‘নোবেল পাওয়ার অনুভূতি চাঁদে দাঁড়ানোর মতো’

সবাইকে শুভসন্ধ্যা। আমি সুইডিশ একাডেমির সব সদস্য এবং আজ রাতে উপস্থিত বিশিষ্ট অতিথিদের জানাই উষ্ণতম শুভকামনা। সশরীরে এখানে আসতে না পারার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু এটা জানবেন, আমি মনেপ্রাণে আপনাদের সঙ্গেই আছি। আর এ রকম একটি মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পেয়ে আমি সম্মানিত বোধ করছি। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাব—এটা আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
ছেলেবেলা থেকেই আমি তাঁদের সম্মান করেছি, লেখা পড়েছি এবং আত্মস্থ করেছি, যাঁদের এই মর্যাদার জন্য যোগ্য বিবেচনা করা হতো: কিপলিং, শ, টমাস মান, পার্ল বাক, আলবেয়ার কামু ও হেমিংওয়ে। সাহিত্যের এই মহারথীদের লেখা স্কুলে পড়ানো হয়, তাঁদের বই বিশ্বজুড়ে পাঠাগারগুলোয় স্থান পায় এবং লোকে যখন তাঁদের সম্পর্কে কথা বলে, তাঁদের কণ্ঠে সম্ভ্রমের সুর শোনা যায়। তাঁরা সব সময়ই আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছেন। এখন আমি তাঁদের কাতারে যোগ দিচ্ছি, সত্যি এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমি জানি না, যাঁদের কথা বললাম, তাঁরাও নোবেল পুরস্কার পাবেন বলে ভেবেছিলেন কি না, কিন্তু আমি ধারণা করি, যাঁরা বই, কবিতা বা নাটক লেখেন, তাঁরা হয়তো মনের গহিনে এই পুরস্কার পাওয়ার গোপন স্বপ্ন লালন করেন। সম্ভবত এই বাসনা মনের এত গহিনে থাকে যে এর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। কেউ যদি আমাকে কখনো বলতেন, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনাও আমার আছে, তাহলে আমাকে ভাবতে হতো, চাঁদে দাঁড়ালে মানুষের মনে যে অদ্ভুত অনুভূতি হয়, আমার সে রকম অনুভূতি হচ্ছে। বস্তুত যে বছর আমি জন্মালাম এবং তার কয়েক বছর পর পৃথিবীতে এমন কেউ ছিল না, যাকে এই পুরস্কারের জন্য খুব বেশি বিবেচনা করা হয়েছিল। তাই স্বীকার করছি, খুব কম করে বললেও বলতে হয়, আমি কিছু বিরল মানুষের সাহচর্যে এসেছি। এই বিস্ময়কর খবরটি যখন পেলাম, তখন আমি রাস্তায় এবং খবরটি হজম করতে আমার বেশ কয়েক মিনিট সময় লেগে যায়। আমি তখন মহান সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ারের কথা ভাবতে শুরু করি। আমি আন্দাজ করি, তিনি নিজেকে নাট্যকার ভাবতেন। তিনি সাহিত্য লিখছেন, এই চিন্তা তাঁর মাথায় ঢুকতে পারেনি। তিনি মঞ্চের জন্য লিখতেন, অর্থাৎ বলার জন্য লিখতেন, পড়ার জন্য নয়। আমি নিশ্চিত, তিনি যখন ‘হ্যামলেট’ লিখছিলেন, তখন তিনি ভিন্ন আরও অনেক কিছুই ভাবছিলেন: ‘এই চরিত্রে কে ভালো অভিনয় করতে পারবেন?’ ‘কীভাবে এর মঞ্চায়ন হবে?’ ‘আমি কি সত্যিই ডেনমার্কের পটভূমিতে নাটকটি লিখতে চাই?’ সন্দেহ নেই, তাঁর সৃজনশীল অন্তর্দৃষ্টি এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাই মনের পুরোভাগে ক্রিয়াশীল ছিল, কিন্তু তাঁকে আরও অনেক পার্থিব বিষয় নিয়ে ভাবতে হচ্ছিল: ‘টাকাপয়সা কি পাওয়া যাবে?’ ‘মঞ্চে কি আমার পৃষ্ঠপোষকদের জন্য যথেষ্ট ভালো জায়গা আছে?’ ‘মানুষের মাথার খুলিই-বা কোত্থেকে পাব?’ আমি বাজি ধরে বলতে পারি, শেক্‌সপিয়ারের মনে সবচেয়ে দূরবর্তী যে প্রশ্নটি ছিল তা হচ্ছে, ‘এটা কি সাহিত্য?’ কিশোর বয়সে যখন আমি গান লিখতে শুরু করি এবং নিজের ক্ষমতার জন্য কিছু খ্যাতিও অর্জন করি, তখন গান নিয়ে আমার আকাঙ্ক্ষা আসলে ঠিক তত দূরই গিয়েছিল। ভেবেছিলাম, কফি হাউস ও বারে গাইতে পারব আমি, হয়তো পরবর্তী সময়ে কার্নেগি হল ও লন্ডন প্যালাডিয়ামেও গাইতে পারব। আমি যদি সত্যিই বড় স্বপ্ন দেখতাম, তাহলে হয়তো রেকর্ড বের করার কল্পনা করতাম এবং তারপর রেডিওতে গাওয়ার কথা ভাবতাম। বড় পুরস্কার হিসেবে এই-ই ছিল আমার মনে।
রেকর্ড বের করা ও রেডিওতে গান গাওয়ার মানে হচ্ছে, আপনি অনেক দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারছেন এবং আপনি যা করতে শুরু করেছেন, তা করে যেতে পারবেন। দীর্ঘদিন ধরে যা করব বলে শুরু করেছিলাম, আমি এখন সেটাই করছি। আমার ডজন খানেক রেকর্ড বেরিয়েছে, সারা পৃথিবীতে হাজার খানেক কনসার্টে গেয়েছি। কিন্তু আমি যা করি তার কেন্দ্র কিন্তু আমার গানই। বিভিন্ন দেশের ও সংস্কৃতির বহু মানুষের জীবনে আমার গান স্থান পেয়েছে, যার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমাকে একটি কথা বলতেই হবে। পারফরমার হিসেবে আমি যেমন ৫০ হাজার মানুষের সামনে গেয়েছি, তেমনি ৫০ জনের সামনেও গেয়েছি এবং আমি বলতে পারি, ৫০ হাজারের চেয়ে ৫০ জনের জন্য গাওয়া কঠিন। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব এবং পরস্পর থেকে আলাদা পরিচয় রয়েছে, তাঁদের নিজের নিজের পৃথিবী রয়েছে। তাঁরা আরও পরিষ্কারভাবে সবকিছু উপলব্ধি করতে পারেন। আপনার সততা এবং তা কীভাবে আপনার প্রতিভার গভীরতার সঙ্গে সম্পর্কিত, তার একটা পরীক্ষা হয়ে যায়। আমি আসলে বলতে চাইছি, নোবেল কমিটি ছোট হলেও তার গুরুত্ব আমার কাছে কম নয়। কিন্তু শেক্‌সপিয়ারের মতো আমি প্রায়ই সৃজনশীলতা ও জীবনের জাগতিকতার অন্বেষণে ব্যাপৃত হয়ে পড়ি: ‘আমার গানগুলোর জন্য কে বাজালে সবচেয়ে ভালো হবে?’ ‘আমি কি সঠিক স্টুডিওতে গান রেকর্ড করছি?’ ‘সুর কি ঠিক আছে?’ কিছু কিছু জিনিসের কখনো পরিবর্তন হয় না, এমনকি ৪০০ বছরেও না। আমার জীবনে কখনোই এমন সময় আসেনি, যখন আমার নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়েছে, ‘আমার গান কি সাহিত্য?’ কাজেই, আমি সুইডিশ একাডেমিকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, কারণ তারা একই সঙ্গে এই প্রশ্ন বিবেচনা করার জন্য সময়ক্ষেপণ করেছে এবং সর্বোপরি আমাকে এমন একটি চমৎকার উত্তর দিয়েছে। আপনাদের সবার জন্য শুভকামনা। বব ডিলান

No comments

Powered by Blogger.