গণতন্ত্রের বেদিতে উৎসর্গিত এক প্রধানমন্ত্রী by সাজেদুল হক

আবেগ। কান্না। প্রত্যাশিত কিন্তু অভাবনীয় এক ঘোষণা। ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে রচিত হলো গণতন্ত্রের বেদিতে এক প্রধানমন্ত্রীর উৎসর্গিত হওয়ার নতুন ইতিহাস। আর বিশ্ববাসী দেখলো রাজমঞ্চ থেকে এক রাজনীতিবিদের বিদায়ের আখ্যান। ছয় বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বকালে যিনি বারবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। এই তো কয়দিন আগেই স্ত্রী সামান্থা ক্যামেরনের জন্য পুরনো একটি গাড়ি কিনে আলোচনায় এসেছিলেন। সমালোচিত হয়েছিলেন পিতার নাম পানামা পেপারসে প্রকাশিত হওয়ার পর। ছবিটির সূত্র জানা নেই। তবে ট্রেনে জনমানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছেন ডেভিড ক্যামেরন- এমন একটা ছবি প্রায়ই দেখা যায়। যা একজন প্রবল প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রীর সাদাসিধে জীবনযাপনের দিকেই ইংগিত করে। রাজনীতিতে তার অভিষেক ছিল চমক জাগানিয়া। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তিনি কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন। কিছু বছর পর ২০১০ এবং ১৫ সালে কনজারভেটিভ পার্টির জন্য নিয়ে আসেন অভাবনীয় বিজয়। যা তাকে মার্গারেট থ্যাচারের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী কনজারভেটিভ নেতায় পরিণত করে। অক্সফোর্ডপড়ুয়া ক্যামেরন খ্যাতি পেয়েছিলেন শেষ মুহূর্তে যেকোনো সমস্যার সমাধান দেয়ার কারিগর হিসেবে। ফোন হ্যাকিং কেলেঙ্কারি এবং স্কটল্যান্ডের গণভোট উতরে যান তিনি। ছেলে ইভানকে হারানো ব্যক্তি ক্যামেরনের জীবনের সবচেয়ে বিয়োগান্তক অধ্যায়।
 রাজনীতিবিদ ক্যামেরন শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বাজিটিতে হেরে গেলেন। বৃটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা-না থাকা প্রশ্নে বিতর্কের মধ্যে গণভোটের আয়োজন করেছিলেন তিনি। এ ভোটকে কেন্দ্র করে দৃশ্যত দুই ভাগ হয়ে গেছে বৃটেন। ভোটের হারেও তার প্রমাণ। ৫২ বনাম ৪৮। নেশন ডিভাইডেড- এ শিরোনাম ইকোনমিস্ট সাধারণত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ব্যাপারেই ব্যবহার করতো। এবার বৃটেনের ব্যাপারেও ব্যবহৃত হয়েছে তা। তবে বিয়োগান্তক এ ভোট ঐক্যবদ্ধ বৃটেনের ভবিষ্যৎকেও প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে। গণভোটের আওয়াজ উঠেছে স্কটল্যান্ড-আয়ারল্যান্ডেও।
তবে এই পরিণতির জন্য ডেভিড ক্যামেরন তার নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকেউ দায়ী করতে পারেন না। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা-না থাকা নিয়ে নিয়ে তার দলের ভেতরে ওঠা বিতর্কের পটভূমিতে ২০১৩ সালে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন, পুনরায় নির্বাচিত হতে পারলে এ প্রশ্নে তিনি গণভোটের আয়োজন করবেন। সম্প্রতি লেবার পার্টির এমপি জো কক্সের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর গণভোটের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি উঠেছিল। বিপুল সংখ্যক মানুষ এ ব্যাপারে ডেভিড ক্যামেরনের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু জবাবে ক্যামেরন বলেছিলেন, এখন আর পেছনে ফেরার উপায় নেই।
প্রাচীন গ্রিসে জন্ম নেয়া গণতন্ত্রকে ইতিহাসে বারবার পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে। গণতন্ত্রের একটি প্রধানতম দুর্বলতা হচ্ছে- সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত ইতিহাসে সবসময় সঠিক হিসেবে প্রমাণিত হয় না। কখনো কখনো দেখা গেছে, তা ভুল এবং ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল গুনতে হয় পুরো মানবজাতিকেই। বেক্সিট ভোট ইউরোপজুড়েই হাহাকার তৈরি করেছে। দিনটিকে ইউরোপের ইতিহাসে একটি দুঃখজনক দিন হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন পর্যবেক্ষকরা। তবে গণতন্ত্রে জনগণের অভিপ্রায়ই যে শেষ কথা পদত্যাগের ঘোষণা দিতে এসে তা মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের শুধু সংসদীয় গণতন্ত্র আছে তাই নয়, আমাদের শাসন ব্যবস্থা কেমন হবে সে প্রশ্নেও মাঝে মাঝে জনগণকে জিজ্ঞাসা করা উচিত। আর আমরা সেটাই করেছি। বৃটিশ জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে। তাদের ইচ্ছাকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
গণতন্ত্রের বেদিতে নিজের ইচ্ছা-অভিপ্রায়কে কবর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। যা শুধু বৃটেন নয়, সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রসেবীদের জন্য এক ধরনের শিক্ষা। আর ক্যামেরন পৃথিবীর রাজনীতিবিদদের এ বার্তাও দিলেন, কথা দিলে তাদের কথা রাখতে হয়। কোন কোন সমর নায়ক ও রাজনীতিবিদ বলার চেষ্টা করেন, গণতন্ত্র একেক দেশে একেক রকম হবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, গণতন্ত্রের রকমারি হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ভালো হোক, মন্দ হোক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছাই গণতন্ত্রের শেষ কথা। এর কোন ব্যতিক্রম নেই।

No comments

Powered by Blogger.