মনের আলোয় পাহাড় ডিঙিয়ে চিঠি বিলান তিনি

চিঠি বিলির জন্য জেগে ওঠেন সাতসকালেই। গায়ে জড়িয়ে নেন উষ্ণ সোয়েটার বা শাল। এরপরই তিনি লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়েন। গ্রামের শেষ বাড়িটিতে পৌঁছে দেন চিঠি। এ জন্য তাঁকে পাহাড় ডিঙিয়ে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। আর এ কাজটি অন্ধ একজন মানুষ করছেন ৪৪ বছর ধরেই। ওই ডাকপিয়নের নাম মুহাম্মেদ আনোয়ার।
পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের হরিপুর জেলার দূরবর্তী একটি গ্রামের আনোয়ারকে এলাকার লোক হাফিজ সাহেব বলে ডাকেন। তাঁর কাহিনি বর্ণনা হয়েছে দেশটির ডন পত্রিকায়। তারিক হাবিবের ওই প্রতিবেদন পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো: আনোয়ার সতর্কতার সঙ্গে নুড়ি পাথরের পথ অতিক্রম করে চলেন। চলার পথটি তাঁর ভালোমতো চেনা। গ্রামের মানুষও তাঁর চলার পথের সঙ্গী হন। কেউ কেউ হাত ধরে আন্তরিকভাবে কথা বলেন। কুশলাদি জানতে চান। শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় কণ্ঠস্বর শুনেই বলে দিতে পারেন তাঁর নাম-পরিচয়। আনোয়ার জন্মান্ধ। তাঁর মা ও ভাইবোন অন্ধ। বাবার মৃত্যুর পরই পরিবারের হাল ধরতে হয় আনোয়ারকে। জীবনের শুরুর দিকের কথা স্মরণ করে আনোয়ার বলেন, ‘আমার মা, ভাই, বোন, আমিসহ পরিবারের চারজন অন্ধ ছিলাম। খুব ছোটবেলায় কাজের খোঁজে বের হতে হয় আমাকে। ছোটবেলায় আমি আংশিকভাবে অন্ধ ছিলাম। একপর্যায়ে আর কিছু দেখতেই পাই না।’ নিজের বিয়ের কথা উল্লেখ করে আনোয়ার বলেন, ‘আমার স্ত্রী অন্ধ ছিলেন না। আল্লাহ আমাদের চারটি সন্তান দিয়েছেন, তিন মেয়ে ও এক ছেলে। ডাকপিয়নের এই চাকরি আমার জন্য আশীর্বাদ ছিল, কারণ আমি এতে আমার সংসার চালাতে পারছি।’
আনোয়ারের ভাই মারা গেছেন। ভাইয়ের সন্তানদেরও দেখতে হয় তাঁকে। আনোয়ার ওই এলাকায় দুটি ডাকঘরের কাজ করেন। তিনি অন্ধ হয়েও এ কাজ অনায়াসে করেন। চিঠি বিলির পর গ্রামবাসী প্রায়ই আনোয়ারকে চা খাওয়ার জন্য দাওয়াত দেন। পাকিস্তানের প্রত্যন্ত এলাকার এই ডাকপিয়ন বলেন, ‘১৯৭৩ সালে মাসে ৫৫ রুপি বেতনে ডাকপিয়নের এই কাজ পেয়েছিলাম। এ অর্থে ওই সময় আমার পরিবারের সদস্যদের দৈনিক খাদ্য জোগাড় হতো।’ তিনি আরও বলেন, ‘৪৪ বছর ধরে আমি ওই এলাকার ডাক অফিসের অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করছি। আমার কাজ হলো মানুষের কাছে চিঠি ও অন্যান্য কাগজপত্র পৌঁছে দেওয়া এবং এক ডাক অফিস থেকে অন্য ডাক অফিসে চিঠি পৌঁছে দেওয়া। এখন প্রতি মাসে আমি বেতন হিসেবে পাই ১ হাজার ৪০ রুপি। এই এলাকায় অতীতে রাস্তা বা গাড়ি ছিল না। এমনকি এখনো নেই। আমি এখনো হেঁটেই চিঠিপত্র বিলির কাজ করি।’ সব সময় সৎভাবে কাজ করার কথা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করেন আনোয়ার, ‘আমি অনেক ওজনদার প্যাকেট এবং বড় অঙ্কের মানি অর্ডার মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। আমি বুড়ো হয়ে গেছি।
এখন বিশ্রাম নিতে চাই কিন্তু আমার গ্রামের মানুষ এখনো আমাকে ভালোবাসেন। তাঁরা আমাকে অবসরে যেতে দিতে চান না।’ আনোয়ার বলেন, ‘প্রতি পাঁচ বছরে একবার বাড়ে আমার বেতন। আমার অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বেতন বাড়ার ব্যাপারে আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু বেতন আর বাড়ে না। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি যেন পোস্ট অফিসে আমার ভাগনের একটি স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। এটা হলে আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ এত বছর ধরে নিয়মিত নিজের কাজটি করে গেলেও চাকরি স্থায়ী হয়নি তাঁর। আর চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় আনোয়ার পাবেন না পেনশন ও অন্যান্য সুবিধা। কাজের প্রতি অবিচল আনোয়ার তাঁর এলাকার মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা। কাজ দিয়েই তিনি মানুষ ও ডাক অফিসের লোকজনের কাছ থেকে সম্মান ও শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন। হরিপুরের কাকত্রি পোস্ট অফিসের কর্মকর্তা ডনকে বলেন, ‘হাফিজ সাহেবের কাজ দৃষ্টান্তমূলক। তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে কাজ করেন। বিপৎ​সংকুল পথ পাড়ি দিয়ে তিনি প্রায়ই মাথায় করে পোস্ট অফিসের কাগজপত্র চিঠি আনা-নেওয়া করেন। কিন্তু কোনো দিনই তিনি ব্যর্থ হননি।’

No comments

Powered by Blogger.