সম্পদপূর্ণ নরক!

বিভিন্ন দেশ ঘুরতে ঘুরতে মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ঠিক ৬৭০ বছর আগে বাংলার মাটিতে এসেছিলেন। তাঁর সফরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা সিলেটে হজরত শাহজালালের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার। মহান সুফির অলৌকিক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দেখে তিনি বিস্মিত হন, সে কথা তিনি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত সফরনামায় লিখে গেছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ তাঁর ‘ইবনে বত্বূত্বা এবং তাঁহার বাঙ্গালা ভ্রমণ’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘ইবনে বত্বূত্বা ইসলামের উন্নতির যুগের শেষ সময়ের একজন ভ্রমণকারী।’ তিনি মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, কেরালার কালিকট ভ্রমণ করে আবার মালদ্বীপ যান। ড. শহীদুল্লাহর ভাষায়: ‘সেখান হইতে জাহাজে রওয়ানা হইবার ৪৩ দিন পরে বাঙ্গালা দেশের সপ্তগ্রাম বন্দরে উপস্থিত হইলেন। তৎপরে নদীপথে কামরূপ গিয়া শঙ্খ জলালুদ্দীন তবরিজীর সহিত সাক্ষাৎ করেন। সেখান হইতে সোনারগাঁয় উপস্থিত হন। খ্রীঃ  ১৩৪৬-৪৭ (খ্রিষ্টীয়) অব্দে ইবনে বত্বূত্বা বাঙ্গালায় আসিয়াছিলেন।’ বতুতার সফরনামার ১৩ অধ্যায়ে ‘বঙ্গালহ’ (বঙ্গদেশ) শীর্ষক একটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। তার শুরু এ রকম: ‘বঙ্গালহ এক বহু বিস্তৃত দেশ। চাউল প্রচুর পরিমাণে জন্মে। এত সস্তা আমি আর কোনো দেশে দেখি নাই। কিন্তু এই দেশ ভালো নয়, অন্ধকারময়। এই জন্য খোরাসানের থেকে ইহাকে “দোযখ্‌ পুর্‌ নি’য়ামত” (সম্পদপূর্ণ নরক) বলে। সেখানে এক রূপার দীনারে ২৫ রতল [৩৫০ কেজির সমান] চাউল পাওয়া যায়। ... ৩০ গজ লম্বা তুলার কাপড়ের দাম ২ দীনার এবং সুন্দরী বাঁদীর দাম ১ সোনার দীনার (যাহা পশ্চিম দেশের ২ দীনারের সমান)।
আমি এই মূল্যে “আশুরহ” নামে একটি বাঁদী কিনিয়াছিলাম। সে খুব সুন্দরী ছিল। আমার একজন সঙ্গী লুলু নামে একটি অল্প বয়সের গোলাম ২ দীনারে খরিদ করিয়াছিল।’ [অনুবাদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌। মূল আরবি থেকে তরজমা]। সেকালের বাংলার দাসী-বাঁদীরা একালের ছুটা বুয়াদের মতো ছিল না যে বাসন-পেয়ালা মেজে ঘরদোর ঝাড়ু দিয়ে দুপুর-দুপুরই বাড়ি চলে যাবে। তাদের মনিবের কাছে থাকতে হতো চব্বিশ ঘণ্টা। ইবনে বতুতার বাঁদী আশুরহ যে ‘খুব সুন্দরী ছিল’ সে কথা তাঁর পাঠককে না জানিয়ে তাঁর মন ভরেনি। এবং বাঁদীটি যে ১৫-১৬ বছর বয়সী ছিল তা আমরা অবশ্যই ধরে নিতে পারি। তাকে বতুতার সব রকম প্রয়োজন পূরণ করতে হতো, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। শুধু দু-তিনখানা রুটি সেঁকে একটু হাঁস-মুরগি বা কবুতরের মাংস রান্না করে দিয়েই সে তার দায়িত্ব শেষ করত না। তবে একটি জিনিস লক্ষণীয়, তাঁর খুব সুন্দরী বাঁদীটির দাম ছিল এক দিনার, আর তাঁর সঙ্গীর পুরুষ গোলামটির দাম ছিল দুই দিনার! ঠিক এখন যেমন ইটভাটায় হোক বা নির্মাণপ্রতিষ্ঠানে হোক বা কল-কারখানায় হোক একই কাজে নারী শ্রমিকের মজুরি পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে কম। যা হোক, বতুতা যা লিখেছেন তা এখন লিখলে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গ্রেপ্তার করা হতো। এবং রিমান্ড রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ১৫ দিন চাইলে অন্তত ৮ দিন মঞ্জুর হতো। তিনি পৌনে সাত শ বছর আগে বলেছেন ‘এই দেশ ভালো নয়, অন্ধকারময়’। আমি তাঁর পক্ষের উকিল হলে বলতাম, তিনি এই দেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে ‘ভালো নয়’ বলেননি, তিনি দেশের মানুষের কথা বলেছেন। দেশ একটি জড়বস্তু, তার ভালো-মন্দ কী! দেশের সুনাম-দুর্নাম সবই নির্ভর করে দেশটির মানুষের আচার-আচরণ-আখলাকের ওপর। বতুতা চালাক কিছু কম ছিলেন না। যা বলার তা নিজে বলেননি, খোরাসানের লোকের মুখে বসিয়ে দিয়েছেন। খোরাসান পারস্যের একটি প্রদেশ, সেখানকার কোন লোক নাকি কবে বলেছে, বাংলাদেশটা ‘দোজখ্‌ পুর নি’য়ামত’ বা সম্পদপূর্ণ নরক। সেই সাত-আট শ বছর আগে খোরাসানিদের কেউ যদি তা বলে থাকে, তার সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ কতটা? বাঙালির কী কী আচরণ দেখে মরক্কোর বতুতা বা ইরানের খোরাসানি অমন নিন্দাসূচক বা দেশদ্রোহমূলক মন্তব্য করেছিলেন, তা আমাদের পক্ষে এখন বলা সম্ভব নয়।
তবে এখন যদি তাঁরা আসতেন সফরে, তাহলে দিন তিনেক থেকেই বলতেন, ‘বঙ্গালহ্‌ দেশটা হলো জুলুমপুর নিয়ামত’ অর্থাৎ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হলো সম্পদপূর্ণ নির্যাতনের দেশ। অথবা সরকারি লোকদের পরিভাষায় বলতেন নিম্নমধ্যম আয়ের ‘লানৎপুর নিয়ামত’—অপমান-লাঞ্ছনা-গঞ্জনার দেশ। এখানে সত্য, ন্যায় ও মূল্যবোধের পারসেনটেজ কী, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই; সরকারি নেতা, কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবেত্তারা ক্যালকুলেটর নিয়ে গুনতে থাকেন জিডিপির পারসেনটেজ। অপরাধী বা অন্যায়কারীর শাস্তি দেওয়ার বিচিত্র প্রথা মানুষ নিজেই উদ্ভাবন করেছে, বিধাতা শিখিয়ে দেননি। কান ধরে ওঠবসের প্রথাটা পৃথিবীর সব জাতির মধ্য থেকে উঠে গেলেও বাংলাদেশে শুধু বাঙালিদের মধ্যেই তা রয়ে গেছে। একজন মানুষ তার পেশা ও সামাজিক অবস্থান যা-ই হোক, তাকে শত শত মানুষের সামনে কান ধরে ওঠবসে বাধ্য করা আদিম বর্বরতাকেই শুধু স্মরণ করিয়ে দেয়। আমি প্রধান শিক্ষকের শাস্তির ঘটনাটিকে দেখছি অন্যভাবে। আমি শুধু দণ্ডদাতা স্বনিয়োজিত বিচারককেই ধিক্কার দেব না, যাঁরা দৃশ্যটি উপভোগ করেছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তাঁরাও সমান অপরাধী। একজন মানুষও কি সেদিন সেখানে ছিল না যে মৃদু প্রতিবাদ করে বলতে পারত, আপনি থামুন, এভাবে তাকে শাস্তি দেবেন না? সে কথা বলার পর তিনি যদি অপমানিত হতেন, সেই অপমান হতো খুবই গৌরবের। মনুষ্যত্ব রক্ষায় যদি কাউকে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়, তাতে লজ্জার কিছু নেই, বরং তা অত্যন্ত প্রশংসার যোগ্য। মানুষকে অপমান করার প্রতিভা বাঙালির সীমাহীন। মারামারি করার শক্তি বিধাতা বাঙালির শরীরে দিয়েছেন অপরিমেয়। শৈশব থেকেই সে অন্যকে আঘাত করার কৌশলগুলো রপ্ত করে। বঙ্গসন্তানেরা ছোটবেলায় খেলার সাথিকে দেয় খামচি। বেশি রেগে গেলে দাঁত দিয়ে কামড়ায়। প্রতিটি অঙ্গ সে ব্যবহার করে মারামারিতে। হাতের প্রয়োগই প্রবল। কিল-ঘুষি-থাপ্পড়। তর্জনী ঢুকিয়ে সে মনের আনন্দে চোখ উপড়ায়। অন্য জাতির চেয়ে পায়ের প্রয়োগ বাঙালিই বেশি করে থাকে। মানুষকে লাথি মেরে তার এতই আনন্দ, যা ফুটবল খেলোয়াড় বলে লাথি দিলেও পায় কি না সন্দেহ। তা ছাড়া, লাঠিসোঁটা থেকে শুরু করে ছুরি-বন্দুক-পিস্তল তো আছেই। যাকে অপমান করা হলো তার পেশা-পদবি, বংশপরিচয়, ধর্মীয় পরিচয় কি তার চেয়ে বড় কথা সে মানুষ। আমি প্রতিদিন গোটা পনেরো পত্রিকা কমবেশি পাঠ করি। এমন দিন নেই, যেদিন হত্যা-ধর্ষণের বাইরে মানুষকে অপমান করার সংবাদ না থাকে। অপমানিত ও লাঞ্ছিতের পেশাগত পরিচয় বিচিত্র। যেমন, গত কিছুকালের মধ্যে প্রবলের হাতে এবং পায়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের কেউ স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষক, মাদ্রাসার মোদাররেস, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত, গণমাধ্যমের কর্মী, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা প্রভৃতি নানা পেশার শুধু নন, নানা ধর্মের মানুষ। তাঁদের কেউ চড়-থাপ্পড়, কেউ লাথি, কেউ-বা লাঠিসোঁটার মার খেয়েছেন অসংখ্য মানুষের সামনে। অন্যকে অপমান করতে বাঙালির মুখ থেকে এমন মধু নিসৃত হয়, যা শুনলে শয়তান পর্যন্ত কানে আঙুল দিয়ে দৌড়ে পালায়। নারী অপহরণ এবং নারীর ওপর যৌনপীড়ন হাজার বছর আগেও যে বাঙালি সমাজে ছিল, তার সাক্ষ্য চর্যাপদ ও বৌদ্ধ দোঁহাতে পাওয়া যায়। যুবতী বউকে একা ঘরে রেখে সেকালেও কৃষক মাঠে যেতে চাইত না বা জেলে মাছ ধরতে নদীতে যেত না, পাছে ফিরে এসে দেখে বউ নেই। আজ এক কিশোরী স্কুলে যাবে নির্বিঘ্নে, সে উপায় নেই। তার যাত্রাপথের আশপাশে সানগ্লাস পরে কেউ কাত হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধ ঝাঁকায়, শিস দেয়, অথবা অশ্লীল বাক্যবাণ নিক্ষেপ করে। কখনো পিছে পিছে আসে ভীতিকর যান মোটরসাইকেল। কখনো ধঁা করে টান মেরে ওড়নাটা খুলে নিয়ে যায় কোনো ক্যাডারের শিষ্য। কেউ তার প্রতিবাদ করলে তার অপমান ও লাঞ্ছনার শেষ নেই। অপমানও ভালো, প্রতিবাদ করে প্রাণ দিতে হচ্ছে অনেককে। গত চার মাসে সে রকম প্রাণ দিয়েছেন অন্তত পাঁচজন। সব সংবাদ পত্রপত্রিকায় আসে না। যে মানুষ অপমানিত হয়, সে কে? এবং যে মানুষ অপমান করে সে-ইবা কে? যে অপমানিত হয় অবধারিতভাবে সে দুর্বল। শারীরিকভাবে হোক বা সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে হোক। যে বা যারা অপমান করে, সে বা তারা প্রবল। কবি ভাবের আবেগে বলেছেন বটে, ‘দুর্বলেরে রক্ষা করো দুর্জনেরে হানো’, কিন্তু বাংলাদেশে চিরকাল দুর্জন রক্ষা পেয়েছে এবং দুর্বলকে হানা হয়েছে আঘাত। শারীরিক আঘাত হোক বা অপমানের মানসিক আঘাত হোক। লাঞ্ছিত শিক্ষক শ্যামল কান্তির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দণ্ডদাতার অঙ্গুলিহেলনে ওঠবসের সময় আমজনতার বাইরে সেখানে আর কারা ছিল? তিনি বললেন, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ছিলেন। তখন নিজেকে প্রশ্ন করি: তাঁদের বিবেক কোথায় ছিল? টিভির ফুটেজ দেখে তাঁদের ডেকে সরকারের জিজ্ঞেস করা উচিত, তাঁরা নিজেদের মানুষ মনে করেন কি না?
খোরাসানির কথা বাদই দিলাম, ইবনে বতুতা বলেছেন, দেশটা ভালো নয়, অন্ধকারময়। আমরা তা মানতে বাধ্য নই। ৭০০ বছর আগে বঙ্গীয় সমাজ অন্ধকারময় থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু গত ৫০০ বছরে অসংখ্য বাঙালি মনীষী আলো জ্বেলেছেন। তাঁরা সমাজের সব জায়গার অন্ধকার দূর করতে পারেননি। তা যদি পারতেন তাহলে প্রতিদিন যা ঘটছে তা ঘটত না। বাংলাদেশে ধান-পাট, তেল-গ্যাস-কয়লাসহ বহু সম্পদ রয়েছে। আমরা একে ‘সম্পদপূর্ণ নরক’ বলব না। বেহেশতের মতো দেশও আমরা চাই না। আমরা চাই সুসভ্য বসবাসযোগ্য এক বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.