বিধানসভা ভোটে তাঁরা কি এবার মোদিকে ছাড়ছেন?

কপালজোর একেই বলে। আবার একেই বলে এক ঢিলে তিন পাখি মারা। কপালজোর না হলে উত্তর প্রদেশের ভোটযুদ্ধ দেখতে বেরিয়ে এভাবে খোদ প্রধানমন্ত্রীর দেখা মেলে না। উত্তর প্রদেশের পশ্চিম প্রান্ত, যা কিনা রাজ্যের ‘সুগার বেল্ট’ ও ‘জাঠভূমি’ বলে পরিচিত, এ মাসের ১১ ও ১৫ তারিখ যেখানকার ২৬টা জেলার ১৪০টা বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট, সেখানকার প্রধান শহর মিরাট থেকেই নরেন্দ্র মোদি শুরু করলেন তাঁর আরও এক মরণ-বাঁচন লড়াই। আর চরতে বেরিয়ে আমিও তাঁর সাক্ষী থেকে গেলাম! ভোটের বাজারে কপালজোর ছাড়া একে আর কীই-বা বলা যেতে পারে? কী ভেবে নরেন্দ্র মোদি গত শনিবার মিরাট থেকেই উত্তর প্রদেশ অভিযান শুরু করলেন জানি না। তিনি হাঁক দিয়েছেন কংগ্রেসমুক্ত ভারত এবং অপরাধ ও অপশাসনমুক্ত উত্তর প্রদেশের! সিপাহি বিদ্রোহের আঁতুড়ঘর মিরাটকে প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়ার সেটাই হয়তো কারণ। প্রধানমন্ত্রীর জনসভা শতাব্দী নগরে। মূল শহরের উপান্তে নতুন জনপদ গড়ে উঠছে। সেখানে বিস্তীর্ণ ফাঁকা এলাকায় বাঁধা পেল্লাই মঞ্চ।
বেলা সাড়ে বারোটাতেই উপচে পড়েছে ময়দান। কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব। মঞ্চ থেকে প্রদেশের নেতারা পাখি-পড়া পড়াচ্ছেন, ‘মোদিজি আসামাত্র আপনারা তালে তালে মো-ও-দি, মো-ও দি বলা শুরু করবেন। ভাষণ শুরু করার আগে আবার দুই মিনিট ধরে ওইভাবে মো-ও দি, মো-ও দি চলবে। তারপর মোদিজি যা যা বলবেন তাতে প্রাণ খুলে সাড়া দেবেন। মনে রাখবেন, এই লড়াইয়ে আমাদের হারলে চলবে না।’ মোদি ভাষণ শুরু করলেন এবং তাঁর স্টাইলে জানিয়ে দিলেন, ইংরেজি শব্দ ‘স্ক্যাম’, যার অর্থ আর্থিক কেলেঙ্কারি বা দুর্নীতি, তার বানানের মধ্যেই রয়েছে দুর্নীতিগ্রস্তদের পরিচয়! কী রকম? মোদি বললেন, ‘‘‘স্ক্যাম’-এর প্রথম বর্ণ বা আদ্যাক্ষর হলো ‘এস’। এই ‘এস’ হচ্ছে সমাজবাদী পার্টি। দ্বিতীয় বর্ণ ‘সি’। তারা দুর্নীতির উৎসমুখ কংগ্রেস। তৃতীয় বর্ণ ‘এ’। সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব। আর চতুর্থ বর্ণ ‘এম’ হলেন মায়াবতী। এঁদের হাত থেকে উত্তর প্রদেশকে উদ্ধার করাই আমার ব্রত।’ এ কথা শুনে জনতা উদ্বেল হলো। মোদি বললেন, ‘উত্তর প্রদেশ আমাকে প্রধানমন্ত্রী করেছে। এই দুষ্টত্রয়ীর হাত থেকে রাজ্যকে মুক্ত করাই হবে আমার ঋণশোধ।’ এক ঢিলে তিন পাখি মারা তো একেই বলে! এই আশা নরেন্দ্র মোদি অবশ্য করতেই পারেন। কেননা, এই রাজ্যই ২০১৪ সালে তাঁর ঝুলি উপচে দিয়েছিল! লোকসভার ৮০টি আসনের মধ্যে ৭১টির ভোটার তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েই বিজেপির পদ্মে ছাপ দিয়েছিলেন! বিজেপির সহযোগী আপনা দলকে জিতিয়েছিল ২টি আসনে। সব মিলিয়ে ৮০-এর মধ্যে ৭৩, যা রাজ্যের ইতিহাসে কোনো দিন হয়নি! তিন বছরের মাথায় তা হলে ওই রকম আশাবাদী হওয়াটা কি অন্যায়?
অন্যায় নয়। কিন্তু জট পাকিয়ে দিয়েছে অখিলেশ যাদবের সঙ্গে রাহুল গান্ধীর হাতে হাত ও কাঁধে কাঁধ মেলানোর ঘটনাটা। প্রথমে লক্ষ্ণৌ, পরে এই সেদিন আগ্রায় এই দুজনের রোড শোতে মানুষের বান ডেকেছিল। নরসিংহ রাওয়ের কংগ্রেস নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি যখন বহুজন সমাজবাদী পার্টির স্রষ্টা কাঁসিরামের হাত ধরেছিলেন, তখন এই জনপ্লাবন দেখা যায়নি। তা ছাড়া সেটা ছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী হতশ্রী ও ছন্নছাড়া কংগ্রেস। দুই দশকেরও বেশি সময় পর রাহুল-অখিলেশের যুগলবন্দী রাজ্যজুড়ে মায়াবী সুরের অন্য এক মূর্ছনা তৈরি করেছে। এই দোস্তি বিজেপির স্নায়ুকে টানটান করে রেখেছে। বিজেপির তূণের সিংহভাগ তিরেই তাই অখিলেশ ও রাহুলের নাম লেখা। মোদি ও বিজেপির নেতারা আশ্রয় খুঁজছেন নখদন্তহীন অসহায় মুলায়ম সিং যাদবের মধ্যেও। যেমন মোদি বললেন, ‘আমার খারাপ লাগছে মুলায়মজিকে দেখে। বন্দী ও বৃদ্ধ শাজাহানের মতো এখন তিনি নিভৃতে অশ্রু বিসর্জন করছেন। আজীবন কংগ্রেসের বিরোধিতা করে যে দলটা তিনি নিজের হাতে করে গড়ে তুলেছিলেন, তা এখন চরিত্রভ্রষ্ট! রাজ্যবাসী এই অন্যায়কে নিশ্চয় প্রশ্রয় দেবে না।’ ন্যায়-অন্যায়ের এই উত্তরটারই খোঁজ চলেছে পশ্চিম-উত্তর প্রদেশে। ২০১৩ সালে যাঁর আমলে মুজফফরনগরের দাঙ্গা, সেই অখিলেশকেই কি পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের মুসলমানরা দ্বিতীয়বারের জন্য কোল পেতে দেবে?
প্রশ্নটা যেমন বিজেপির, তেমনই মায়াবতীরও। রাজ্যের প্রায় ২০ শতাংশ মুসলমানের মন জিততে মায়াবতী এবার ৯৯ জন মুসলমান প্রার্থী দিয়েছেন। সমাজবাদী গৃহযুদ্ধের ফায়দা লুটতে মুসলমান প্রার্থীরা এবার তাঁর তুরুপের তাস। বিজেপির নজরও ওই দিকে। তারা ভাবছে, মুসলমান ভোট বাটোয়ারা হলে মরণ-বাঁচনের এই লড়াই শেষে নরেন্দ্র মোদি হাসতে হাসতে ঠিক বেরিয়ে আসতে পারবেন। ভাবছেন বটে। কিন্তু এবারের ভোটের অঙ্ক নিছকই পাটিগণিত নয়। কিছুটা রসায়নেরও। পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের আদিগন্ত জাঠভূমি বলে পরিচিত। চাষের জমির সিংহভাগ জাঠদেরই। কেন্দ্রীয় সরকার আখের ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য বাড়ায়নি। চিনিকলেরও বকেয়া আছে। চাষির কৃষিঋণ শোধ হচ্ছে না। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো পেকে উঠেছে নোটবন্দির মার। ফলে জাঠনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের সব খাপ পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্ত, বিজেপিকে এবার ভোট নয়। মুরাদনগর, বাগপত, মিরাটের জাঠেরা এক অদ্ভুত অভিমানে টসটস করছে। অথচ তিন বছর আগে তারাই নরেন্দ্র মোদিকে বরণ করে নিয়েছিল! সেই অভিমানে ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন রাষ্ট্রীয় লোকদলের অজিত সিং ও তাঁর পুত্র জয়ন্ত। ঘোলা জলে মাছ ধরার আশায় এবার তাঁরা ভোটের আগে কারও দিকে হাত বাড়াননি।

No comments

Powered by Blogger.