গোপন লেনদেনে সেই অবৈধ পথে সিআইএও

আদনান খাসোগি,ফরহাদ আজিমা, জেমস বন্ডের একটি বইয়ের প্রচ্ছদ
সৌদি প্রধান গোয়েন্দা কর্মকর্তা শেখ কামাল আদহাম ছিলেন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে ‘সিআইএর প্রধান সমন্বয়কারী’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর হয়ে কাজ করেছেন, এমন অনেকেই পানামাভিত্তিক রহস্যে ঘেরা আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার সহায়তা নিয়েছেন। বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা ‘পানামা পেপারস’ কেলেঙ্কারি প্রকাশ করা ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইসিআইজে গতকাল বুধবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেছে। আইসিআইজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিআইএ বিভিন্ন দেশে এর গোপন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে এ প্রতিষ্ঠানকেও ব্যবহার করেছে। পানামা পেপারসের নথিতে এ বিষয়ে যেসব নাম উঠে এসেছে, তার মধ্যে আছে ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত একসময়ের আলোচিত সৌদি অস্ত্র ব্যবসায়ী আদনান খাসোগি, প্রভাবশালী মার্কিন উড়োজাহাজ ব্যবসায়ী ফরহাদ আজিমা, সৌদি আরবের প্রধান গোয়েন্দা কর্মকর্তা শেখ কামাল আদহামসহ অনেকেই। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রসারে কাজ করা ওয়াশিংটন–ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) গত রোববার মোসাক ফনসেকার ১ কোটি ১৫ লাখ নথি ফাঁস করে। বিশেষ কিছু কর রেয়াত অঞ্চলের সুবিধা ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র, সরকারপ্রধানসহ ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা তাদের আত্মীয়-বন্ধুদের অর্থ পাচারের প্রমাণ এসব নথিতে উঠে এসেছে। আইসিআইজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর হয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের অন্যতম ফরহাদ আজিমা। ইরানি বংশোদ্ভূত এই মার্কিন নাগরিক উড়োজাহাজ ব্যবসায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান দল ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান পার্টি—উভয়কেই দেদার অর্থ দিয়েছেন এই ধনকুবের। ছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ। ১৯৯৫ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ১০ বার তিনি গেছেন হোয়াইট হাউসে। ১৯৮০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সময় নিকারাগুয়ার মার্কিন সমর্থনপুষ্ট কন্ট্রা বিদ্রোহীদের সহায়তা দিতে ইরানের কাছে গোপনে অস্ত্র বিক্রি করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে আইসিআইজের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮৫ সালে তেহরানগামী একটি বোয়িং ৭০৭ বিমানে ২৩ টন সামরিক সরঞ্জাম ছিল। বিমানটি ছিল ফরহাদ আজিমার। তবে আজিমা আইসিআইজেকে বলেন, ‘ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারি নিয়ে আমি কিচ্ছু জানি না। মার্কিন প্রায় সব গোয়েন্দা সংস্থাই এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে, কিন্তু আমার সংশ্লিষ্টতা পায়নি।’ পানামা পেপারসের প্রকাশিত নথিতে দেখা যায়, ওই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ২০০০ সালে মোসাক ফনসেকার সহায়তায় বিশ্বে কর রেয়াতের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে ‘এএলজি (এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক) লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন। মোসাকের এক কর্মীর লেখা নিবন্ধকে উদ্ধৃত করে আইসিআইজের প্রতিবেদনে বলা হয়, লিবিয়ায় অস্ত্র সরবরাহ করেছিল সিআইএর এমন এক এজেন্টকেও সহায়তা দেন আজিমা। ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত সৌদি ধনকুবের অস্ত্র ব্যবসায়ী আদনান খাসোগিও অর্থ পাচার করেছেন বলে নথি ঘেঁটে সন্ধান পেয়েছে আইসিআইজে। ইরানে অস্ত্র বিক্রি করতে খাসোগি যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তার উল্লেখ আছে ১৯৯২ সালে তৈরি মার্কিন সিনেটের প্রতিবেদনেও। সে সময় সিনেটর এবং এখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ওই প্রতিবেদনের অন্যতম লেখক ছিলেন। মোসাক ফনসেকার নথিতে দেখা যায়, ১৯৭৮ সাল থেকে খাসোগি অন্তত চারটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে অর্থ পাচার করেছিলেন। নথি অনুযায়ী মোসাক ফনসেকার সেবা নিয়েছেন সৌদি আরবের প্রধান গোয়েন্দা কর্মকর্তা শেখ কামাল আদহাম। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটির তথ্য অনুযায়ী, তিনি আবার ছিলেন ‘১৯৬০ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে সিআইএর প্রধান সমন্বয়কারী’। এ তালিকায় আরও আছেন কলম্বিয়ার বিমানবাহিনীর প্রধান গোয়েন্দা কর্মকর্তা রিকার্ডো রুবিয়ানোগ্রুট, রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামের গোয়েন্দাপ্রধান ইমানুয়েল দাহিরো। এঁদের মধ্যে আদহাম মারা গেছেন। দাহিরো আইসিআইজের কাছে কথা বলতে রাজি হননি। কেবল রুবিয়ানোগ্রুট স্বীকার করেছেন, ওয়েস্ট টেক পানামা নামে একটি ছোট কোম্পানি তাঁর ছিল। সিআইএ ঘনিষ্ঠ আরেক অর্থ পাচারকারী হলেন ‘দ্য আইসল্যান্ডার’ খ্যাত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী লুফটর জোহানেসন। ৮৫ বছর বয়সী আইসল্যান্ডের এই অধিবাসীর সঙ্গে সিআইএর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিভিন্ন বই ও পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। বলা হয়, ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারবিরোধী মুজাহিদদের অস্ত্র সরবরাহ করতেন। সিআইয়ের অর্থে তিনি বারবাডোজে একটি বাড়ি এবং ফ্রান্সে বিশাল আঙুরের খেতের মালিক হয়েছেন। ব্রিটিশ লেখক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের লেখা জনপ্রিয় জেমস বন্ড সিরিজ এবং এর কাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্রগুলো বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়। আইসিআইজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের বাইরে অর্থ পাচার করতে গিয়ে মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে যেসব কোম্পানি খোলা হয়েছে, সেখানে জেমস বন্ড সিরিজের নাম বা এর নানা চরিত্রের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে গোল্ড ফিঙ্গার, স্কাইফল, গোল্ডেন আই, মুনরেকার, স্পেক্টর ইত্যাদি। ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সৃষ্ট চরিত্র জেমস বন্ড ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের কল্পিত গোয়েন্দা চরিত্র। এর সঙ্গে বাস্তবের সে অর্থে মিল নেই। আইসিআইজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে দেশে গুপ্তচরবৃত্তি এবং এর জন্য অর্থ পাচারের সঙ্গে মোসাক ফনসেকার যোগাযোগের ঘটনা চরম বাস্তব, এটি মোটেও কোনো কল্পকাহিনি নয়।

No comments

Powered by Blogger.