শস্য ফলানো চাষি ও নাড়া-কাটা

মুক্তিযুদ্ধ ছিল সম্মিলিত সাহস ও ঐক্যবদ্ধ
প্রতিরোধের মহাকাব্যিক আয়োজন
এখনকার বঙ্গসন্তানদের মতো অতীতে আমাদের পূর্বপুরুষদের অনেকেই যেমন ছিলেন ঠকবাজ ও নষ্ট, তেমনি কেউ কেউ ছিলেন বুদ্ধিমান, সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ, সৃষ্টিশীল ও প্রজ্ঞার অধিকারী। মানবচরিত্র ও সমাজের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার যথেষ্ট ক্ষমতা তাঁদের ছিল। তাঁরা লক্ষ করেছেন, সমাজে যার অবদান বেশি সে অবহেলিত, তাকে সমাজ দেয় অল্প। যার অবদান সামান্য, তার প্রাপ্তি বেশি। তাই একটি প্রবচন প্রচলিত হয়: ‘যে এল চষে, সে রইল বসে, নাড়া-কাটাকে ভাত দাও এক থালা কষে’।
যে শ্রম দিয়ে চাষ করে ধান ফলায়, তার চেয়ে যে বসে বসে ফোপর দালালি করে অর্থাৎ নাড়া কাটে, তার কদর বেশি। কৃতী ও কর্মীর ভাগ্যে ভাত না জুটলেও নাড়া-কাটার ভাগ্য খুবই সুপ্রসন্ন। তার প্রাপ্তিযোগ থালাভরা ভাত। যে ঘটনায় কোনো জাতির লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়, সে ঘটনায় যে কত মানুষের অংশগ্রহণ থাকতে পারে, তা যে কারও পক্ষে অনুমান করা সহজ। একাত্তরে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকাই প্রধান এবং তাদের সমর্থক জনগণের অংশগ্রহণই আসল জিনিস। অল্পসংখ্যক মানুষের দৈহিক বীরত্ব দিয়ে একটি জাতির মহত্ত্ব পরিমাপ করা যায় না। একাত্তর ছিল শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মিলিত সাহস ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ার এক মহাকাব্যিক আয়োজন। সেখানে মূল রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া অন্য সবার অবদানই সমান পাল্লায় মাপা বাঞ্ছনীয়। তা ছাড়া মনে রাখা দরকার, এক বালতি দুধে এক ফোঁটা চোনা পড়লে যেমন সমস্ত দুধটাই ফেটে যায়, তেমনি এক গামলা সত্যের মধ্যে অল্প কিছু মিথ্যা পড়লে সত্যটাও আর বিশ্বাসযোগ্য থাকে না। ৪৫ বছর ধরে নিজের বীরত্বমূলক স্মৃতিচারণা করতে করতে এখন অনেকেই খেই হারিয়ে ফেলেছেন। কী বলতে কী বলছেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না। ৪৫ বছর আগের কোনো কোনো কাহিনি যেমন চমকপ্রদ, তেমনি রোমাঞ্চকর। ৯ ডিসেম্বর একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকে একজন বীর অধিনায়ক তাঁর স্মৃতি রোমন্থনে বলেছেন: ‘৬ ডিসেম্বর আমরা তেলিয়াপাড়া থেকে আশুগঞ্জ যাচ্ছি।...পথে ইসলামপুরে একটি গাড়ি আমাদের দিকে আসে। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এটিকে ব্যাটালিয়ন এমোনিশন গাড়ি মনে করে। কিন্তু পাশে আসতেই বুঝতে পারি এটি এমোনিশন গাড়ি না। শত্রুসেনাদের গাড়ি।
গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বসা একজন জেসিও লাফিয়ে নেমে আমাকে জাপটে ধরে। আমার রানারের কাছে স্টেনগান ছিল। আর জেসিওর কাছে ছিল একটি রাইফেল। আমাদের দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি চলছিল বলে রানার গুলিও করতে পারছিল না। গুলি করলে আমার গায়েও লাগতে পারে। একপর্যায়ে আমি হাঁটু দিয়ে ওই জেসিওর শরীরের বিশেষ স্থানে আঘাত করলে তার বাঁধন শিথিল হয়ে যায়। আমি ঘুষি দিলে সে পড়ে যায়। জেসিও উঠে দাঁড়িয়ে আমার রানারকে শিল্ড হিসেবে (পেছন থেকে জাপটে ধরে) তার স্টেনগানের ট্রিগার চাপে। কিন্তু গুলি আমার কোমরে থাকা পিস্তলে লাগে। আমি রানারের কাছ থেকে রাইফেল নিয়ে জেসিওর মাথায় পরপর কয়েকবার আঘাত করি। একপর্যায়ে জেসিও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মাটিতে পড়ে থাকা রানারের রাইফেল উঠিয়ে দেখি রাইফেল ভাঙা। আমি ঘুরে দাঁড়াতেই পাশে একটি বাস থামে। ঝাঁকে ঝাঁকে শত্রুসেনা নামছে। রাইফেলটি হাতে নিয়ে তাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে গিয়ে দেখি রাইফেল ভাঙা। কোমরে থাকা পিস্তল ধরতেই দেখি সেটি গুলি লেগে ভেঙে গেছে। ওই মুহূর্তে পাশের খালে লাফিয়ে পড়ি। আমার গলায় একটা ছোট কোরআন শরিফ ছিল। আমি দোয়া করছিলাম, “আল্লাহ, অস্ত্র ছাড়া আমার মৃত্যু কবুল করো না।” কাদাপানিতে ডুবে থাকার কারণে আমার পোশাকের রং ওদের [পাকিস্তানি সৈন্যদের] পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল আর সে কারণে ওরা আমাকে সন্দেহ করেনি। সেদিন রাতে ওই এলাকাতেই ছিলাম। পরদিন হেডকোয়ার্টারে বন্দী অবস্থায় আহত এক পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে নিয়ে আসে আমার সৈন্যরা এবং তিনি চিনতে পারেন আমাকে। এই সেনা অফিসারটির সঙ্গে আগের দিন আমার সংঘর্ষ হয়েছিল। সে আমাকে গুলি করেছিল আর আমি তাকে রাইফেল দিয়ে বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আমার আঘাতে সে মারা গেছে। সে আমার কাছে জানতে চায়, আগের দিন আমাকে গুলি করার শোধ আজ আমি নেব কি না? উত্তরে আমি বলি নিরস্ত্র লোকের ওপর হামলা করা কোনো মুসলমানের ধর্ম নয়।
আমি তাকে চিকিৎসা করার জন্য হাসপাতালে পাঠাতে চাইলে সে হতবাক হয়ে যায়। বিস্মিত হয়ে জানতে চায়, আমি মুসলমান কি না?’ এ যেন গ্রিক বীর আলেকজান্ডার এবং ভারতীয় বীর পুরুষ কাহিনিরই বাঙালি মুসলমানি সংস্করণ। একই সঙ্গে বীরত্ব ও মহত্ত্ব। তা ছাড়া কাহিনির যে বাঁধুনি ও নাটকীয়তা, তা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ রহস্যোপন্যাসের সঙ্গে তুলনীয়। তাই মল্লযুদ্ধের বাস্তবতা একজন দক্ষ সেনাধ্যক্ষের পক্ষেই বিশ্লেষণ করা সম্ভব, আমার পক্ষে নয়। তবে নিরস্ত্র শত্রুকে হত্যা না করার নীতি শুধু মুসলমানদের নয়; হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদেরও থাকার কথা। তিনি আরও বলেন, ‘১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিতে বলেন। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিতে হয়।’ তিনি সেই বিরল ভাগ্যবান, যিনি শুধু বঙ্গবন্ধুরই স্নেহ পাননি, তাঁর ঘাতক খন্দকার সাহেবেরও স্নেহের পাত্র ছিলেন। তাঁর ভাষায়, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরই খন্দকার মোশতাক আমাকে ডেকে বললেন, দেশের জন্য তো আপনি অনেক কিছু করেছেন। এবার দেশের বাইরে আপনার সেবা চাই। আপনার ও আপনার পরিবারের নিরাপত্তার জন্যই আপনার বাইরে যাওয়া উচিত বলে মনে করি।’ যখন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন, তখন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতির তাতে কিছুমাত্র করুণার উদ্রেক হলো না, তিনি বিচলিত হলেন সেনাপতি ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে। মোশতাকের কথায় তিনি প্রথম ‘রাজি’ না হলেও, তাঁর ভাষায়, ‘শেষ পর্যন্ত ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে আমি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিই। ১৬ বছর মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইডেন, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ১৯৯২ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নিই।’ ১৯৭৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত দেখা যায়, বাংলাদেশে সরকারপ্রধান ছিলেন জিয়াউর রহমান, আবদুস সাত্তার, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সাহাবুদ্দীন আহমদ ও খালেদা জিয়া। বিদেশে রাষ্ট্রদূত তাঁরাই হন, যাঁরা সরকারপ্রধানের অত্যন্ত আস্থাভাজন। জিয়া লোকটা ‘খুব খারাপ’ হলেও তাঁর সহকর্মী-বন্ধুকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে পুরো সময়টা রেখে দেন। বেগম জিয়ার সময়ও বছরখানেক কাজ করেন, তিনিও তাঁকে আজীবন রাখতেন, কিন্তু তিনি ‘স্বেচ্ছায় অবসর’ নেন, খালেদা জিয়া তাঁকে অপসারণ করেননি।
তিনি আরেকটি তথ্য দিয়েছেন, যা সত্য কি না জানি না: ‘১৯৭৫-এর ২৪ আগস্ট আমাকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করে সেনাপ্রধানের বঙ্গভবনেই অন্তরীণ রাখা হয়।’ আমরা ৪৫ বছর জেনে এসেছি তাঁর চাকরি সেনাবাহিনী থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়, সেটা এখনো অনেককে করা হয়ে থাকে।  অন্য পদে বদলি করা আর ‘বরখাস্ত’ করা একেবারেই দুই জিনিস। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার জীবন রক্ষায় এগিয়ে যান না যিনি, দায়িত্বে চরম অবহেলার জন্য তাঁর লজ্জিত হয়ে চুপ থাকার কথা। কিন্তু প্রচারমাধ্যমের প্রশ্রয়ে স্মৃতি তাঁদের রোমন্থন করতেই হয়। সেসব কথা আমরা আড়ি পেতে শুনি। স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হওয়ার মতো পেশাদার কূটনীতিকের কি অভাব ছিল? ৪৫ বছর আগের ভূমিকা বিক্রি করে অনেকে রাষ্ট্র থেকে পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন সীমাহীন। কেউ সেই দুর্বিষহ দিনে সবকিছু হারিয়েও পাননি কিছুই। রাজবাড়ীর শহীদ অধীরের মা চারুবালার আজ অর্ধাহারে দিন কাটে। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও অধীরের মা চারুবালা না পেয়েছেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সম্মান, না কোনো সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা। চার ছেলের মধ্যে শহীদ অধীর ছিলেন তৃতীয়। ‘মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার কামান্না নামক স্থানে রণাঙ্গনে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন অধীর ও গৌড়সহ ১১ মুক্তিযোদ্ধা।’ [সমকাল, ১২ ডিসেম্বর] বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদে চারুবালাদের নিঃশব্দ হাহাকার আজও আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয়। রাষ্ট্রের কান নেই, তাই রাষ্ট্র শোনে না। শাসকশ্রেণির চোখ নেই, তাই তারা দেখতে পায় না। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডে যাঁরা স্বাধীনতার শস্য বুনে গেছেন, সেই ফসল আমরা ঘরে তুলে ভোগ করছি, তারপর তাঁদের ভুলে গেছি অথবা মনে রেখেছি শুধু তিরিশ-পঁয়ত্রিশ জনকে। তাঁদের কথাই ঘুরে ঘুরে সারা বছর মানুষ জানে। অধীরদের কেউ চেনে না।     তাঁর মা চারুবালা স্মৃতি রোমন্থন কাকে বলে তা জানেন না। যে জাতি বর্তমানের দীনতা অতীতের কোনো একটি অর্জনের গল্প দিয়ে ঢেকে রাখতে চায়, তার অগ্রগতি হয় না। অতীত অপরিবর্তনীয়, যা হয়েছে তা হয়েছেই, কিন্তু চেষ্টা দ্বারা বর্তমানকে বদলানো যায়। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর একটি বক্তব্য এ রকম: ‘কেউ যদি কুড়ি বছর বয়সে পৃথিবীটাকে যেভাবে দেখেছিল, পঞ্চাশ বছর বয়সেও ঠিক তেমনিভাবেই দেখে, তাহলে বলতে হয় সে তার জীবনের তিরিশটি বছর অপচয় করেছে।’ আমরা ৪৫ বছরের কতটা অপচয় করেছি, তা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ একদিন মূল্যায়ন করবেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।

No comments

Powered by Blogger.