সুন্দরবন কি বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি হারাবে?

পশুর নদে ফেলা পানি দূষিত ও গরম
হওয়ার কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে
১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে জাতিসংঘের শিক্ষাবিজ্ঞান ও সংস্কৃতি–বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি প্রদান করে। বিশ্বের অনন্য ও অসাধারণ জীববৈচিত্র্যবহুল এই বনাঞ্চল বাংলাদেশের গর্ব হয়ে এত দিন সসম্মানে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু আজ ২০ বছরের মাথায় ইউনেসকো সুন্দরবনকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা ব্যক্ত করেছে। রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলে তার দূষণ সুন্দরবনকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে—এ উদ্বেগকে গ্রাহ্যের মধ্যে না নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে অনড় অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি আজ সংকটাপন্ন। রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণের ফলে সুন্দরবন যে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার বৈজ্ঞানিক যুক্তিগুলো দেশের বিশেষজ্ঞ মহল, পরিবেশবিদ ও প্রকৃতি গবেষকেরা তুলে ধরা সত্ত্বেও সরকার তা অমূলক, অসত্য ও উন্নয়নবিরোধী বলে অগ্রাহ্য করে আসছে। ইতিমধ্যে ইউনেসকো রামপালের দূষণে সুন্দরবনের ক্ষতির আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করে গত মার্চ মাসে তাদের তিন সদস্য বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদলকে রামপাল ও সুন্দরবন পর্যবেক্ষণে পাঠায়। প্রতিনিধিদল গত জুন মাসে তাদের পর্যবেক্ষণের ফলাফল রিপোর্ট সরকারের কাছে পাঠায়, যাতে তারা সুস্পষ্টভাবে রামপাল প্রকল্প সুন্দরবনের কী কী ক্ষতির কারণ ঘটাবে, তা উল্লেখ করে এটিকে বাতিল করা বা অন্য স্থানে সরানোর সুপারিশ করে। সরকার তাতে সম্মত না হলে ইউনেসকো সর্বশেষ পুনরায় রামপাল কেন্দ্র বাতিলের সুপারিশের পুনরাবৃত্তি করে। ইউনেসকো জানায়, ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠেয় ৪১তম অধিবেশনে সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
রামপাল নিয়ে অনড় মনোভাব দেখানোর সরকারি ব্যাখ্যা এই যে রামপাল প্রকল্প সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি হবে, তাই কয়লাদূষণ রোধ করে সুন্দরবন রক্ষা করা যাবে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের এই ব্যাখ্যায় অর্ধসত্য, অসত্য ও চাতুরতার আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টি সাধারণ জনগণের বোধগম্য হয়নি বটে; কিন্তু আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহলের অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণে তা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক দলের সদস্যরা রামপাল কেন্দ্র স্থাপনে কারিগরি ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নে যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে তা সম্যক বিশ্লেষণ করে রামপালের দূষণ ও ক্ষতির বিষয়গুলো তুলে ধরেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পাঁচজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, যাঁরা সবাই কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র ও তার প্রভাব নিয়ে বিশ্বের নানা স্থানে কাজ করেছেন, তাঁদের মতামত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তাঁদের মতে, রামপাল প্রকল্প হলে সুন্দরবনের দূষণ অবশ্যম্ভাবী।কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির দক্ষতা ৪২ থেকে ৪৪ শতাংশ, আর আলট্রাসুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির দক্ষতা ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ; দ্বিতীয়টি প্রথমটির তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম কয়লা ব্যবহার করে সমান বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। তার মানে এই নয় যে আলট্রাসুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি দূষণমুক্ত। তাই সরকারের ঢালাও বক্তব্য যে আলট্রাসুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি সুন্দরবনকে সব দূষণ থেকে মুক্ত রাখবে, তা মোটেই সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ ও কঠিন বর্জ্য দূষণ হয়, তা প্রতিরোধে কী ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, তা-ই মূল বিষয়। এ প্রবন্ধের স্থান সীমিত হওয়ার কারণে এসব বিষয়ে উল্লিখিত বিজ্ঞানীদের মতামতের কিছু অংশ আলোচনা করা হলো। প্রথমে ধরা যাক পানিদূষণের কথা। পশুর নদ থেকে পানি নিয়ে তা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের পর যে দূষিত পানি নদে ফেলে দেওয়া হবে, তা নদকে দূষিত করবে; যা কিনা ভাটিতে সুন্দরবনের ভেতর প্রবেশ করে দূষণ ঘটাবে। সরকার বলছে, এই পানি ফেলার আগে তা পরিষ্কার করে নেওয়া হবে, তার পিএইচ মাত্রা ৭ পর্যায়ে এনে তা সহনীয় করা হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পানিদূষণ বিশেষজ্ঞ ডোনা লিসেনবি বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে। দূষিত পানির পিএইচ মাত্রা ৭-এ নিয়ে এলেই পানি দূষণমুক্ত হয় না। পরিষ্কার করা বর্জ্য পানিতে কিছু দূষণ থেকেই যাবে। এ ক্ষেত্রে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি হলো ‘জিরো লিকুইড ডিসচার্জ’, অর্থাৎ শূন্য পানি নির্গমন ব্যবস্থাপনা; যেখানে কোনো পানিই নদীতে ফেলা হয় না। এই সর্বাধুনিক পদ্ধতি পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশে ১৬০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে চালু আছে।
ভারতের স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও এনটিপিসি রামপালে এটি ব্যবহারের ব্যবস্থা করেনি। পশুর নদে ফেলা বর্জ্য–পানির অপর সমস্যা হবে তার তাপমাত্রা। কেউ কেউ এ পানি ঠান্ডা করে ফেলা হবে বললেও সরকারি ভাষ্যমতেই তা নদের পানির চেয়ে অন্তত ২ ডিগ্রি বেশি থাকবে। মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলছেন যে এই ২ ডিগ্রি বেশি থাকার ব্যাখ্যাটি সুচতুরতার সঙ্গে করা হয়েছে, কারণ সরকারি ভাষ্যমতে, এই তাপমাত্রা থাকবে মিশ্রণবলয়ের প্রান্তসীমায়। সাধারণ লোকেরা মিশ্রণবলয় কী তা বোঝে না। প্রকৃতপক্ষে পশুর নদের যে স্থানে পানি ফেলা হবে, সেখানে তাপমাত্রা মিশ্রণবলয়ের প্রান্তসীমানার চেয়ে আরও বেশি হবে। সুতরাং পশুর নদে ফেলা পানি দূষিত ও গরম হওয়ার কারণে নদের জীববৈচিত্র্যের সমূহ ক্ষতি হবে, যার প্রভাব ভাটির দিকে নিকটস্থ সুন্দরবনের ওপর পড়বে। এবার আসা যাক ছাইদূষণের কথায়। সরকার বলছে, নির্গত ছাইদূষণ রোধে ইলেকট্রো স্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটর (ইএসপি) ব্যবহার করা হবে, যাতে বাতাস দূষণমুক্ত থাকে। মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলছেন, ছাইদূষণ ও পারদদূষণ রোধে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি হলো ‘ব্যাগ হাউস’ প্রযুক্তি, যা কিনা রামপালে ব্যবহার করা হবে না। সরকারি ভাষ্যমতে, ২৯০ মিটার সুউচ্চ চিমনির মাধ্যমে নির্গত দূষিত ছাইমিশ্রিত বায়ুকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এই নির্গত বায়ু রামপালে পড়বে না বটে; কিন্তু ১৪ কিলোমিটার দূরত্বে শুরু হওয়া এবং ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত সুন্দরবনের ভেতর গিয়ে পড়বে।
কয়লা থেকে উদ্ভূত ছাই সম্পর্কে সরকারি বক্তব্য হলো, কয়লা থেকে উদ্ভূত ছাই শতভাগ শুষ্ক অবস্থায় রাখা হবে এবং তা পুরোটাই বাইরে বিক্রি করে দেওয়া হবে। এ বক্তব্য ছাইদূষণের প্রধান উপাদান ভেজা ছাই এবং পানি ও ছাইয়ের ঘন মিশ্রণের অস্তিত্ব সুচতুরতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছে। কিন্তু বিজ্ঞানী দলের সদস্যরা রামপালের আহূত দরপত্রের সূত্র ধরে বলছেন যে দরপত্রে পানি ও ছাইয়ের ঘন মিশ্রণ রাখার জন্য ছাই-পুকুর স্থাপন করার বিষয়টি অতি বিস্তারিত উল্লেখ করা আছে। আর এহেন ছাই-পুকুর ভূগর্ভস্থ পানিকে, পার্শ্ববর্তী নদীর পানি ও পরিবেশকে ব্যাপকভাবে দূষিত করতে পারে, যেহেতু এই ছাইয়ের মধ্যে নানা বিষাক্ত ভারী ধাতু থেকে থাকে। কয়লা পোড়ালে নির্গত দূষিত বায়ুর একটি নাইট্রোজেন অক্সাইড। মার্কিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দূষিত বায়ু রোধে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি হলো সিলেকটিভ কাটালিটিক রিডাকশন (এসসিআর)। রামপালে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে না; বরং ব্যবহার করা হবে ‘লো নক্স বার্নার’। তাঁদের মতে, এটি দূষিত নাইট্রোজেন অক্সাইড গ্যাস প্রতিরোধে মোটেই সুদক্ষ প্রযুক্তি নয়; বরং এটি ৩০ বছর পুরোনো প্রযুক্তি, যা উন্নততর দেশে ব্যবহারই করা হয় না। কয়লার স্তূপ থেকে উদ্ভূত কয়লার ধুলা ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক দূষণ হতে পারে। রামপালের আহূত দরপত্রের সূত্রে জানা যায়, এটি রোধে পানি ছিটা পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে; যা মোটেই সুদক্ষ পদ্ধতি নয়। এটি নিয়ন্ত্রণে নানা রাসায়নিক স্প্রে ব্যবহার পদ্ধতি চালু রয়েছে, যা উন্নত ও দক্ষ পদ্ধতি কিন্তু রামপালে তার ব্যবহার হবে না। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভ নাইমিয়ার হিসাব করে দেখাচ্ছেন যে রামপাল থেকে প্রতিবছর প্রায় ৩ টন কয়লা–ধুলা ছড়িয়ে পড়বে, যা কিনা নদীর পানি, মাটি ও বনাঞ্চলকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে পশুর নদ দিয়ে জাহাজে করে কয়লা পরিবহনের জন্য প্রতিবছর নদে যে ড্রেজিং করার প্রয়োজন হবে, সুন্দরবনের ওপর তার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞানী দলের বক্তব্য সুস্পষ্ট। রামপালের দূষণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যেভাবেই তুলে ধরা হোক না কেন, সরকার তা বোঝে না। দেশি বা বিদেশি বিজ্ঞানী, দেশি বা বিদেশি সংস্থা, এমনকি জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেসকো বা রামসার সবাই সরকারকে রামপাল দূষণের বিজ্ঞান বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে। ইউনেসকো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য মর্যাদা দিয়ে বিশ্বদরবারে যে সম্মান দিয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য অমূল্য ও বিরল সম্মাননা। রামপাল নিয়ে সরকারের বর্তমান অযৌক্তিক মনোভাব দেশি-বিদেশি জনগণকে যেভাবে ক্ষুব্ধ করেছে, সেভাবে ইউনেসকোও অসন্তুষ্ট। ইউনেসকো ২০১৭ সালে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সম্মেলনে সুন্দরবনকে বিপন্ন বা ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ের তালিকায় রাখলে তা পরে এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পূর্বশর্ত মনে করা যেতে পারে। সরকার দেশের বিদ্যুৎ উন্নয়নে মহেশখালী, মাতারবাড়ী, চট্টগ্রাম, পায়রা ও আরও অনেক স্থানে বৃহৎ কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র স্থাপনের যে পরিকল্পনা করেছে, তা দেশের জ্বালানি-সংকটের প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এ সবকিছুকে ছাপিয়ে কেবল একটি রামপাল প্রকল্প সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় কালো দাগ ফেলেছে। রামপাল প্রকল্প বাতিল না হলে ভবিষ্যতে এই কালো দাগ চিরস্থায়ী হয়ে ইতিহাসের পাতায় লেগে থাকবে।
ড. বদরূল ইমাম, অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.