রাজধানীর ফুটপাতের হকার সমাচার

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অনেক বছর আগে থেকেই এবং অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে পেরুর সাহিত্যিক মারিও বার্গাস ইয়োসা বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেন। শুধু সৃষ্টিশীল সাহিত্য নয়, তিনি গুরুত্ব পেয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী রচনার জন্যও। বস্তুত তিনি স্প্যানিশ আমেরিকার শত শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে নিপীড়িত মানুষের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক অবস্থার একজন বস্তুনিষ্ঠ ভাষ্যকার।
আশির দশকের শেষের দিকে আমি তাঁর নন-ফরমাল ইকোনমির ওপর একটি দীর্ঘ লেখা পাই। সৃষ্টিশীল লেখক ছাড়া পেশাদার লেখকের পক্ষে অত প্রাঞ্জল রচনা সম্ভব নয়। ওই প্রবন্ধে তিনি বড় নগরীর ফুটপাতের হকারদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপি বাড়াতে তাঁদের যে অবদান, তা তুলে ধরেন। পৃথিবীতে সম্ভবত এমন কোনো মহানগরী নেই, যেখানে ফুটপাতে হকার নেই। তবে সেখানে খেয়ালখুশিমতো নয়, নগর কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষেই তাঁরা বিক্রিবাট্টা করেন। ফুটপাতের পাশে দোকানদারিও হয়, অন্যদিকে মানুষ হাঁটতেও পারে, কেনাকাটাও করে। কেউ কারও বিঘ্ন ঘটায় না। বছর দুই আগে একদিন দেখি একদল হকার তাঁদের জিনিসপত্র কাঁধে পুলিশের তাড়া খেয়ে ফুটপাত দিয়ে ঊর্ধ্বাকাশে দৌড়াচ্ছেন। সবার পেছনে যাঁরা, তাঁদের পিঠে পড়ছে লাঠির বাড়ি। এক বৃদ্ধ চাদরে বাঁধা তাঁর বোঝা নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে কংক্রিটের ফুটপাতে পড়ে গেলেন। বোঝার চাপে পিঠে কতটা ব্যথা পেয়েছিলেন তা বলা যায় না, কিন্তু হাঁটুর চোট ছিল প্রচণ্ড। উঠে তাঁর পক্ষে আর হাঁটাই সম্ভব হচ্ছিল না। ফুটপাতের হকারদের পুঁজির পরিমাণ কারও কারও একটু বেশি হতে পারে, কিন্তু অধিকাংশেরই পুঁজিপাট্টা অতি অল্প। প্রতিদিনের বিক্রির থেকে যে লভ্যাংশ, তা দিয়ে কোনোমতে তাঁদের সংসার চলে।বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যত রকম অব্যবস্থা রয়েছে,
তার সবগুলোর সুবিধাভোগী প্রশাসনের কর্মকর্তা, সরকারি দলের ক্যাডার-মাস্তান, কিছুটা বড় বিরোধী দলের লোকেরাও এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানুষ। দেখা যায়, দুই দিন আগেই একদল পুলিশ ও তাদের সহযোগী কয়েকজন ছাত্রনেতা নামধারী এসে টিকিট বিক্রি করে বসিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, বইসা যাইয়েন, কে ওঠায় দেইখ্যা দিমু। দুই দিন পরে আরেক দল এসে বলে, এহানে বসতে কইছে কে? হে গো যা দিছ তার ডবল না দিলে রাস্তা ছাড়ো। দ্বিগুণ দিয়ে রাস্তা ছাড়া থেকে আপাতত বাঁচা যায়, কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয় না। ফুটপাতের হকার ছাড়া বড় মহানগরীর জীবন অচল। কারা করেন ফুটপাতের হকারের ব্যবসা? যাঁরা প্রধানত শহরের এবং গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষ। যাঁদের সেলামি দিয়ে দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করার সামর্থ্য নেই। অত পুঁজি তাঁদের নেই। এই হকারদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন গ্রামের ভূমিহীন কৃষক, নদীভাঙনে নিঃস্ব মানুষ, অল্পশিক্ষিত বেকার চাকরিবাকরি না পেয়ে ধারদেনা করে কিছু মূলধন জোগাড় করে ছোট ব্যবসায় নেমেছেন। বসে পড়েছেন ফুটপাতের এক প্রান্তে। দিনে দিনে বিক্রি করে যা রোজগার হয়, তাতে কোনোমতে চলে সংসার। ফুটপাতের পণ্যের ক্রেতা কারা? তাঁদের ক্রেতার ৯০ শতাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ, সাধারণ পথচারী ও গৃহবধূ। আজ মধ্যশ্রেণির নারী পেশাজীবী। জীবিকার প্রয়োজনে, বিভিন্ন কাজে যাতায়াতের সময় তাঁরা পথ চলতে প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস কেনাকাটা করেন। কাপড়চোপড় থেকে জুতা-স্যান্ডেল, প্রসাধন সামগ্রী, লেস ফিতা,
চুলের ফিতা, রাবার ব্যান্ড, বাচ্চাদের কাপড়চোপড়, গামছা, তোয়ালে, খেলনা, ঘরের টুকিটাকি জিনিসপত্র, ইলেকট্রনিক খুচরা যন্ত্রাংশ, হাঁড়ি-পাতিল, বাসনকোসন, গামলা-বালতি যাবতীয় জিনিস ফুটপাতে পাওয়া যায়। দেশে আধুনিক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। সেগুলোর উৎপাদিত পণ্য দেশের মানুষ ব্যবহার করছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। বিদেশেও আমাদের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতিতে তা বড় ভূমিকা রাখছে। আমাদের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদেরা জিডিপির পরিমাপ করে দেশবাসীকে অবগত করেন। জিএসপি পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে সুবিধা-অসুবিধার কথা আলোচনা হয়; কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। কমবেশি তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। জাতীয় অর্থনীতিতে তাঁদের অবদান বিরাট। ঢাকার রাস্তায় হকাররা যে কৃষি-অর্থনীতিতে কত বড় অবদান রাখছেন, তা চোখ থাকতেও আমরা দেখতে পাই না। ঢাকার রাস্তায় শত শত বা হাজার হাজার দরিদ্র কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী শসা, গাজর, আমড়া, পেয়ারা, কামরাঙা, আনারস, বাতাবি, পেঁপে প্রভৃতি কেটে ঝাল-মসলা দিয়ে বিক্রি করে। ওভাবে কেনা না গেলে অল্প আয়ের মানুষ বাজার থেকে আস্ত কিনে খেতে পারত না।
অন্যদিকে গ্রামীণ কৃষিপণ্য এসব হকার বিক্রি না করলে চাষি ন্যায্যমূল্য পেতেন না এবং বহু ফলমূল নষ্ট হয়ে যেত। যা শুধু কৃষকের ক্ষতি নয়, জাতীয় ক্ষতি। নিরক্ষর দরিদ্র হকার উচ্চতর অর্থনীতির তত্ত্ব বোঝে না, জিডিপির অর্থ জানে না, কিন্তু কিছুই না জেনে জাতীয় অর্থনীতিতে যে অবদান রেখে যাচ্ছে, তা পরিমাপের অবসর আমাদের নেই। প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় কোটি কোটি টাকার পতনশীল পণ্য ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে রাজপথের হকারদের কল্যাণে। এভাবে হকাররা শিল্প-কলকারখানার উপকার করছে, অন্যদিকে কৃষিরও উপকার করছে। বাংলাদেশের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিকের পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করেছে। সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদে ঘোষণা করা হয়েছে: ‘আইনের ধারা আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে কোনো পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার জন্য...প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো আইনসম্মত পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের এবং যেকোনো আইনসংগত কারবার বা ব্যবসায়-পরিচালনার অধিকার থাকিবে।’ সুতরাং সৎ ও স্বাধীন উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার প্রত্যেকের রয়েছে। তাতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাষ্ট্রের নেই। তবে এ কথাও সত্য যে রাষ্ট্র জনস্বার্থে কখনো বাধানিষেধ আরোপ করতে পারে।
জনশৃঙ্খলা কিংবা জনস্বাস্থ্য অথবা নৈতিকতার স্বার্থে বাধানিষেধ আরোপ করা যায়। কেউ মাদক ব্যবসা করবে, কেউ ইয়াবা ব্যবসা করবে, কেউ সীমান্তে চোরাচালান করবে—রাষ্ট্র তা করতে দিতে পারে না। সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক, বর্তমানকালের রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং আর্থসামাজিক ব্যবস্থা গরিবের অনুকূলে নয়। বর্তমান অবস্থায় উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের স্বার্থই রাষ্ট্রের কাছে বড়। তাদের জীবিকার স্বাধীনতার মূল্য আর গরিবের জীবিকার স্বাধীনতার মূল্য সমান নয়। ধনীর জীবিকার স্বাধীনতার অধিকার আগে, তারপরে গরিবের অধিকার। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গীকার ও দর্শন নেই। রাষ্ট্রের মূলনীতির একটি ‘সমাজতন্ত্র’। শব্দটি সংবিধানে লেখা আছে, কিন্তু তা কোনো অর্থ বহন করে না। আমাদের রাষ্ট্র মানুষের পক্ষে সমস্যার সমাধান করতে চায়—এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং রাষ্ট্র শাসকশ্রেণির স্বার্থে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করে। এবং তা থেকে প্রশাসন ও শাসক দলের ক্যাডাররা ব্যাপক সুবিধা আদায় করে। কিছুদিন আগে গুলিস্তান-মতিঝিল এলাকার ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদের তৎপরতা চালায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
‘উচ্ছেদ’ শব্দটি ঘোরতর সংবিধানবিরোধী। পুনর্বাসন এক জিনিস, উচ্ছেদ আর এক জিনিস। পথচারীর জন্য ফুটপাত পরিষ্কার করা আবশ্যক। একটির সঙ্গে আর একটির স্বতঃসিদ্ধভাবে সম্পর্ক রয়েছে। পিটিয়ে হকারদের বিতাড়িত বা উচ্ছেদ করা অসাংবিধানিক ও অমানবিক। উচ্ছেদ অভিযানের সময় পুলিশের মারধর খেয়ে বহু হকার আহত হন। তখন হকার নেতারা আমার কাছে আসেন। তাঁরা আমাকে অনুরোধ করেন দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করে একটা গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কি না। আমি যোগাযোগ করতেই মাননীয় মেয়র আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তাঁর অফিসে আমার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক হয়। হকারদের পুনর্বাসনে তিনি আন্তরিক। তবে গুলিস্তান-মতিঝিল এলাকার ফুটপাত পরিষ্কার রাখতে তিনি বদ্ধপরিকর। তিনি বললেন, বঙ্গভবনে ভিভিআইপিদের যাতায়াতের দুই পাশে হকারদের বসতে দেওয়া যাবে না। আমি তাঁকে বললাম, তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদ অমানবিক হবে। তিনি বললেন, আড়াই হাজারের মতো হকারের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তাঁদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এমনকি যদি কেউ পেশা পরিবর্তন করতে চান, তাহলে তাঁদের সামান্য সুদে ঋণ দেওয়া হবে।
তা ছাড়া, সাঈদ খোকন বললেন, যদি কেউ মালয়েশিয়ায় চাকরি নিয়ে যেতে চান, তাঁদের সে ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। তা ছাড়া, মালয়েশিয়ায় যাতায়াত খরচও সরকার ধার হিসেবে দিতে সম্মত। মেয়রের সঙ্গে কথা বলে হকার নেতাদের সঙ্গে সিপিবি অফিসে আলোচনা হয়। তাঁরা পুনর্বাসন চান। এমন প্রস্তাবও তাঁরা দিয়েছেন যে যদি রাস্তার এক পাশে তাঁরা বসবার অনুমতি পান, তাতেও তাঁরা ব্যবসা চালাতে পারেন। তা যদি না হয় তাহলে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা বিপন্ন হবে। ফুটপাতের হকারদের ব্যবসা বড়ই কষ্টের। কনকনে শীত, আগুনের মতো রোদ, প্রবল বর্ষণ—কোনো কিছুই তাঁদের জন্য বাধা নয়। ঈদের চাঁদরাতে শেষরাত পর্যন্ত তাঁরা ফুটপাতে বসে থাকেন। প্রিয়জনকে নিয়ে ঈদের আনন্দ, পূজার আনন্দ তাঁরা খুব কমই উপভোগ করতে পারেন। তাঁদের জীবনের বেদনা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা সংবেদনশীলতার সঙ্গে উপলব্ধি করবেন, লাখ লাখ মানুষ অর্ধাহার–অনাহার থেকে বাঁচবে, তেমন উদ্যোগ নেবেন—এই প্রত্যাশা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.