রেহমান সোবহানের ‘অশান্ত স্মৃতিগুচ্ছ’

অধ্যাপক রেহমান সোবহানের স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থটি বেশ আগ্রহের সঙ্গেই হাতে নিয়েছিলাম। প্রচ্ছদের দিকে দৃষ্টি পড়তেই মনে প্রশ্ন জাগল, ‘লেখকের যে মুখচ্ছবি শোভা পাচ্ছে, তা একজন স্থিতধী, রসিক, প্রাজ্ঞ ভদ্রলোকের। এর স্মৃতি কেন অশান্ত বা উত্তাল হবে? বিশেষত, পুরো শিরোনামে যখন রয়েছে পরিপূর্ণতার ইঙ্গিত (Untranquil Recollections: The Years of Fulfilment)? প্রাথমিক এই কৌতূহল মিটবে, এই প্রত্যাশা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম এবং প্রথম অধ্যায় (যেখানে তিনি তাঁর পিতা-মাতা ও সহধর্মিণীদের পারিবারিক বিবরণ দিয়েছেন) শেষ করার পরই বুঝলাম, একটি ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে। বইপড়া আমার অভ্যাস কেবল নয়, নেশাও বলা যায়। ছোটবেলা থেকেই যেকোনো নতুন বই পেলে ‘গোগ্রাসে গিলে’ ফেলি। পরে পুরো বইটা (একেবারে অখাদ্য না হলে) ধীরে ধীরে আবার পড়ি। বিশেষ করে যেসব অংশ ভালো লেগেছে, সেসব জায়গা তাড়িয়ে তাড়িয়ে রসাস্বাদন করা আমার অভ্যাস। যেমনটা আগেই বলেছি, এই প্রথম তার ব্যত্যয় ঘটল। সেটা এতটাই যে এমনকি আমার ১০ বছর বয়সী নাতি মাহীম মন্তব্য করল, ‘দিদি, এ বইটা পড়তে আপনার এত সময় লাগছে কেন? এর চেয়ে কত মোটা মোটা বই তো আপনি দুই দিনেই শেষ করে ফেলেন!’
ধীরে পড়ার কারণ এই নয় যে বইটির বিষয়বস্তু দুর্বোধ্য অথবা বর্ণনারীতি বা ভাষা আকর্ষণীয় নয়। বরং উল্টোটাই সত্যি। অধ্যাপক সোবহানের স্মৃতিতে বহু বিচিত্র ঘটনার সমাবেশ; তাঁর বর্ণনা সরস, চিত্রল ও বর্ণময়, আর ভাষা? বহতা নদীর মতো তা পাঠককে অনায়াসে পৌঁছে দেয় লেখকের জীবননদীর বাঁক থেকে বাঁকে, বন্দর থেকে বন্দরে। এতই অনায়াস সেই যাত্রা, এমন সজীব সব স্মৃতিচিত্র যে নিজের অজ্ঞাতেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি আমি। মনের গহিনে ডুবে যাই নিজের শৈশব, বাল্য, কৈশোর ও যৌবনের বিভিন্ন মুহূর্তে, যখন আমারও প্রায় একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। কখনো প্রতিক্রিয়াও হয়েছে একই রকম, কখনো বা ভিন্ন। স্মৃতিরোমন্থন থেকে সংবিৎ ফিরে পেয়ে আবার পড়ায় মন দিয়েছি, এটাই পাঠের শ্লথগতির প্রধান কারণ। লেখকের স্মৃতিচারণায় অনুগামী হয়ে প্রথমেই বিস্মিত হতে হয় তাঁর স্মৃতির ঈর্ষণীয় ব্যাপ্তি, প্রখরতা ও গভীরতায়। যেমন প্রথম যে ঘটনার বর্ণনা তিনি দেন, সেটি মাত্র তিন বছর বয়সে ঘটেছিল।
প্রথম দিন স্কুলে গিয়েই বাড়ি ফেরত আসার প্রচেষ্টায় বাধা দেওয়ায় তিনি শিক্ষয়িত্রীর কবজিতে সুতীক্ষ্ণ দাঁতের কামড় বসিয়ে সুগোল যে নকশা এঁকেছিলেন এবং ওই (কু)কীর্তির জন্য অনিবার্য যে শাস্তি ভোগ করেছিলেন, তা এই প্রবীণ বয়সেও তাঁর স্মৃতিতে অম্লান। ‘ধন্য, ধন্য’, মনে মনে বলি। ঘটনার পর্যালোচনায় যে সরস ও তির্যক মন্তব্য করেন (‘শিল্প এবং স্বাধীনতার জন্য আমার প্রথম আত্মত্যাগ’) তাতে টক-মিষ্টি স্বাদ আছে কিন্তু তিক্ততা নেই। বস্তুত, পুরো গ্রন্থেই তিনি তাঁর রসজ্ঞান ও তির্যক উক্তিতে পারদর্শিতার প্রমাণ রেখেছেন বহু জায়গায়। কখনো ব্যঙ্গ করেছেন নিজেকে, কখনো অন্যকে; কিন্তু তাতে তিক্ত কোনো স্বাদ নেই। প্রকৃত জীবনরসিক লেখক প্রখর আবেগে তাড়িত হয়েছেন, কিন্তু আপনহারা হননি কখনো। দেশে-দেশান্তরে কেটেছে তাঁর বাল্যকাল, কৈশোর ও যৌবন। শিক্ষা নিয়েছেন কলকাতা ও দার্জিলিংয়ের বনেদি স্কুলে, লাহোরের বিশিষ্ট কলেজে এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বলা বাহুল্য, সবচেয়ে মধুর তাঁর কাছে কলকাতাবাসের স্মৃতি। কারণ, শৈশব ও বাল্যকাল কেটেছে সেখানে। রসনাবিলাসী লেখক তাঁর নানির অতুলনীয় রান্নার কিছু বিশেষ পদের কথা উল্লেখ করেন আর আমার মনে পড়ে যায় আমার নানুর রান্নার অপূর্ব স্বাদের কথা। অধ্যাপক সোবহানের মনের কথা বুঝি এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলি বিগত যুগের সেই সব রন্ধনশিল্পীর জন্য, যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রমে পরিবারের সবাইকে অমৃতের আস্বাদ দিয়েছিলেন। এক নিমেষেই সহমত হয়ে যাই, যখন তিনি হোস্টেলের অখাদ্য-কুখাদ্য খাওয়ার অসহ্য যন্ত্রণার কথা লেখেন। মনে পড়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উইমেন্স হলে (বর্তমানে রোকেয়া হল)
থাকার সময় কেমন করে দুই দিনের মধ্যেই বুয়াদের রান্না করা উৎকট গন্ধযুক্ত মাছ-মাংসের তরকারি খাওয়া এড়ানোর জন্য পুরো নিরামিষাশী হয়ে গিয়েছিলাম। আরও মনে পড়ে, প্রায়ই খাওয়ার সময় প্রতিভাদি (প্রতিভা মুৎসুদ্দি, বর্তমানে ভারতেশ্বরী হোমের কর্ত্রী) আদর করে একটু বেশি ভাজিটা বা ভর্তাটা পাতে দিয়ে দিতেন। গোয়েন্দাকাহিনি ও রহস্যরোমাঞ্চভরা বই পড়ার নেশা আমারও ছিল এবং আছে। তবে সিনেমা দেখার ইচ্ছা থাকলেও সব সময় তা পূর্ণ হয়নি। কারণ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লেখক কিশোর বয়সে দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে যেমন ঘুরে বেড়াতে পেরেছেন, আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে ঢুকে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় পড়তে যাওয়াই আমার জীবনে প্রথম একলা কোথাও যাওয়া। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দলেবলে বা কখনো কোনো বন্ধুর (পড়ুন বান্ধবী) সঙ্গে যে এখানে-সেখানে যাইনি, তা নয়। তার মধ্যে সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ছিল ভাসানী ন্যাপ প্রতিষ্ঠার সূচনা অনুষ্ঠান দেখার জন্য লাইলী আপার (কামরুন্নাহার লাইলী) এবং প্রতিভাদির নেতৃত্বে রূপমহল সিনেমা হলে যাওয়া।
বাবা সরকারি কর্মকর্তা বলে আমার ও সহপাঠিনী বশিরা বারি মালিকের জন্য কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কিন্তু ঐতিহাসিক একটি উপলক্ষে প্রত্যক্ষদর্শী থাকার ইচ্ছাও ছিল প্রবল। সুতরাং, জনা বিশেক ছাত্রীর সঙ্গী হয়েছিলাম দুজনে। লাইলী আপা একেবারে মিলিটারি কায়দায় কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন যে অবশ্যই সবচেয়ে পেছনের সারিতে বসতে হবে এবং বিশেষ ইশারা করা মাত্রই পেছনের সিঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে অপেক্ষমাণ রিকশায় উঠে পড়তে হবে। তাঁরা যে অঘটন আশঙ্কা করেছিলেন, তা সত্যিই ঘটেছিল এবং ইশারা মোতাবেক একছুটে সিঁড়ি বেয়ে নেমে রিকশায় উঠে পড়েছিলাম। পুরান ঢাকার কিছু অলিগলি ঘুরে রিকশাওয়ালা সেদিন আমাদের নিরাপদেই হলে পৌঁছে দিয়েছিল। অধ্যাপক সোবহানের লেখায় সেদিন বাইরে কী ঘটছিল, তার একটা বিবরণ পেলাম। কারণ, তিনি এক বিদেশি বন্ধুকে নিয়ে রূপমহলের বাইরে ছিলেন।বলা বাহুল্য, আমার জন্য এটা একটা বাড়তি পাওনা। গ্রন্থের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক অবশ্য এক উচ্চবিত্ত, রসনাবিলাসী, জীবনরসিক বালকের বিবিধ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমে এক দায়িত্ববান, বিবেকবান, সচেতন, অগ্রণী নাগরিক ও বিশিষ্টজনে পরিণত হওয়ার চিত্রটি। ছাত্র রেহমান সোবহান শরীরচর্চা ও ক্রীড়াঙ্গনের দক্ষতা প্রদর্শন পেছনে ফেলে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত হচ্ছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মজলিশে’ অংশগ্রহণ করে; তারপর ক্রমে অর্থনীতি থেকে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে তাঁর আগ্রহ বাড়ছে; দেশে ফেরার পর বিরাজমান রাজনৈতিক উত্তাপ স্পর্শ করছে তাঁকে; কেবল শিক্ষকতায় বা পারিবারিক দায়দায়িত্বে (অবাক হলেও সত্য যে তিনি এমনকি হাজারীবাগের একটি ট্যানারির দেখভালও করেছেন মালিকানাসূত্রে) আবদ্ধ না থেকে তিনি পাকিস্তানের দুই অংশে বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ও প্রতিবাদী হয়ে উঠছেন এবং সমাধানের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিচ্ছেন।
তারপর প্রায় অনিবার্যভাবেই যুক্ত হচ্ছেন সরাসরি স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে স্বাধীনতার সংগ্রামে পথচলায়—উপদেষ্টা হিসেবে, সচেতনতা সৃষ্টির অগ্রণী কর্মী হিসেবে এবং ১৯৭১-এর ভয়াল ২৫ মার্চের পর প্রথমে আত্মগোপন ও পরে দেশত্যাগ এবং তারও পরে স্বাধীন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও স্বীকৃতি লাভের জন্য বিশেষ দূত হিসেবে অবদান রাখছেন—এই উত্তরণ এক ব্যতিক্রমী অভিযাত্রা। লক্ষণীয় যে সবচেয়ে ভীতিকর মুহূর্তে তাঁর রসবোধ ও ঈষৎ তির্যক দৃষ্টিভঙ্গি সক্রিয় থাকে, যেমন দেশত্যাগের সময় তাঁর বর্ণনায় আমরা তাঁকে দেখি খাকি কুর্তা, চেক লুঙ্গি (বেল্ট দিয়ে পরা), পাঠানি চপ্পল পরিহিত অবস্থায়। তাঁর ভাষায়, এই পোশাকে তাঁকে ‘চকবাজারের একজন অবাঙালি কসাইয়ের মতো’ দেখাচ্ছিল। এই বিশেষ বেশ যে তাঁর চেহারার অবাঙালিত্বকে আরও নজরে পড়ার মতো করে তুলেছিল, তার বিপজ্জনক দিক নয় বরং কমিক দিকটি তাঁর নজরে পড়ে আর পাঠকও একটু না হেসে পারেন না। বলা বাহুল্য, এই রোমাঞ্চকর ও চিত্তাকর্ষক অভিযাত্রার বর্ণনা অত্যন্ত যৌক্তিক এবং প্রায় অনিবার্যভাবেই শেষ হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়, পরিবারের সঙ্গে তাঁর মিলন ও আনন্দ-উদ্দীপনায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। তৃপ্ত পাঠকের মনে হয় ‘মধুরেনসমাপয়েৎ’। তবে আমার একটু অতৃপ্তি বা আক্ষেপ রয়ে গেছে। একটি প্রশ্ন মনে খচখচ করে, যার ঠিক সদুত্তর খুঁজে পাই না। কেন রেহমান সোবহান শিক্ষাজীবনের শেষে ঢাকাতেই ফিরেছিলেন? পারিবারিক দায়িত্বই কি তাঁকে বাধ্য করেছিল? তবে যে কারণেই ফিরুন না কেন, এতে তাঁর ব্যক্তিজীবনে যেমন বৈচিত্র্য, রোমাঞ্চ আর পূর্ণতার স্বাদ এসেছে, তেমনি বাংলাদেশের সমাজও বিশেষত ছাত্রসমাজ উপকৃত হয়েছে নানাভাবে। তাঁকে ধন্যবাদ! আশা করি এবং প্রার্থনা করি তাঁর চিন্তা ও লেখনীর গতি অব্যাহত থাকবে এবং অচিরেই স্মৃতিচারণার দ্বিতীয় খণ্ডটি পাঠকের হাতে পৌঁছাবে।
ড. রওশন জাহান: গবেষক ও নারী অধিকারকর্মী। সাবেক সভাপতি, উইমেন ফর উইমেন।

No comments

Powered by Blogger.