যেসব সমস্যা তৈরি করবেন ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানামুখী সমস্যায় পড়বে। যেমনটা পড়বে গোটা বিশ্ব। প্রথম সমস্যাটি তৈরি করবে তার সীমাহীন অশালীনতা। আমেরিকা অনেক কিছুই দেখেছে, তবে নারীর প্রতি ঘোরতর ঘৃণা প্রদর্শনকারী একজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্টকে এর আগে দেখেনি। নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯২ সালে স্থপতি ফিলিপ জনসনের সঙ্গে এক কথোপকথনে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘তাদের আবর্জনার মতো বিবেচনা করতে হবে।’ তিনি এখনও তাদের বিরক্তিকর জীব হিসেবে দেখে থাকেন। সমস্যা তৈরি করবে তার নির্লজ্জ বর্ণবাদী চরিত্রও। তার প্রথম স্ত্রীর মতে, ট্রাম্প হলেন সেই ব্যক্তি যিনি তার বেডসাইড টেবিলে হিটলারের ভাষণগুলো সংগ্রহে রেখেছেন এবং যিনি হাসতে হাসতে কৃষ্ণাঙ্গদের বলেন ‘অলস’, মেক্সিকানদের উপহাস করেন ‘ধর্ষক’ বলেন এবং গোটা মুসলমান জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসবাদের জন্য দায়ী বলে গণ্য করেন।
তার ইহুদিবিদ্বেষও সমস্যার কারণ হবে। গত বছর ডিসেম্বরে রিপাবলিকান জিউইশ কোয়ালিশনকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে সমর্থন দিচ্ছ না, কেননা আমি তোমাদের টাকা চাই না।’ সমস্যা দেখা দেবে তার অজ্ঞতার কারণেও- শুধু বিশ্বের জন্য নয়, তার নিজ দেশের জন্যও। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্রিটেনের সদস্যপদ থাকা-না থাকা নিয়ে গণভোটের কয়েকদিন আগেও তিনি ‘ব্রেক্সিট’ শব্দটির মানে জানতেন না। আর এই চলতি মাসে জানা গেছে, তিনি জানেন না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে মোট কয়টি অনুচ্ছেদ আছে। তবে সবচেয়ে মারাত্মক ও উদ্বেগজনক সমস্যাটি হবে, বিশ্বের অন্যতম প্রধান শক্তিধর দেশটির নেতার ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করবে কিছু সরলীকৃত ধারণা। ফলে ‘আমেরিকাকে আবারও মহান’ করার প্রতিশ্র“তি সত্ত্বেও ট্রাম্পের ওইসব সরলীকৃত ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রগতি ও নিরাপত্তার ভিত্তিকে দুর্বল করে দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ সংক্রান্ত পুনরালোচনা নিয়ে গত মার্চে তার যে ধারণা প্রকাশ পেয়েছে সেটার কথাই ধরুন। তার ধারণাটি নির্বোধের মতো।
বিশ্বে মুদ্রা মজুদের ক্ষেত্রে যে যুক্তরাষ্ট্র একচেটিয়া অবস্থান ধরে রেখেছে, ঋণ ‘পুনরালোচনার’ ক্ষেত্রে সে দেশের সরকারের নাকি কিছুই করার নেই! তবে ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প যখন তার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করবেন, তখন এর পরিণতি হবে বিপর্যকর। ক্লিভল্যান্ডে মনোনয়ন দৌড়ে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটার কথাই ধরুন। ন্যাটোর কোনো সদস্যরাষ্ট্র হুমকির সম্মুখীন হলে জোটের অন্য দেশগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাকে সমর্থন দেবে- সংস্থাটির এই নীতি তিনি পুনর্বিবেচনা করবেন। উল্লেখ্য, এই প্রক্রিয়া বাল্টিক দেশগুলোকে স্বাধীন রেখেছে। ট্রাম্পের মতে, এর ফলে রাশিয়া বিশ্বে তার হুমকি প্রদর্শনের বিষয়টি পুনঃপরীক্ষা করবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে তার সীমানার সহজ সমন্বয় ঘটাবে অথবা অন্যদের দ্বারা ‘জিম্মি হিসেবে আটক’ কোনো সংখ্যালঘু রুশভাষীর উদ্ধারে এগিয়ে আসবে। বাস্তবতা হল, এর ফলে পোল্যান্ড বা ইউক্রেনে হামলা করতে পারে রাশিয়া। রাশিয়া কেনইবা ন্যাটো সদস্য ও তার প্রতিবেশীদের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকবে? এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপান বা অন্য কোনো পশ্চিমা মিত্রের সঙ্গেও যুদ্ধ বাধাতে পারে রাশিয়া। ট্রাম্প সুযোগ পেলেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ­াদিমির পুতিনের প্রশংসা গাইতে ভোলেন না।
একবার তিনি সিএনএনের ল্যারি কিংকে (তার বেস্টসেলার ‘থিংক বিগ’ ও ‘কিক অ্যাসে’র প্রচারকালে) বলেছিলেন, পুতিন একজন মহান নেতা, যিনি ‘একটি মহান কাজ করে যাচ্ছেন... রাশিয়ার পুনর্গঠন’। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত পুতিন স্বাক্ষরিত একটি মন্তব্য প্রতিবেদনকে ট্রাম্প ‘মাস্টারপিস’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, যেখানে সিরিয়ায় মার্কিন নীতির সমালোচনা করা হয়েছিল। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে, ইউক্রেন নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরিস্থিতির প্রায় দুই বছর পর তিনি ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, নেতৃত্বের জন্য পুতিন ‘এ’ পাওয়ার যোগ্য। সত্য হল, রাশিয়ার সঙ্গে পুতিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেক পুরনো ও ঘনিষ্ঠ। বর্তমান শতকের প্রথম দশকের শুরুতে মার্কিন ব্যাংকগুলো যখন ট্রাম্পকে কালোতালিকাভুক্ত করে, তখন তিনি রুশ উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ টরন্টো, সোহো ও পানামায় সরিয়ে নেন। ট্রাম্প নিজের স্বার্থে ও নানা সুবিধার জন্য রুশ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন এবং নিজের প্রভাব খাটিয়েছেন- এ সংক্রান্ত অসংখ্য তথ্য এখন বেরিয়ে আসছে। ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ী হলে প্রকৃতই তা হবে আতংকজনক একটি ব্যাপার। সমস্যা শুধু তার অশালীনতা, নারী বিদ্বেষ, বর্ণবাদ ও অজ্ঞতা নয়। এটি আমেরিকার প্রতি তার বিশ্বাসঘাতকতার কারণ হয়েও দাঁড়াতে পারে।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে ভাষান্তরিত
বার্নার্ড-হেনরি লেভি : ফরাসি দার্শনিক ও লেখক

No comments

Powered by Blogger.