শোকের দিন, উঠে দাঁড়ানোর দিন

রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাকিস্তানিদের বর্বরতার খণ্ডচিত্র
স্কুলে পড়ার সময় আমাদের বাংলার শিক্ষক নাসির স্যার কোনো এক মনীষীকে উদ্ধৃত করে বলতেন, ‘দাসের শান্তি নিয়ে থাকার চাইতে বিপজ্জনক স্বাধীনতা অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত।’ তিনি যখন এই কথা আমাদের বলতেন, স্বাধীনতা শব্দটি তখনো আমাদের হয়নি, অখণ্ড পাকিস্তানে অর্জিত দাসের শান্তিকে বড় কোনো বিপদের মুখে ফেলতেও কিছু মানুষ প্রস্তুত ছিলেন না। স্যার কোনো আশু রাজনৈতিক সম্ভাবনার কথা মনে রেখেও কথাটি বলতেন না। তিনি আমাদের যা বোঝাতে চাইতেন, তা হচ্ছে স্বাধীনতা শব্দটির গূঢ়ার্থ। হয়তো তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির জগতে স্বাধীনতার ব্যাপক অর্থ ছিল, হয়তো তিনি তাঁর লেখালেখির স্বাধীনতার কথা মনে রেখেই এটি বলতেন, আমরা এর কিছু না বুঝলেও। স্যার আমেরিকা ঘুরে এসে এক ভ্রমণকাহিনি লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন। হয়তো কথাটি তিনি সে দেশে শুনেছেন অথবা সে দেশের মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়টি তাঁকে খুব নাড়া দিয়েছিল, কে জানে। কিন্তু স্যার স্বাধীনতা বলতে ঠিক কী বুঝতেন এবং বিপজ্জনক স্বাধীনতাই বা কী, তা নিয়ে আমরা কঠিনভাবে ভাবতেও শুরু করলাম মাত্র আট কি নয় বছরের মধ্যেই, সত্তরের নির্বাচনের সময় থেকেই। একাত্তরজুড়ে আমরা দাসের শান্তিকে পায়ে ঠেলে আমাদের নিজেদের পরিচিত, অস্তিত্ব, মালিকানা আর ঠিকানাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার লক্ষ্যে যুদ্ধ করেছি। একাত্তরে আমরা জেনেছি স্বাধীনতা শব্দটি কত বিপজ্জনক হতে পারে। মানুষ মরেছে অকাতরে, মা সন্তানকে শত্রুর বন্দুকের সামনে ঠেলে দিয়ে বলেছেন, শিরদাঁড়া সোজা করে লড়বে। সন্তানেরা লড়েছে। তাদের সোজা শিরদাঁড়ার সামনে শত্রু বিপর্যস্ত হয়েছে।
সারা একাত্তরে বিপদ ছিল কায়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ছায়ার মতো। কিন্তু বাঙালি বিপদকে পরোয়া করেনি। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে কাপুরুষের মতো হত্যা করে পাকিস্তানিরা তাদের কিছু এদেশীয় বশংবদের সহায়তায়, যারা দাসের শান্তিকে জীবনের আদর্শ মেনেছিল। যাঁদের তারা মেরেছিল, তাঁরা বিপজ্জনক স্বাধীনতা কথাটির গূঢ়ার্থ জানতেন। এবং সেই জ্ঞান তাঁরা শুধু তাঁদের কাজে এবং জীবনে প্রমাণ করে গেছেন তা-ই নয়, মৃত্যুতেও তাঁরা বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন, স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে সুন্দর আর সৃষ্টিশীল জীবনটাকেও বিপদের হাতে ঠেলে দিতে হয়। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাকিস্তানিদের বর্বরতার বলি হাত-পা বাঁধা কান্তিমান এই মানুষগুলোর ছবি যেদিন কাগজে এল, কেন জানি নাসির স্যারের ওই উদ্ধৃতি মনে পড়েছিল। এবং স্বাধীনতা শব্দটির কত অর্থ হতে পারে তা বুঝেছিলাম। একাত্তরের এই শহীদেরা ছিলেন আমাদের শিল্প-সাহিত্য, চিকিৎসা-শিক্ষকতা, দর্শন-সাংবাদিকতা-সংস্কৃতি নানা ক্ষেত্রে সক্রিয়; তাঁরা তাঁদের চিন্তা দিয়ে, ভাবনা দিয়ে, সৃষ্টি দিয়ে, সক্রিয়তা দিয়ে মানুষকে জাগাচ্ছিলেন। তাঁরা সবাই পরাধীনতার বৃত্ত থেকে মুক্তি পেতে মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করেছেন এবং তাঁরা তা করছেন সেই কবে থেকে—পঞ্চাশের দশক থেকেই—যখন মানুষ রাজনৈতিক স্বাধীনতা, একটা আরোপিত সংজ্ঞাকেই প্রয়োগ হতে দেখছে চারদিকে। তাঁরা জানতেন, সাতচল্লিশের পর বাঙালির একটা ধারণা জন্মেছিল, তারা স্বাধীন। ১৯৫২ সালে সেই ধারণায় চিড় ধরেছিল। তারপরও বাঙালি এটি ভাবেনি, পাকিস্তানিরা তাদের উপনিবেশী দাসের জায়গায় দেখছে, যদিও কিছু মানুষের তাতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু ষাটের দশকের শুরু থেকেই, মানুষও বুঝতে শুরু করেছিল, অনেক আশা নিয়ে কাটা স্বাধীনতার ছকটায় একটা বড় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। একাত্তরে যেসব বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছিলেন, বিশেষ করে ১৪ ডিসেম্বর, তাঁরা এই ছকটার অসারতার বিষয়টি বুঝেছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকেই স্বাধীনতার একটা ভিন্ন অর্থে আস্থা স্থাপন করেছিলেন, যে অর্থ যতটা রাজনৈতিক, ততটা বুদ্ধিবৃত্তিক; যতটা বস্তুগত ততটা সাংস্কৃতিক, যতটা আর্থসামাজিক ততটা সৃষ্টিশীল। এবং এই প্রতিটি স্বাধীনতা চিন্তাই ছিল বিপজ্জনক। ১৯৪৭-এ আমাদের অনেকে না বুঝলেও পাকিস্তানিরা ঠিকই বুঝেছিল বাঙালিদের অধস্তন রাখতে গেলে তাদের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা দেওয়া যাবে না, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বস্তুগত স্বাধীনতা দেওয়া যাবে না।
তাদের ওপর উর্দু চাপিয়ে, তাদের ভাষা রোমান হরফে লিখে নজরুলের কবিতায় মহাশ্মশানের জায়গায় গোরস্তান বসিয়ে, তাদের পাট বেচা টাকা নিজের পকেটে নিয়ে, তাদের লোকজনকে কেরানির চাকরি দিয়ে সাহেবের চাকরি নিজেরা নিয়ে ভালোমতো তাদের ওপর ডান্ডা ঘোরানো যাবে। যেহেতু সেনাসামন্ত তাদের, পাইক–পেয়াদা তাদের, কোনো ওজর-আপত্তি উঠলে সেই ডান্ডা মাথায় মারা যাবে। আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ঠিকই বুঝেছিলেন, মানুষ জাগলে এই ডান্ডা তার তেজ হারাবে, একসময় ডান্ডা ফেলে দৌড়াতে হবে উজির-নাজির, পাইক–পেয়াদাদের। কিন্তু ডান্ডার সামনে দাঁড়ানোটা বিপজ্জনক। সে কাজটি করা যায় তখনই যখন শিরদাঁড়া সোজা রেখে স্বাধীনতার স্বপ্নটা চোখে রেখে শত্রুর সামনে দাঁড়ানো যায়। সেই জ্ঞানটি, সেই উৎসাহটি তাঁরা মানুষকে দিয়েছেন আমৃত্যু। আশ্চর্য, তাঁদের জ্ঞান থেকে পাওয়া শক্তিটি আমাদের মায়েরা ঠিকই নিজেদের শুভ-অশুভ চিন্তায় নিজেদের মতো করে ধারণ করে নিয়েছিলেন। সে জন্যই কি না, ওই বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী-শিক্ষকদের মতো পাকিস্তানিরা আমাদের মায়েদের বিরুদ্ধে পাশবিক আক্রোশ দেখিয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর তারিখটি আমাদের জন্য নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এটি বিশাল এক শোকের দিন, কালো রঙে ঢাকা দিন: কিন্তু দিনটি জাগরণেরও। নাসির স্যার যে স্বাধীনতা শব্দটি নিয়ে আমাদের ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, সেই স্বাধীনতাকে এই উজ্জ্বল মানুষেরা অসম্ভব মহিমা আর মর্যাদায় সেদিন অধিষ্ঠিত করেছেন। জাগরণটা চিত্তের, শুভের, শুভবুদ্ধির। সারা দেশ দেখেছে পাকিস্তানিরা এমন কিছু মানুষকে বর্বরের মতো মেরেছে, যাঁরা কোনো দিন বন্দুক হাতে নেননি। তাঁদের হাতে ছিল কলম, যে কলমের কালিতে একটি জাতির ইতিহাস-সংস্কৃতি-সাহিত্যসহ অসংখ্য সৃষ্টিশীলতার গাথাগুলো লেখা হয়েছে। পাকিস্তানিরা এই কলমের শক্তিকে মানতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু তলোয়ারের সঙ্গে কলমের পার্থক্য হলো তলোয়ার ভেঙে গেলে বা ভোঁতা হলে তাতে আর কোনো কাজ হয় না। অথচ হাতের কলম ভেঙে গেলে হৃৎকলম ঠিকই লিখে যায়। আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা হৃৎকলমের শক্তি তুলে দিয়েছেন আমাদের হাতে, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর। এই কলম দিয়ে স্বাধীনতার অনেক অর্থ আমরা লিখছি, আমাদের নানা অর্জনের গাথা লিখছি। এই কলমের টানে আমরা জাগি। ১৪ ডিসেম্বর তাই জাগরণের দিন। ১৪ ডিসেম্বর না হলে ১৬ ডিসেম্বরকে আমরা পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করতে পারতাম না। ১৪ ডিসেম্বর বিপজ্জনক স্বাধীনতার এক চূড়ান্ত অর্জনের পথ ধরে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়রথ হাজির হয়েছে। সেই রথের মাথায় লাল-সবুজের যে পতাকা তা আমাদের স্বাধীনতার সব অর্থ-গূঢ়ার্থের এক প্রতীকী প্রতিফলন। ১৪ ডিসেম্বর আমাদের জানায় বুদ্ধির ও চিত্তের স্বাধীনতা না এলে, অন্ধকার আর অশুভের হাত থেকে মুক্তি না পেলে সাংস্কৃতিক আর বস্তুগত স্বাধীনতা না এলে, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিভিত্তিক নানা বিভাজনের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থপূর্ণ হতে পারে না। অর্থাৎ আমাদের বিজয় দিবসের উদ্‌যাপন অনেকটাই পোশাকি হয়ে দাঁড়ায় যদি আমরা ১৪ ডিসেম্বরের শহীদদের আত্মত্যাগের মহিমাকে হৃদয়ে ধারণ করতে না পারি।
২. তাহলে প্রশ্ন ওঠে, আমরা কি বুদ্ধির এবং চিত্তের, সংস্কৃতির এবং কল্পনার মুক্তি নিশ্চিত করতে পেরেছি? ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, বৃহৎ-ক্ষুদ্রের নামে বিভাজন বৈষম্য থেকে মুক্তির সংগ্রামে আছি? যাদের হাত ধরে পাকিস্তানিরা ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছিল, তাদের মত আর পথের কি অবসান হয়েছে? নাকি দেশজুড়ে হঠাৎ একটা উল্টো ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে? একাত্তরের মা তার সন্তানদের ধর্মভিত্তিক বিভাজন চিন্তার শিক্ষা দেননি। অথচ এখন প্রচুর মানুষ তা-ই করছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ বেড়েছে। হিন্দুদের মন্দির আর প্রতিমা এবং গৃহস্থালি আক্রান্ত হয়েছে, বৌদ্ধদের মন্দির ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সাঁওতালদের তাদের জমি থেকে উৎখাত করা হয়েছে, তাদের ও অন্যান্য আদিবাসীর ‘আদিবাসী’ পরিচয়টিও মুছে দেওয়া হচ্ছে।আজ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আতঙ্ক এবং নিরাপত্তার অভাব, আদিবাসীরা শঙ্কিত অধিকার-বঞ্চনা নিয়ে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এক বর্বর শক্তির ঝাঁপিয়ে পড়ায় সংগতভাবেই আমরা ক্ষুব্ধ, কিন্তু আমার দেশের সাঁওতালদের বাড়িছাড়া করা হলে, হিন্দুদের মন্দির ভাঙলে আমরা কেন ক্ষুব্ধ হই না?
আমরা কি মানুষকে মানুষ না ভেবে তার ধর্ম আর বর্ণ দিয়ে বিচার করতে শুরু করেছি? এই শিক্ষা কি ১৪ ডিসেম্বরের এবং সারা একাত্তরের শহীদেরা আমাদের দিয়ে গেছেন? আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ঘাতকদের, যুদ্ধাপরাধীদের অনেককে আমরা বিচারের আওতায় আনতে পেরেছি। বাকিদের আনতে পারলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু একই সঙ্গে, এই শহীদেরা  বিপজ্জনক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন, সেই স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিতে না পারলে আমরা তাঁদের স্মৃতির প্রতি সুবিচার করব না। যে জাতি বুদ্ধির ও চিত্তের, সংস্কৃতির ও নন্দনচিন্তার, বস্তুজীবনের ও সৃষ্টিশীল জীবনের স্বাধীনতা এবং উৎকর্ষ অর্জনের পথে থাকে—যার আহ্বান ১৪ ডিসেম্বরের শহীদেরা আমাদের দিয়েছেন—তাদের দেশে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকে না। সেখানে সবাই এক মায়ের সন্তানের মতো মিলেমিশে থাকে। এই সুন্দর জীবনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাটা সহজ কাজ নয়, বিপজ্জনকই বটে। তবে এই বিপজ্জনক স্বাধীনতার পথে একাত্তরের ৪৫ বছর পর আমাদের নামতে হবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.