রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে বাংলা গান

সেতার বাজাচ্ছেন পণ্ডিত রবিশঙ্করের মেয়ে আনুশকা
শঙ্কর। ছবি: ব্লুজ কমিউনিকেশনসের সৌজন্যে
লন্ডনের শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতিচর্চার পীঠস্থান ‘রয়্যাল অ্যালবার্ট হল’-এ গত রোববার বসেছিল শাস্ত্রীয় সংগীত ও বাংলা গানের আসর। এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান এই অভিজাত হলে কোনো অনুষ্ঠান করল। আয়োজক প্রতিষ্ঠানের নাম ব্লুজ কমিউনিকেশনস লিমিটেড। ইংল্যান্ডের লন্ডন নগরীর সাউথ কেনসিংটন এলাকায় অবস্থিত বিশ্বখ্যাত রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে পরিবেশনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন তাবত দুনিয়ার শিল্পীরা। গত রোববার সন্ধ্যায় এই হলেই বসল ‘এ ক্ল্যাসিকাল ওডিসি—এ ট্রিবিউট টু মায়েস্ত্রো রবিশঙ্কর’ শীর্ষক মার্গ সংগীতের আসরটি। মাত্র পাঁচ ঘণ্টার আয়োজন। কিন্তু তার ব্যাপ্তি বিশাল। বাংলার পঞ্চকবির গান গাইলেন বাংলাদেশের দুই শিল্পী লুভা নাহিদ চৌধুরী ও অদিতি মহসিন। যন্ত্রে সুর তুলে শ্রোতাদের বিমোহিত করলেন ভারতের বিখ্যাত বাজিয়েরা। ভক্তি, প্রেম, ভালোবাসা, বিষাদ কিছুই বাদ গেল না। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পীদের এ এক অনন্য পরিবেশনা। ৩৬০ ডিগ্রি গোলাকার বিশাল গম্বুজের মতো এই মিলনায়তনের তিন দিকে দর্শকসারি। একদিকে মঞ্চ। মঞ্চের ঠিক ওপরেই বড় পর্দায় সরাসরি দেখা যাচ্ছে অনুষ্ঠান। ১৩৫ ফুট উচ্চতার সুবিশাল এই মিলনায়তনে থরে থরে সাজানো গ্যালারি উঠে গেছে পাঁচতলা পর্যন্ত। হলভর্তি দর্শক। সন্ধ্যা ছয়টা বাজতেই নিভে গেল গ্যালারির বাতি। মঞ্চের আলো তখন আরও উজ্জ্বল। শুরুতেই মঞ্চে এলেন বাঁশির সুরে বিশ্বজয় করা পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া এবং বিখ্যাত সন্তুরবাদক পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। তাঁদের সংগত করতে ঢোল, তবলা আর তানপুরা নিয়ে মঞ্চে উঠলেন যন্ত্রীরা। ৭৮ বছর বয়সী চিরতরুণ চৌরাসিয়া বাঁশিতে ঠোঁট লাগাতেই পুরো মিলনায়তনে নেমে এল নীরবতা। শুভ্রকেশী ঝাঁকড়া চুলের পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা তাঁর ৭২ তারের জাদুকরি যন্ত্র সন্তুরে অনুসরণ করলেন সেই বাঁশির সুর। সঙ্গে যোগ দিল ঢোল, তবলা আর তানপুরা। তারপর দর্শকদের কেবলই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকা আর এক পরিবেশনা শেষ করে অন্য পরিবেশনায় যাওয়ার আগে তীব্র করতালিতে ফেটে পড়া। এরপর বাংলাদেশের শিল্পী লুভা নাহিদ চৌধুরী। যন্ত্র নয়, কণ্ঠ সংগীত। ডি এল রায়ের ‘আমি সারা সকালটি বসে বসে’ দিয়ে শুরু করলেন তিনি।
বিনম্র সম্মোহনী সুরে বিমোহিত দর্শক। এরপর একে একে গাইলেন অতুল প্রসাদ সেন, নজরুল ইসলাম ও রজনীকান্ত সেনের গান। এরপর সেতার নিয়ে মঞ্চে এলেন পণ্ডিত রবিশঙ্করের মেয়ে আনুশকা শঙ্কর। সঙ্গে ঢোল, তবলা, সানাই আর বাঁশির সংগত। গত শতাব্দীর আশির দশকে বাবা রবিশঙ্করের করা একটি কম্পোজিশন দিয়ে শুরু করলেন তিনি। মন-প্রাণ উজাড় করে বাজালেন প্রায় আধ ঘণ্টা। সেতারের তারে হাতের ক্ষিপ্র চালনে বুঝিয়ে দিলেন তিনি বাপকা বেটি। আনুশকার সেতারের ঝংকার রক্তে যেন নাচন তুলল। এবার রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে হাজির হলেন অদিতি মহসিন। গীতাঞ্জলি থেকে ‘জগতে আনন্দে যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ দিয়ে শুরু করলেন সুরের অভিযাত্রা। গাইলেন কয়েকটি গান। প্রতিটি গানের আগে অদিতি মহসিন ইংরেজিতে অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিলেন গানগুলোর প্রেক্ষাপট। শাস্ত্রীয় সংগীতের এই আয়োজনে সর্বশেষ আকর্ষণ ছিলেন ভারতের বেহালা সম্রাটখ্যাত ড. এল সুব্রামনিয়াম। তিনি যখন মঞ্চে আসেন, তখন স্থানীয় সময় রাত সোয়া ১০টা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী সুব্রামনিয়াম বেহালার সুরে সুরে জানান দিলেন তাঁর রক্তেই আছে বেহালার সুর। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা প্রফেসর ভি লক্ষ্মীনারায়ণের কাছেই বেহালায় তাঁর হাতেখড়ি। কর্ণাটকি ঘরানার এই বেহালাবাদক ঢোল, তবলা আর তানপুরার মিশেলে তৈরি অনন্য রাগসংগীতে দর্শকদের আলোড়িত করেন। রাত ১১টায় শেষ হলো এই সংগীতায়োজন। অনুষ্ঠানে এক সংক্ষিপ্ত প্রমাণ্যচিত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন আদায়ে পণ্ডিত রবিশঙ্করের অবদানের কথা তুলে ধরা হয়। উপস্থাপক বলেন, রবিশঙ্কর রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে ১৭বার পরিবেশনায় অংশ নিয়েছেন। তাঁর সর্বশেষ পরিবেশনা ছিল ২০০৫ সালে। অনুষ্ঠানে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি আবুল খায়ের বলেন, ‘পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে বাংলাদেশি একটি প্রতিষ্ঠানের আয়োজন গর্বের ব্যাপার।’ বাংলা গান ও উচ্চাঙ্গ সংগীতকে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে এমন আয়োজন অব্যাহত রাখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি। অনুষ্ঠানে স্মারক হিসেবে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে শিল্পীদের উত্তরীয় পরিয়ে দেন আবুল খায়ের, প্রতিষ্ঠানটির পরামর্শক এ কে আবুল মোমেন এবং কনসার্টের মিডিয়া পার্টনার চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও ব্লুজ কমিউনিশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরহাদুল ইসলাম। একটি স্মারক ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয় পণ্ডিত রবিশঙ্করের স্ত্রী সুকন্যা শঙ্করের হাতে।

No comments

Powered by Blogger.