ওদের কান্নার শেষ নেই by সাখাওয়াত কাওসার

‘ভাই গত ১৭ এপ্রিল দয়াগঞ্জ মোড়ে ইবনেসিনায় ডা. ফেরদৌস কামাল ভূইয়াকে দেখাইছি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ওষুধ কিনতে পারি নাই। দেহেন শরীর ফুইল্যা গেছে। উঠলে বসতে পারি না। বসলে উঠতে পারি না। খুব যন্ত্রণা হয়। মাঝে মাঝেই এক-দুই বেলা না খাইয়া থাকি। কী করুম কন? চার বছর বয়সী মেয়েটার মুখের দিকে তাকাইলে নিজেরে ঠিক রাখতে পারি না।’ শনিবার ফারহানা আক্তারের (২৮) সঙ্গে তার যাত্রাবাড়ীর ভাড়া বাসায় গিয়ে এ প্রতিবেদক কথা বলার সময় একপর্যায়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। এত গেল শুধু এক ফারহানার খবর। এরকম অসংখ্য ফারহানা কিছুটা সুখের আশায় বিদেশ গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ফিরেছেন। ভয়ঙ্কর রোগ বাসা বেঁধেছে তাদের শরীরে। আবার কেউ কেউ যৌন নির্যাতনের পর গর্ভবতী হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে সহায় সম্বল হারানো এসব ভুক্তভোগীর কান্নাই এখন নিত্যসঙ্গী। তাদেরই একজন কুড়িগ্রামের কল্পনা বেগম (ছদ্মনাম)। তিন মাসের গর্ভবতী হয়ে তিনি চলতি মাসের শুরুর দিকে সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে দেশে ফিরেছেন। এ ব্যাপারে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি এ প্রতিবেদককে বলেন, ওদের জন্য আমরা ভাবছি। কারও অবস্থা খুবই গুরুতর হলে তাদের আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্যাতিত হয়ে ফেরত আসা অসুস্থ রোগীদের জন্য হাসপাতাল তৈরির ব্যাপারে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভুক্তভোগীরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দেশে ফিরে আসেন। সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান বিভাগে। তবে একেকটি অভিযোগ নিয়ে শুনানি হয় দিনের পর দিন। দুর্দশাগ্রস্ত, হতদরিদ্র মানুষজন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসেন শুনানিতে অংশগ্রহণের জন্য। কর্মসংস্থান থেকে শুনানি হয়। রায় আসে। তবে মন্ত্রণালয় নেয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তবে সেখানে অভিযুক্ত এজেন্সিগুলো পুনরায় শুনানির আবেদন জানালে হতদরিদ্র মানুষদের পুনরায় শুনানির জন্য ডাকা হয়। তবে আর্থিক কারণে অনেকেই শুনানিতে অংশ নিতে পারে না। অভিযোগ রয়েছে, এক্ষেত্রে রায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সির পক্ষেই যায়। কান্না এবং হতাশাই সম্বল হয় ভুক্তভোগীদের। অনেক ক্ষেত্রে শুনানির রায়ের বিপক্ষে উচ্চ আদালতে রিট করে তা স্থগিতের রায় নিয়ে আসে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। দীর্ঘদিনের মতো ঝুলে যায় হতভাগাদের ভাগ্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, নারী কর্মী পাঠানোর পর থেকেই এ ধরনের অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। বেশির ভাগ নারী কর্মীই বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এসব বিষয় সরকারের নীতিনির্ধারক মহল অবগত রয়েছে। তবে সময় এসেছে, আমাদের সরকারের উচিত বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে ওইসব দেশকে জানানো। নইলে নির্যাতনের মাত্রা বাড়বে বৈ কমবে না।
এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন ‘আইন ও সালিস কেন্দ্র’-আসক পরিচালক নূর খান লিটন। তিনি বলেন, যেখানে আমাদের শ্রমিকদের মানবাধিকার নিশ্চিত হবে না সেখানে শ্রমিক পাঠাতে হবে কেন? সরকারের উচিত হবে এসব বিষয় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে অফিসিয়ালি অবহিত করা। যারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য সরকারকেই যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছেন। এ জন্য তাদের বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টির জন্য মন্ত্রণালয়ও গঠন করা হয়েছে। এখন যদি ওই মন্ত্রণালয় থেকে প্রবাসীরা নিগ্রহ এবং অবহেলার শিকার হন, আর তা দুর্বৃত্তদের পক্ষে যায় সেটা খুবই লজ্জাজনক। মন্ত্রণালয়ের প্রবাসীকল্যাণ বোর্ডের পরিচালক নূরুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নীতিমালায় আছে দুর্ঘটনা এবং মুমূর্ষু অবস্থায় ফিরে এলে এক লাখ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা সুবিধা দেওয়ার।
যাত্রাবাড়ীর ভুক্তভোগী ফারহানার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মাদকাসক্ত স্বামীর দিনের পর দিন নির্যাতন ও আর্থিক যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে এবং সিকদার ট্রাভেলসের মালিক সিরাজ সিকদারের কথায় বিশ্বাস করে ৪০ হাজার টাকায় লেবাননে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। মাসে ২০ হাজার টাকা বেতনের প্রলোভন। আশা করেছিলেন হয়তো এর থেকেই অন্তত দুই বেলা সন্তানদের মুখে খাবার জুটবে। তবে সুখ তার কপালে সয়নি। ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পাসপোর্টে লেবাননের ভিসা থাকলেও প্রতারক চক্র কৌশলে তাকে পাঠিয়ে দেয় সিরিয়ায়। ঠাঁই হয় একটি ক্যাম্পে। দালালদের কথামতো কাজ করতে রাজি না হওয়ায় সেখানে টানা ছয় মাস চলে তার ওপর স্টিমরোলার। দুই দফা লুকিয়ে নির্যাতন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। তবে প্রতিবারই সিরিয়ার পুলিশ তাকে তুলে দেয় দালালদের হাতে। ওই ক্যাম্পে ছিল প্রায় ২৮ জন বাংলাদেশি নারী। দালালদের প্রস্তাবে রাজি না হলেই দেওয়া হতো ইলেকট্রিক শক। নির্যাতনের একপর্যায়ে একদিন তার হাতও ভেঙে দেওয়া হয়। চিত্কার করলেই মুখে গুঁজে দেওয়া হতো কাপড়। কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ফেলে রাখা হতো তাকে। যৌন নির্যাতন ও বিভিন্ন মাত্রার শারীরিক নির্যাতনে একপর্যায়ে গুরুতর অসুস্থ ফারহানাকে দিয়ে কোনো কাজ করানো সম্ভব না হওয়ায় গত বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে ফেরত পাঠায় দালাল চক্র। এরপর থেকে দফায় দফায় হতদরিদ্র মা ফারহানাকে চিকিৎসা করান। তবে এখন চিকিৎসা করতেও পারছেন না তিনি। পরবর্তীতে ফারহানার মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-৩ এর একটি দল পল্টন এলাকা থেকে দালাল চক্রের দুই হোতা আল হাসিব রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক জসীম আহমেদ, শিকদার ট্রাভেলসের মালিক সিরাজ শিকদারসহ ১৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে। তবে কিছু দিনের মধ্যেই তারা কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে আসেন। সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা কুড়িগ্রামের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীর স্বামী ক্ষোভ প্রকাশ করে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘হামরা কোনঠে যামু ভাই? হামার কথা কাহো শুনে না। হামরা তো গরিব!...।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার শান ট্রাভেলসে গেছিনু। হামাক খেদাই দিছে। মন্ত্রণালয়ে গেছিলাম। তারাও কিছু করল না।’
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার গোলাম সারোয়ার বলেন, ঘটনার মানবিকতা উপলব্ধি করে এ বিষয়ে বিশেষ তত্পরতা চালানো হয়। তবে রিক্রুটিং এজেন্সির বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ। হতাশার কথা হলো, অনেক রিক্রুটিং এজেন্সির মালিককে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করা হয়েছিল। তবে কিছু দিনের মধ্যেই তারা জামিনে বের হয়ে এসে পুনরায় বিদেশে শ্রমিক পাঠাচ্ছে। এখন বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অনেক নারী শ্রমিকের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.