচ্ছ্বাসের। নজরুল যে সময় সচেতনভাবে নিয়মিত লিখতে শুরু করেন, ততদিনে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিজয় একটি প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে- সাহিত্য কি শুধুই সাহিত্য হবে, না এর মূলধারা হবে গণজীবনমুখী? নিজের শ্রেণী অবস্থান নজরুলকে গণজীবনমুখী সাহিত্যিক, গীতিকার ও লেখক হতে সাহায্য করেছিল। কমরেড মুজফফর আহমদের সঙ্গে উষ্ণ সখ্যের সেটিও একটি বড় কারণ। এরই ভিত্তিতে নজরুলের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখেন মুজফফর আহমদ-
কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে মুজফফর আহমদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। ধরতে গেলে কাজী নজরুল ইসলাম তারই আবিষ্কার।
নজরুল জীবনের ওপর লেখা তার বই ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ একখানি প্রামাণ্য গ্রন্থ। এই স্মৃতিকথা নিয়ে নজরুল বিশেষজ্ঞ জুলফিকার হায়দারের সঙ্গে তার মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। হায়দার সাহেব সম্পর্কে তিনি কিছু অশোভন মন্তব্যও করেছিলেন। সে প্রসঙ্গে তিনি আমার কাছে লিখেছিলেন- ‘‘হায়দার সাহেবের লেখাটা আমি দৈনিক পাকিস্তানে পড়েছি। তারাই একখানা কাগজ পাঠিয়েছিলেন। কথাটা হচ্ছে এই যে, আমি কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা নাম দিয়ে একখানা পুস্তক লিখেছি। পুস্তকখানা ছাপা হওয়ার পর পরই যুদ্ধ বেধে যায়। পাকিস্তানে বোধহয় পাঁচখানার বেশি বই যায়নি। এই পুস্তকের শেষভাগে আমি হায়দার সাহেবের লেখা নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য করেছি। ভাষা ভালো হলেও লেখায় সংকীর্ণতা ও সহিষ্ণুতা ফুটে উঠেছে। বড় সাম্প্রদায়িক মন তার। আমার সম্বন্ধেও ভুল তথ্য পরিবেশন করেছেন। ক’বছর তিনি সত্যিই নজরুলের অনেক সেবা করেছেন। তিনি নিজে সেটা ফলাও করে বলেন এবং চান যে অন্যরাও তাই করুন। আমার পুস্তকে তার সেবার স্বীকৃতি যথেষ্টই আছে। কিন্তু তার মন তাতে তরেনি।
কিন্তু আমার যে তার বেশি ভাষার জোর নেই। গোল বেধেছে আরও একটি ব্যাপার নিয়ে। নজরুলের গত জন্মদিনে কে বা কারা আমার লেখার হায়দার সাহেবের সম্পর্কিত অংশটি কপি করে পূর্ব পাকিস্তানের অনেকগুলো কাগজে ছেপে দিয়েছেন। আমি ঘুণাক্ষরেও তার কিছু জানতাম না। আমার তখন ৭৭ বছর বয়স। এত বড় লেখা কপি করে এতগুলো কাগজে পাঠাবার ধৈর্য আমি কোথায় পাব? আমি তার নাম বিকৃত করিনি। আরবি শব্দ জুলফিকারের অভিধানসম্মত উচ্চারণ করেছি আমি। নিজের নামের আগে নিজে কেউ সুফি লেখেন? এটা তার পারিবারিক পদবি নয়। আমি কি নিজের নামের আগে নিজে কমরেড লিখি। আমি আমাদের আন্দোলনের লোকদের কমরেড, বাইরের লোকের কমরেড আমি নই। আমি ‘দৈনিক পাকিস্তান’ কাগজে খানিকটা লিখে পাঠিয়েছি। আমি ভারতবর্ষের লোক। আমার লেখা পাকিস্তানের কাগজে ছাপানো সম্ভব কিনা জানিনে।’’ সমাজতন্ত্রের প্রভাব নজরুলের সৃষ্টিতে যতখানি, রবীন্দ্রনাথের লেখায় তত প্রতিফলিত হয়নি। নজরুল তার অনেক সৃষ্টিতেই একজন বিপ্লবীর মতোই কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও উপলব্ধি করেছিলেন তার লেখায় একটা অভাব ছিল। তাই তিনি লিখেছেন-
‘আমার কবিতা, জানি আমি,
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।
কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির লাগি কান পেতে আছি।’ নজরুল এদেশের মানুষের কথা বুঝতে পেরেছিলেন অনেক তীব্র অনুভব দিয়ে। যারা ধর্ম বিশ্বাসে রক্ষণশীল, রাজনীতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং অর্থনীতিতে শোষকের দালাল, তাদের ভূমিকা নজরুলকে আহত করেছে সন্দেহ নেই। তাই তিনি লিখেছেন-
‘ওগো জ্ঞানী, ওগো শিল্পী, লেখক, কবি,
তোমরা দেখেছ উর্দ্ধের শশী রবি।
তোমরা বিবিধ সুন্দর সৃষ্টিতে রেখেছ ধরিয়া রসায়িত মন ঘিরে।
তোমাদের এই জ্ঞানের প্রদীপমালা
করে না ক কেন কাঙ্গালের ঘর আলো।’ নজরুল বিশ্বাস করতেন যারা বুদ্ধিজীবী তারা কখনও সৈনিক হবে না, তারা কখনও কল্যাণ আনেনি, তারা বুদ্ধির প্রভু। বিভিন্ন বিশ্লেষক নজরুলকে ব্যাখ্যা করেছেন তার নিজস্ব বিশ্বাস দিয়ে। কিন্তু একজন আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবর্জিত মানুষের লেখায় শব্দের যে বৈচিত্র্য, কথার যে ব্যঞ্জনা আছে তা বাংলা ভাষায় অন্য কারও লেখায় আছে কিনা সন্দেহ। তবু বলতে হয়, জন্মদিনে ও মৃত্যুদিনে নজরুলকে নিয়ে ভাবাবেগই বেশি, সঠিকভাবে বিচার বিশ্লেষণের প্রয়াস কম। সৃজনশীল কর্ম যে মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পারে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সেটা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনো সৃজনশীলতা মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পারেনি। নজরুলকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এই সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়। এই উপমহাদেশে সাহিত্য কর্মের জন্য মাত্র একজন মানুষ জেল খেটেছেন- কাজী নজরুল ইসলাম। তিনিই শাসকের রক্তচক্ষুকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন। আজ বাংলাদেশে এমন একজন নজরুল প্রয়োজন, যিনি মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে মানুষের মনকে ছুয়ে যাবেন- পথ দেখাবেন অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের।
মাহফুজ উল্লাহ : শিক্ষক ও সাংবাদিক
‘আমার কবিতা, জানি আমি,
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।
কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির লাগি কান পেতে আছি।’ নজরুল এদেশের মানুষের কথা বুঝতে পেরেছিলেন অনেক তীব্র অনুভব দিয়ে। যারা ধর্ম বিশ্বাসে রক্ষণশীল, রাজনীতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং অর্থনীতিতে শোষকের দালাল, তাদের ভূমিকা নজরুলকে আহত করেছে সন্দেহ নেই। তাই তিনি লিখেছেন-
‘ওগো জ্ঞানী, ওগো শিল্পী, লেখক, কবি,
তোমরা দেখেছ উর্দ্ধের শশী রবি।
তোমরা বিবিধ সুন্দর সৃষ্টিতে রেখেছ ধরিয়া রসায়িত মন ঘিরে।
তোমাদের এই জ্ঞানের প্রদীপমালা
করে না ক কেন কাঙ্গালের ঘর আলো।’ নজরুল বিশ্বাস করতেন যারা বুদ্ধিজীবী তারা কখনও সৈনিক হবে না, তারা কখনও কল্যাণ আনেনি, তারা বুদ্ধির প্রভু। বিভিন্ন বিশ্লেষক নজরুলকে ব্যাখ্যা করেছেন তার নিজস্ব বিশ্বাস দিয়ে। কিন্তু একজন আনুষ্ঠানিক শিক্ষাবর্জিত মানুষের লেখায় শব্দের যে বৈচিত্র্য, কথার যে ব্যঞ্জনা আছে তা বাংলা ভাষায় অন্য কারও লেখায় আছে কিনা সন্দেহ। তবু বলতে হয়, জন্মদিনে ও মৃত্যুদিনে নজরুলকে নিয়ে ভাবাবেগই বেশি, সঠিকভাবে বিচার বিশ্লেষণের প্রয়াস কম। সৃজনশীল কর্ম যে মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পারে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সেটা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনো সৃজনশীলতা মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে পারেনি। নজরুলকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এই সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়। এই উপমহাদেশে সাহিত্য কর্মের জন্য মাত্র একজন মানুষ জেল খেটেছেন- কাজী নজরুল ইসলাম। তিনিই শাসকের রক্তচক্ষুকে চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন। আজ বাংলাদেশে এমন একজন নজরুল প্রয়োজন, যিনি মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে মানুষের মনকে ছুয়ে যাবেন- পথ দেখাবেন অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের।
মাহফুজ উল্লাহ : শিক্ষক ও সাংবাদিক
No comments