উনিশশো একাত্তরের যুদ্ধে জ্যাকবের ভূমিকা by এবনে গোলাম সামাদ

জনসংখ্যার দিক থেকে ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতে গণতন্ত্রের সাফল্যের একটি কারণ হলো, ভারতের সেনাবাহিনীর গণতন্ত্রকে মেনে নেয়া। ভারতের সেনাবাহিনী কখনো সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে প্রয়াসী হয়নি। তারা থেকেছে বেসামরিক নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদেরই বিশেষ নিয়ন্ত্রণে। যেটা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হতে পারেনি। যদিও পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য হলো ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রেখে যাওয়া। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক রূপ হলো একই রকম। যেটা ছিল ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীর। কিন্তু ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মনোভাব ঠিক একই খাতে প্রবহমান হতে পারেনি। গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা ভারতের সেনাবাহিনীতে যতটা প্রথিত হতে পেরেছে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সেটা হতে পারেনি, যদিওবা ঐতিহাসিক কারণে হতে পারত। কেননা, এই তিন দেশের সেনাবাহিনী বহন করে চলেছে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সংগঠন কাঠামো। তবে একটা বিষয়ে ছিল বড় রকমের ফাঁক। ভারত পেয়েছিল যথেষ্ট সংখ্যক সিভিলসার্ভেন্ট। সাবেক পাকিস্তান তা পেয়েছিল না। তার ছিল দেশ চালাবার লোকের অভাব। সরকার হয়ে পড়েছিল দুর্বল। সেনাবাহিনী ছিল দেশের সবচেয়ে সুসংগঠিত অংশ। তাকে তাই এগিয়ে আসতে হয়েছিল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশ চালাবার কাজে। ভারতে যে প্রয়োজন উত্থাপিত হয়নি। এ ছাড়া ভারতের জনসাধারণ ছিলেন অনেক রাজনীতিসচেতন। যে সচেতনতার অভাব ঘটেছিল সাবেক পাকিস্তানে।
একটা কথা প্রচলিত আছে, যে দেশের মানুষ যেমন সে দেশের মানুষ তেমন সরকারই লাভ করে থাকে। কথাটা সম্ভবত প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের। ভারতের সংবিধান অনুসারে ভারতের সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ নির্দেশদাতা হলেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি। তিনি হলেন Commander-in-Chief of all the Defence Forces অর্থাৎ স্থলবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর প্রধান। কিন্তু ভারত একটি প্রেসিডেন্ট শাসিত দেশ নয়। ভারতের প্রেসিডেন্টকে চলতে হয় মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশে।মন্ত্রিপরিষদকে মানতে হয় বিধান পরিষদের মতামত। ভারতের সমরনীতি নির্ধারণের দায়ভার মন্ত্রিসভার ওপর ন্যস্ত। তবে এ জন্য রয়েছে একটি বিশেষ কমিটি। যার চেয়ারম্যান হলেন প্রধানমন্ত্রী এবং এতে থাকেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী। আরো থাকেন স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান নির্দেশক বা Chief of the Staff। এ ছাড়া থাকেন প্রতিরক্ষা সচিব এবং সেনাবাহিনীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। এই বিশেষ কমিটিতে রণনীতি নির্ধারণের সময় বিবেচনা করা হয় পররাষ্ট্রনীতি, দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং সেনাবাহিনীর বিদ্যমান অবস্থা নিয়ে; রণ কৌশল নিয়ে নয়। সেটা স্থির করা বিশেষভাবে ন্যস্ত থাকে সেনাবাহিনীরই ওপর। রণনীতি ও রণকৌশলকে এক করে দেখা হয় না। রণনীতি ঠিক করার জন্য একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি হলো বিশেষ বিবেচ্য। কোন রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ হতে পারে আর কোন রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ হতে পার না, সেটা নিয়ে আলোচনা রণনীতি ঠিক করার ক্ষেত্রে পেতে চায় বিশেষ বিবেচনা। সেনাপতিদের পক্ষে সেটা ঠিক করা সম্ভব নয়। অন্য দিকে, রণকৌশল সেনাবাহিনীর বিরাজমান অবস্থার ওপর নির্ভর করে থাকে। তাই সেটা সেনাবাহিনীর বিশেষ বিবেচ্য বলে মনে করা হয়।
ভৌগোলিক দিক থেকে ভারতের স্থলবাহিনীকে (Army) চারটি এলাকায় বিভক্ত করা হয়েছে। এদের প্রত্যেক এলাকার প্রধানকে বলা হয় Lieutenant-General । ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলের সেনাসদর হলো মহারাষ্ট্রের পুনা (পুনে), মধ্য অঞ্চলের সামরিক কর্মকর্তার সদর দফতর যুক্ত প্রদেশের লাখনৌ শহরে। পশ্চিম কমান্ডে সেনা সদর দফতর হলো সিমলা। আর পুবের সেনা কমান্ডের সদর দফতর কলকাতা। প্রত্যেক লেফটেন্যান্ট জেনারেলের এলাকা আবার ছোট ছোট এলাকায় বিভক্ত থাকে। যার নিয়ন্ত্রণ থাকে Major-General-এর ওপর। মেজর জেনারেলের এলাকা আবার বিভক্ত থাকে ব্রিগেড এলাকায়। যার নিয়ন্ত্রণ থাকে Brigadier-এর ওপর। এই কাঠামো বাংলাদেশেরই মতো।
ভারতের নৌবাহিনীর আছে চারটি ঘাঁটি। এই ঘাঁটিগুলো একেকটি নৌ-কমান্ডের অধীন। পশ্চিমের নৌ-কমান্ড অবস্থিত বোম্বে (মুম্বাই)। দক্ষিণের নৌঘাঁটি অবস্থিত কেরেলার কোচিনে। পুবের নৌঘাঁটি অবস্থিত অন্ধ্র রাজ্যের বিখ্যাত বন্দর বিশাখাপত্তনমের লাগোয়া। চতুর্থ ঘাঁটি প্রয়োজনে স্থাপন করা হয় সমুদ্রের বুকে রণতরীর সমন্বয়ে। যাকে বলে Fleet।
ভারতে বিমানবাহিনীর চারটি কমান্ড কাছে। এর ট্রেনিং কমান্ড অবস্থিত হলো কর্নাটক প্রদেশের রাজধানী ব্যাঙ্গালরে (ব্যাঙ্গালুরু)। সামরিক বিমান রক্ষণাবেক্ষণের কমান্ড হলো মধ্যপ্রদেশের নাগপুর। পশ্চিম কমান্ড হলো দিল্লির কাছে পালামে। কেন্দ্রীয় কমান্ড হলো কলকাতায়। আর পূর্ব কমান্ড হলো মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধে যে প্যারাসুট বাহিনী ভারত টাঙ্গাইলে পাঠিয়েছিল, তা এসেছিল শিলং থেকে।
১৯৭১ সালে ভারতের পূর্ব কমান্ডে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিত সিং অরোরা। তার অধীনে ছিলেন মেজর জেনারেল জ্যাকব। এরা উভয়ই ছিলেন চিফ অব দি আর্মি স্টাফ। সাম মানেকশ (Sam Manekshaw)-এর কমান্ডে। মানেকশ ধর্মে ছিলেন পার্সিক অর্থাৎ অগ্নিপূজারী। তার মাতৃভাষা ছিল গুজরাটি। জগজিৎ সিং অরোরা ছিলেন ধর্মে শিখ। তার মাতৃভাষা ছিল পাঞ্জাবি। যা লেখা হয় গুরুমুখী অক্ষরে; দেবনাগরী অক্ষরে নয়। জে এফ আর জ্যাকব ধর্মে ছিলেন ইহুদি। তার পূর্বপুরুষ বাইরে থেকে এসে কলকাতায় উপনিবিষ্ট হন। জ্যাকব জন্মেছিলেন কলকাতায়। তিনি তাই বাংলা বুঝতে ও বলতে পারতেন। যদিও তার ভাষা কার্যত ছিল ইংরেজি। মানেকশ ও অরোরা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন পেশাজীবী সৈনিক হিসেবে, কোনো আদর্শের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়। কিন্তু জ্যাকব যোগ দিয়েছিলেন একজন ইহুদিবাদী হিসেবে। তিনি চেয়েছিলেন হিটলারের পরাজয়। তিনি ছিলেন সাবেক প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও পক্ষে। ইহুদিদের সাথে আরব মুসলমানদের বৈরিতার কারণে তিনি সাধারণভাবেই হয়ে উঠেছিলেন মুসলিমবিদ্বেষী। তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানকে ভেঙে দিতে এমনকি বিলুপ্ত করতে। যে মনোভাব মানেকশ ও অরোরার মধ্যে ছিল না।
জে এফ আর জ্যাকব ছিলেন ভারতের পূর্ব রাণাঙ্গনের একজন মেজর জেনারেল। তিনি সেনাবাহিনীতে খুব জনপ্রিয় ছিলেন না। কিন্তু ছিলেন একজন কৃতী রাজনীতিবিদ। করতেন জিওনিস্ট রাজনীতি। তিনি একটি বই লিখেছেন। যার নাম Surrender At Dacca : Birth of a Nation । যাতে তিনি লিখেছেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেখা করেন প্রাবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজ উদ্দীনের সাথে। তাজ উদ্দীনের সাথে তার দীর্ঘ আলাপ হয়। অনেকে মনে করেন, জ্যাকবের মাধ্যমেই ইসরাইলের কর্মকর্তাদের সাথে তাজ উদ্দীনের প্রথম যোগাযোগ ঘটে। পরে তাজ উদ্দীন আব্দুস সামাদ আজাদকে পাঠিয়েছিলেন তেলআবিব। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সারা বিশ্বের ইহুদি-অর্থে পরিচালিত পত্রপত্রিকায় প্রচার শুরু হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে। জ্যাকব তার বইতে লিখেছেন, ১৯৭১-এর যুদ্ধের ব্যাপারে ভারতকে উপদেশ দিয়ে ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আসা সমর বিশারদেরা। যাদের উপদেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন মানেকশ।
জ্যাকব ভারতের সেনাবাহিনী থেকে অবসর পান ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে। হাসিনা সরকার তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করেন ২০১২ সালের ২৭ মার্চ। সম্মাননা নেয়ার সময় জ্যাকব মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকদের সামরিক অভিবাদন দেন এবং বলেন, জয়বাংলা (বাংলাদেশ প্রতিদিন : ১৪ জানুয়ারি ২০১৬)। কেন এতদিন পরে জ্যাকবকে বীর উত্তম উপাধি দেয়া হয়েছিল তা নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। একটি মত হলো জগজিৎ সিং অরোরা বাংলাদেশ হওয়ার পর হয়ে ওঠেন স্বাধীন শিখরাজ্য প্রতিষ্ঠার বিশেষ সমর্থক। ভারতে শিখদের খালিস্থান আন্দোলন ইন্দিরা গান্ধী কঠোরহস্তে দমন করেন। এটা করতে গিয়ে তিনি ভেঙে ফেলেন শিখদের অমৃতসরের বিখ্যাত স্বর্ণমন্দির, যা পরে আবার নির্মাণ করা হয়। বহু শিখ এর জন্য ইন্দিরা গান্ধীর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর দুজন দেহরক্ষী গুলি করে ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করে (১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর)। এরা ছিলেন শিখ স্বাধীন রাষ্ট্র, বা খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থক। দিল্লিতে হিন্দুরা অতর্কিতে শিখদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে প্রায় তিন হাজার শিখকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার এখনো হয়নি। সারা ভারতে শিখ বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। একসময় ভারতের সেনাবাহিনীতে শিখরা ছিলেন শতকরা ৩০ ভাগ। এখন আর ভারতের সেনাবাহিনীতে শিখদের আগের মতো নেয়া হচ্ছে না। ভারতের সেনাবাহিনীতে শিখদের সংখ্যা নেমে এসেছে শতকরা ১০ ভাগের নিচে। জগজিৎ সিং অরোরা ছিলেন শিখ। তা ছাড়া তিনি হয়ে উঠেছিলেন খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থক। এ জন্য ১৯৭১-এর যুদ্ধে জগজিৎ সিং অরোরার অবদানকে ভারত সরকার মুছে ফেলার চেষ্টা করেন। তার স্থলে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন জে এফ আর জ্যাকবের ভাবমর্যাদা। ভারত সরকার নাকি শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেন জ্যাকবকে বীর উত্তম খেতাব দেয়ার জন্য। তবে বিষয়টি এখনো হয়ে আছে রহস্যঘেরা। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা যায় না। ভারতের আর কাউকে ১৯৭১-এর যুদ্ধের জন্যে বীর উত্তম খেতাব দেয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। শুধু কেবল জ্যাকবকেই বীর উত্তম খেতাব দেয়া হলো। সেটা হয়ে আছে একটা জিজ্ঞাসার ব্যাপার। জ্যাকব মারা গেলেন হাসপাতালে পরিণত বয়সে (১৯২৩-২০১৬)। তার মৃত্যুর পর আমাদের এক পত্রিকায় লেখা হলো, আর নেই মুক্তিযুদ্ধের সেই নায়ক জেনারেল জ্যাকব। কিন্তু ১৯৭১ সালে জ্যাকব ছিলেন মেজর জেনারেল। তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নির্দেশে। জ্যাকব লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নিত হন ১৯৭২ সালে। জ্যাকব রাজনীতি করেছিলেন। তাজউদ্দীন সরকারের সাথে যোগাযোগ ঘটিয়েছিলেন ইসরাইল সরকারের। কিন্তু তিনি ১৯৭১ এর রণকৌশল গঠনে কোনো বিশেষ অবদান যে রেখেছিলেন, তা নয়। রণকৌশল রচনা করেছিলেন প্রধানত জগজিৎ সিং অরোরা। আর তিনি সেটা করেছিলেন সাম মানেক’শ-এর অনুমোদন সাপেক্ষে। বলা হয় জ্যাকব নাকি রচনা করেছিলেন পাকিস্তানের পূর্ব কমান্ডের লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দলিল। এটা কত দূর তা বিচার করে দেখার মতো তথ্য আমাদের হাতে নেই। সাধারণত এসব দলিল রচনার সময় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন একটা দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু জ্যাকব কোনো আইন বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। বলা হয় নিয়াজি শর্তহীনভাবে ভারতের পূর্ব কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। কিন্তু মনে করার কারণ আছে, নেপথ্যে ভারতের সাথে কিছু সমঝোতা (Agreement) চুক্তি হতে পেরেছিল। যে কারণে পাকিস্তানের পূর্ব কমান্ডের সব আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভারতে। কাউকেই রাখা হয়েছিল না বাংলাদেশে। এসব বন্দীর (POW) সবাইকেই ছেড়ে দেয়া হয় ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই সিমলায় ভারত-পাকিস্তান চুক্তি হওয়ার পর। সিমলা সম্মেলনে কেবল উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তান ও ভারতের প্রতিনিধিরা। সিমলা চুক্তিপত্রে ভারতের পক্ষ থেকে সই করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, আর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সই করেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। সিমলা সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে কেউ উপস্থিত ছিলেন না। বাংলাদেশের কাউতে এই সম্মেলনে ডাকাই হয়নি। সিমলা চুক্তিতে ১৯৭১-এর যুদ্ধকে উল্লেখ করা হয়েছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। বলা হয়নি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ভুট্টো নাকি কথা দিয়েছিলেন, যে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধাপরাধ করেছেন বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তাদের বিচার করা হবে পাকিস্তানে কোর্টমার্শালে। কিন্তু এসব সামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধাপরাধ করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। যা ছিল পূর্ব পাকিস্তান তাই পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রে। এ জন্য তাদের বিচার হওয়া উচিত ছিল বাংলাদেশে। কিন্তু তা হতে পারেনি।
জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের আমন্ত্রণে ১৯৭৪ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশে এসেছিলেন সরকারি সফরে। তিনি ২৯ জুন ঢাকা ত্যাগ করেন। যাওয়ার আগে তিনি শেখ মুজিবকে পাকিস্তানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। শেখ মুজিব তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। শেখ মুজিব জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করেছিলেন বলে শোনা যায় না। ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সেক্রেটারি অব স্টেট ২৯ ঘণ্টার জন্য ঢাকায় সরকারি সফরে আসেন। এ সময় তিনি শেখ মুজিবের সাথে কথোপকথনে ১৯৭১-এর যুদ্ধকে উল্লেখ করেন গৃহযুদ্ধ (Civil War) হিসেবে। শেখ মুজিব তার এই উক্তির কোনো প্রতিবাদ করেছিলেন না। ১৯৭১ এর যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ ছিল, না সাবেক পাকিস্তানের মধ্যে একটা গৃহযুদ্ধ ছিল, সেটা নিয়ে থেকে গিয়েছে একটা অস্পষ্টতা। কেননা, শেখ মুজিব হেনরি কিসিঞ্জারের উক্তির কোনো প্রতিবাদ করেননি।
শেখ মুজিব ১৯৭১ সালে ঠিক কী চেয়েছিলেন আমরা তা আন্দাজ করতে পারি না। কেননা এ বিষয়ে আন্দাজ করতে পারার মতো যথেষ্ট তথ্য আমাদের হাতে নেই। তবে কতগুলো ঘটনার কথা মনে করা যেতে পারে। শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। তিনি রাওয়ালপিন্ডি থেকে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের একটি বিশেষ বিমানে করে যাত্রা করেন লন্ডনে। সাংবাদিক মাসকারেনহাস তার লিখিত Bangladesh : A Legacy of Blood  বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে লিখেছেন, শেখ মুজিব তাকে লন্ডনে ৮ জানুয়ারি বলেন যে, তিনি পাকিস্তানের সাথে সব সম্পর্ক ছেদ করতে যাচ্ছেন না। রাখতে যাচ্ছেন একটা বিশেষ সম্পর্ক (Link)। শেখ মুজিব এরপর ব্রিটেনের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্থ হিথের সাথে ঘরোয়া বৈঠক করেন। ১০ জানুয়ারি তিনি লন্ডন থেকে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর একটি বিমানে করে যাত্রা করেন দেশের উদ্দেশে। ঢাকা আসার পথে তিনি দিল্লিতে যাত্রা বিরতি করে দেখা করেন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে। দিল্লি থেকে তিনি ঢাকায় ফিরতে চান রয়েল এয়ারফোর্সের একই বিমানে করে। কিন্তু ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, রয়েল এয়ারফোর্সের বিমানে করে ঢাকায় না যেয়ে ভারতের একটি বিমানে করে যেতে। কেননা, ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশকে তখনো একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল না। ব্রিটিশ সরকার বাংলাদেশকে একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি প্রদান করে ৪ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু শেখ মুজিব দিল্লি থেকে ভারতীয় বিমানে করে ঢাকায় আসতে চান না। তিনি ঢাকায় ফেরেন ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর বিমানে করে। কেন তিনি এটা করেছিলেন, তা এখনো জানা যায়নি।
দেশে ফেরার পর তার গুরুতর মতভেদ ঘটে তাজউদ্দীনের সাথে। তাজউদ্দীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের সাথে সমঝোতা চুক্তি (Agreement) করেছিলেন যে, বাংলাদেশের কোনো পৃথক সেনাবাহিনী থাকবে না, থাকবে কেবল একটা প্যারা-মিলিশিয়া বাহিনী। তিনি তার এই সমঝোতা চুক্তিতে আরো বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ সরকার তার পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করবে ভারত সরকারের সাথে আলোচনা করে। শেখ মুজিব তাজউদ্দীনকৃত সমঝোতা চুক্তি মানতে রাজি হন না। তিনি যদি এই সমঝোতা চুক্তি বাতিল করতে না পারতেন, তবে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র না হয়ে পরিণত হতো ভারতের একটি করোদমিত্র রাজ্যে (Protectorate)। এসব কথা বলেছেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তার এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে। জনাব চৌধুরী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিল্লি মিশনের প্রধান ছিলেন। স্বাধীনতার পর দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ও পরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এক সময় জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের সভাপতি হন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এই সাক্ষাৎকারটি প্রদান করেন ২৭ ডিসেম্বর ১৯৮৯ সালে (দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘র’ এবং সিআইএ; মাসুদুল হক। প্রচিন্তা প্রকাশনী- ঢাকা। চতুর্থ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৪০-১৪৩)।
কিন্তু আমাদের পত্রপত্রিকায় লেখা হলো জে এফ আর জ্যাকব ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি না থাকলে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় হতে পারত না।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.