ভিন্ন রকম রোমিও ও জুলিয়েট by নাসির উদ্দিন ইউসুফ

রোমিও ও জুলিয়েট
রোমিও ও জুলিয়েট নাটকে মৃত্যু দৃশ্যের অর্থাৎ শেষ দৃশ্যের অভিনয় চলছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায়। বেদনার আবহ মঞ্চজুড়ে। দুই জুলিয়েটরূপী শ্রবণপ্রতিবন্ধী স্মৃতি, শারীরিক প্রতিবন্ধী শাকিলা, দুজন রোমিও শ্রবণপ্রতিবন্ধী তাইফুর আর শারীরিক প্রতিবন্ধী রাব্বির অপূর্ব অভিনয়। পেছনে বাজছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবুদ্দিনদের বাঁশি। এক ট্র্যাজিক আবহ তৈরি করে মিলনায়তন ও মঞ্চে। দর্শক অশ্রুসজল হয়। আমার চোখও আর্দ্র হয়। মনে হয় এই প্রতিবন্ধী অথবা ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষগুলো, যারা সমাজে অচ্ছুত, তাদের নিয়ে তো একটা সফল প্রযোজনা করা গেল। স্বাভাবিক মানুষের মতো তাদের মঞ্চাভিনয় সবাইকে বিস্মিত করে দেয়। মনে পড়ে আজ থেকে তিন বছর আগে ২০১৩ সালে যে যাত্রা শুরু, তা নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সাফল্যের একটা সোপান পার হলো। প্রতিবন্ধী বলে অবহেলিত গ্রাম ও শহরের মানুষগুলো শতভাগ আন্তরিকতা ও পরিশ্রমের সঙ্গে আরাধ্য কাজটি সম্পন্ন করে। আমরা পেলাম ‘ভিন্ন রোমিও ও জুলিয়েট’। মহান নাট্যকার উইলিয়াম শেকস্পিয়ারের ৪০০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৫ বছর উদ্যাপন উপলক্ষ ঢাকা থিয়েটার ও লন্ডনের প্রতিবন্ধী থিয়েটার ‘গ্রেআই’ যৌথভাবে রোমিও ও জুলিয়েট মঞ্চায়ন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় ২৮ ও ২৯ মার্চ। আয়োজক ব্রিটিশ কাউন্সিল। ঘটনার শুরু ২০১২ সাল। শেক্সপিয়ারের ৪৫০তম জন্মবার্ষিকী পালিত হবে সারা বিশ্বে। আয়োজক শেক্সপিয়ারের ‘গ্লোব থিয়েটার’ আমাকে এবং ঢাকা থিয়েটারকে টেম্পেস্ট করার আমন্ত্রণ জানায় গ্লোবে। মণিপুরি নটপালা ও বাঙালির পালা নাট্যের আদলে টেম্পেস্ট-এর গীতল ও ছন্দময় প্রযোজনা খোদ ইংল্যান্ডে ব্যাপক সাড়া ফেলে। সময় মে ২০১২ সাল। দেশে ফিরে এলে এবার ব্রিটিশ কাউন্সিল অনুরোধ করে ‘নাট্যকারের প্রয়াণ বর্ষ পালিত হবে ১৩০টি দেশে। ২০১৬ সালে আমি যেন আরেকটি শেক্সপিয়ারের নাটক করি। আমি বললাম করব, তবে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের নিয়ে করব। প্রতিবন্ধী বলে যাদের আমরা উপেক্ষা করি সেই ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষদের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে আমরা শেক্সপিয়ারকে জানাব শ্রদ্ধা। উদ্যাপন করব স্বাধীনতার ৪৫ বছর। আর ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের সক্ষমতার স্বাক্ষর রাখব ইতিহাসের কালো পিঠে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের রবিন ডেভিস ও ঈষিতা আজাদ খুব তৎপর হলো ভাবনাটি শুনে। চ্যালেঞ্জিং কাজটা করার সব সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। আমরা গ্রাম থিয়েটার, ব্র্যাক, সিআরপিসহ নানা প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানে ঘুরে ঘুরে অভিনয়ে-ইচ্ছুক মানুষদের খুঁজতে থাকলাম। শ্রবণ, দৃষ্টি ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীদের খুঁজে পাওয়া গেল। তাদের আগ্রহ ব্যাপক, কিন্তু মঞ্চ শিল্প সম্পর্কে জ্ঞান নেই। তা ছাড়া বাচিকসহ আরও দুটি ভাষা জরুরিভাবে তাঁরা ব্যবহার করে। দৃষ্টি ও শ্রবণ সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা। শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের ‘ইশারা ভাষা’ আর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বাচিকের ভিন্ন বাক্যের সংযোজন। আমাদের এ ভাষা জানা নেই। আর এদের সঙ্গে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। ব্রিটিশ কাউন্সিলকে সমস্যা অবহিত করার পর তারা লন্ডনের গ্রেআই থিয়েটারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং বিশ্বখ্যাত প্যারা অলিম্পিকের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর জেনি সিলি যিনি নিজেও শ্রবণ প্রতিবন্ধী, তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়। আমি ও কন্যা এশা ইউসুফ লন্ডনে গিয়ে জেনির সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপ সারলাম। জেনি ও তাঁর ইশারা ভাষা রূপান্তরকারী আরেক জেনি আমাদের কাজের পদ্ধতি নিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিলেন। ২০১৩ সালে শুরু হলো জেনির তত্ত্বাবধানে ঢাকা ও সাভারে নির্বাচিত ৪০ জনের কর্মশালা। এক দুরূহ যাত্রা, কিন্তু নতুন এক শিল্পজগতে প্রবেশ করলাম আমরা। তিন বছরে ১১টি কর্মশালা। আর প্রথম তিনটির পর শিল্পী নির্বাচন। আগ্রহী অংশগ্রহণকারীদের বাদ দিতে মন খারাপ হচ্ছিল, কিন্তু আমাদের প্রয়োজন ১৭ জন। এভাবে তিন বছরে ১৫০ দিন-রাত পার করে তবে তরি ভিড়ল ২৮ ও ২৯ মার্চ জাতীয় নাট্যশালায় সন্ধ্যা সাতটায়। এ এমন এক অভিজ্ঞতা যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না, অনুভব করা যায়। আমাদের দৃষ্টি ও মানসিকতা বদলে দিয়েছে ভিন্নভাবে সক্ষম এই ১৬ জন মানুষ। তারা প্রমাণ করল তারা স্বাভাবিক মানুষের মতো সক্ষম। শুধু প্রয়োজন সহযোগিতা। আমরা সর্বতোভাবে সাহায্যের চেষ্টা করেছি—ঢালি আল মামুন শিল্প নির্দেশক। শিমূল ইউসুফ সংগীত ও পোশাক দোলাকে সঙ্গে নিয়ে, নাসিরউল হক আলো, তুষারের ডিজিটাল অভিব্যক্তি ও শব্দ, ওয়াসিমের প্রযোজনা ব্যবস্থাপনা, এশা, দোলা ও নিশাতের সহকারী পরিচালক হিসেবে অক্লান্ত পরিশ্রম—ডিফরেন্ট রোমিও ও জুলিয়েট সফলভাবে মঞ্চায়ন সম্ভব করেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আংশিক অর্থায়ন ও ব্রিটিশ কাউন্সিলের সার্বিক আয়োজনে আমাদের স্বপ্ন প্রযোজনা সম্ভব হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.