হিলারির ফাঁড়া কাটেনি

আগামী মঙ্গলবার, ৭ জুন নিউজার্সি ও ক্যালিফোর্নিয়াসহ মোট ছয়টি অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্রেটিক দলের দুই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বাছাই পর্যায়ে তাঁদের শেষ বড় ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। এরপর বাকি থাকবে একমাত্র ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া, পরের মঙ্গলবার ১৪ এপ্রিল। কিন্তু তার আগেই দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কে হবেন, সে কথা নিশ্চিত হয়ে যাবে। হিলারি ক্লিনটনই যে সেই প্রার্থী, সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। দলের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও দলীয় কর্মকর্তা, যাঁরা সুপার ডেলিগেট হিসেবে ভোটের অধিকার রাখেন, তঁারা বিপুল সংখ্যাধিক্যে হিলারির প্রতি তাঁদের সমর্থন ঘোষণা করেছেন। দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেলেও হিলারির ব্যাপারে মার্কিন জনগণের এক বিপুল অংশের মধ্যে এখনো সন্দেহ রয়ে গেছে। হাফিংটন পোস্ট–এর গৃহীত সর্বশেষ জনমত জরিপ অনুসারে, দেশের মাত্র ৪১ শতাংশ মানুষের তাঁর ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। তাঁর প্রতি নেতিবাচক, এমন মানুষের সংখ্যা ৫৫ শতাংশ। এক মাস ধরেই হিলারির জনপ্রিয়তার এই নিম্ন হিসাব অপরিবর্তিত রয়েছে।
হিলারির ব্যাপারে দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তাঁকে বিশ্বাস করা যায় না। ফক্স নিউজের এক জরিপ অনুসারে, দেশের মাত্র ৩১ শতাংশ মানুষ মনে করেন হিলারি সৎ ও বিশ্বাসযোগ্য। ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুলনায় তাঁর মোদ্দা সমর্থন ভালো হলেও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নে ট্রাম্প তাঁর তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় রয়েছেন। হিলারির জন্য সবচেয়ে ভয়ের কথা, দেশের স্বতন্ত্র ভোটার—যাঁরা ডেমোক্রেটিক বা রিপাবলিকান বা অন্য কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তাঁরা এখন পর্যন্ত হিলারির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। ফক্স জরিপেই দেখা গেছে, স্বতন্ত্র ভোটারদের মধ্যে ৮০ শতাংশ হিলারি ক্লিনটনের ব্যাপারে আস্থা রাখতে পারছেন না। হিলারি ক্লিনটনের শিবির থেকে অবশ্য বারবার বলা হচ্ছে, মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পর অবস্থা বদলে যাবে। বার্নি স্যান্ডার্সের প্রতি যেসব তরুণ ভোটাররা সমর্থন জানিয়েছেন, তারাও হিলারির প্রতি হাত বাড়াবেন। কারণ, ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট না করার ব্যাপারে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই।
জনমত জরিপেও সে কথা ধরা পড়েছে। রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন নিশ্চিত করার পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কিঞ্চিৎ বেড়েছিল। পাশাপাশি হিলারির সঙ্গে তাঁর ব্যবধানও কমে এসে প্রায় সমানে সমান হয়ে এসেছিল। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে ট্রাম্প তাঁর সমর্থন খুইয়েছেন। একাধিক জনমত জরিপের সর্বশেষ গড় হিসাব অনুসারে হিলারি এই মুহূর্তে ৫ পয়েন্টে এগিয়ে আছেন। রিপাবলিকান কৌশলবিদেরা অবশ্য উল্টো কথা বলছেন। জুলাই মাসে রিপাবলিকান সম্মেলনে ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে দলের প্রার্থী ঘোষিত হওয়ার পর দলের মধ্যে তাঁর ব্যাপারে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে, তা বদলে যাবে। সব ধরনের রিপাবলিকান কোনো অবস্থাতেই আরেকজন ক্লিনটনকে হোয়াইট হাউসে দেখতে চান না। হিলারির বিজয় যে ওবামার তৃতীয় দফা, সে যুক্তি দেখিয়ে ইতিমধ্যে প্রচার অভিযান শুরু হয়েছে, তার প্রভাবেও দ্বিধাগ্রস্ত রিপাবলিকানরা দলের নির্বাচিত প্রার্থীর প্রতি সমর্থন জানাবেন। হিলারির জন্য সবচেয়ে প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে, ফিলাডেলফিয়ায় দলের সম্মেলনে বার্নি স্যান্ডার্স ও তাঁর সমর্থকদের অসন্তোষ সামাল দেওয়া।
এ দেশের বামপন্থীরা, বিশেষত যাঁদের বয়স ৩০-এর নিচে, তাঁরা বিপুলসংখ্যায় স্যান্ডার্সের সমর্থনে এক রাজনৈতিক বিপ্লবের সূচনা করেছেন। হিলারি ও তাঁর ‘দুর্নীতিবাজ সুপার ডেলিগেটরা’ স্যান্ডার্সের কাছ থেকে নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন, এই অভিযোগে হিলারির ব্যাপারে তাঁদের ক্রোধ ও অনাস্থা এখনো বিপুল। ইরাক প্রশ্নে হিলারি বুশ ও চেনির যুদ্ধাভিযানের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, সেই ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ তঁারা এখনো ভোলেননি। হিলারির ওয়াল স্ট্রিটের সঙ্গে মাখামাখি, যে কথা স্যান্ডার্স গত সাত-আট মাস অহোরাত্রি জপে গেছেন, তাও এই সাবেক ফার্স্টলেডির ব্যাপারে অবিশ্বাসের সৃষ্টি করেছে। স্যান্ডার্স সমর্থকদের নিজের পক্ষে টানার জন্য হিলারি গত কয়েক মাসে নানাভাবে নিজেকে বদলাতে চেষ্টা করেছেন। একসময় উন্মুক্ত বাণিজ্যের তিনি অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন, এখন তিনি তার বিরুদ্ধে। একসময় আপত্তি জানালেও ঘণ্টাপ্রতি ১৫ ডলার ন্যূনতম বেতনের ব্যাপারেও তিনি সমর্থন জানিয়েছেন। স্যান্ডার্সের দেখাদেখি সরকারি কলেজে বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগেরও পক্ষে তিনি।
প্রায় সোয়া কোটি অবৈধ অভিবাসীর বৈধকরণের ব্যাপারেও তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। স্যান্ডার্স নিজে কি করবেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়, তবে ট্রাম্পকে পরাস্ত করার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দলের নির্বাচনী ইশতেহারে তাঁর কর্মসূচি যদি অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে স্যান্ডার্স সম্ভবত হিলারির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করবেন। এমনকি হিলারির নির্বাচনী প্রচারণায় তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। স্যান্ডার্সে এখনো দো-মনা অবস্থা থাকলেও বামপন্থীদের কাছে অতি জনপ্রিয় অপর ডেমোক্রেটিক রাজনীতিক, সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন অত্যন্ত শক্তভাবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। হিলারির প্রতি তিনিও নিজের সমর্থন প্রকাশ করেননি, কিন্তু ফিলাডেলফিয়ার সম্মেলনের পর সে অবস্থাও বদলাবে বলে ভাবা হচ্ছে। কোনো কোনো ডেমোক্রেটিক কৌশলবিদ আশা করছেন, হিলারি তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে এলিজাবেথ ওয়ারেনকেই বেছে নেবেন। তাহলে সেটি হবে সত্যিকারের ‘ড্রিম টিম’।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.