সুখ নামের স্বর্ণমৃগের পিছে

সীমান্ত পার হওয়া দুই মিসরীয় শিশুকে সহায়তা
করছেন জর্ডানের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা
ছয় সন্তান নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন সিরিয়ার আবদেলহাদি জারারা (৩৯)। সেই অক্টোবর থেকে, সিরিয়া-জর্ডান সীমান্তের মনুষ্যবিহীন এক স্থানের শরণার্থী তাঁবুতে। অপেক্ষায় আছেন—সীমান্ত পাড়ি দিয়ে জর্ডান যাওয়ার। পরে সেখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাবেন। চোখে স্বপ্ন—নিরাপদ, উন্নত ও সুখী জীবনের।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে বছর পাঁচেক ধরে। সেই থেকে শুরু জারারাদের উৎকণ্ঠা, প্রতিনিয়ত মৃত্যুর শঙ্কা নিয়ে বাস করা। তবে শেষ রক্ষা আর হলো না। দক্ষিণাঞ্চলের দারা প্রদেশে বোমা হামলায় কয়েক মাস আগে মৃত্যু হয় জারারার স্ত্রীর। এরপর সন্তানদের বাঁচাতে তিনি ছুটলেন সীমান্তের দিকে। কষ্টমাখা কণ্ঠে তিনি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বললেন, ‘সিরিয়ায় আমার আর কিছুই নেই।’
জারারার মতো হাজারো মানুষ এখন সিরিয়া-জর্ডান সীমান্তমুখী। জর্ডানের কর্তৃপক্ষ বলছে, সীমান্তে সিরীয়দের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তিন মাস আগেও সিরিয়া থেকে পালিয়ে জর্ডান সীমান্তের কাছে চলে যাওয়া নাগরিকের সংখ্যা শতে গোনা যেত। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শুরুতে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজারে। যুদ্ধ আর মৃত্যুকে পেছনে ফেলে নতুন জীবনের আশায় দেশ ছাড়ছে এই সিরীয়রা। চাইছে সেখানে বসতি গড়ে নতুন করে জীবনটাকে সাজিয়ে নিতে।
জর্ডানের সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সাহায্য সংস্থার সূত্রগুলো বলছে, হাজার হাজার সিরীয় সীমান্তে দিনের পর দিন অপেক্ষা করছে। কারণ, প্রতিদিন কেবল ৫০ থেকে ১০০ জন ভাগ্যবান সীমান্ত পার হয়ে জর্ডানে ঢুকতে পারে।
সীমান্তে সিরীয়দের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে বলে
জানিয়েছে জর্ডানের কর্তৃপক্ষ। ছবি: এএফপি
ইতিমধ্যে জর্ডানে সিরীয় নাগরিকের সংখ্যা যে বাড়ছে, দেশটির কর্তৃপক্ষও সে তথ্য জানিয়েছে। জর্ডান বলছে, তারা ইতিমধ্যে সিরিয়ার ১৪ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। এই সংখ্যা তাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের সমান।
সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম দুই বছর দুই দেশের ৩৭৮ কিলোমিটার সীমান্তের ৪৫টি পয়েন্ট দিয়ে শরণার্থীরা পার হতে পারত। বর্তমানে শুধু দুটি পয়েন্ট দিয়ে এই সুযোগ আছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। এর একটি হাদালাত ও অন্যটি রোকবেন। হাদালাতে প্রায় এক হাজার ৩০০ সিরীয় আটকে আছে। আর রোকবেনে এই সংখ্যা ১৫ হাজারের মতো বলে জানান জর্ডানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধান জেনারেল সাবের আল মহায়রা।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পক্ষ নিয়ে জঙ্গি সংগঠন আইএস দমনে বিমান হামলা শুরু করেছে রাশিয়া। দেশটিতে এখন সরকার, বিদ্রোহী ও আইএস—এই ত্রিমুখী লড়াই চলছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে না পালিয়ে মানুষ আর কোনো উপায় দেখছে না। সীমান্তে তাই বাড়ছে শরণার্থীর সংখ্যা।
এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর সুযোগ-সুবিধার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। হাদালাত পয়েন্টের একটি তাঁবুতে বসে জারারা যেমনটা বলছিলেন, প্রথম দিকে শীত বা বৃষ্টি থেকে নিজেদের রক্ষা করার মতো কিছু আমাদের ছিল না। ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে থাকার জন্য তাঁবু করে দেওয়া হয়। তখন জর্ডানের সেনাবাহিনী কিছু খাবার ও কম্বল দেয়। এভাবেই চলছে শরণার্থী জীবনের ‘দুঃসহ সময়’।
শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে গত ডিসেম্বরে ইউএনএইচসিআর ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আলাদাভাবে জর্ডানের প্রতি আহ্বান জানায়। তবে জর্ডান এখন কিছুটা ধীরে চলার নীতি নিয়েছে। তারা বলছে, যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রকৃত শরণার্থীদের ঢুকতে দেওয়া হবে। কারণ, শরণার্থীর আড়ালে জঙ্গিবাদীরা ওই দেশে ঢুকে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। সিরিয়ায় আইএসের স্বঘোষিত রাজধানী রাকা থেকে এখানে এসে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করছে অনেকে। তাই, জঙ্গিদের প্রবেশ ঠেকাতে চায় জর্ডান।
সীমান্ত পেরিয়ে জর্ডানে আসার পর
চিকিৎসা নিচ্ছেন এক সিরীয় নারী। ছবি: এএফপি
অনেকেই অবশ্য শরণার্থী শিবিরের ‘দুঃসহ সময়’ পার করে সীমান্তের ওই পারে যেতে পেরেছে। তাদের একজন ২৩ বছর বয়সী রিয়াদ। ৮৩ দিন নো-ম্যানস লান্ডে ‘দুঃসহ সময়’ পার করার পর তিনি জর্ডানে পৌঁছেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। কিন্তু দেশের গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে স্নাতকোত্তর পর্যায় তিনি আর শেষ করতে পারেনি।
হাসাদ নামের একজন জানান, জনপ্রতি ৪৪০ ডলার দালালদের দিয়ে তাঁর ছয় সদস্যের পরিবারের সবাই জর্ডানে এসেছেন। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তিনি এমনটা করেছেন। ইউরোপের কোনো দেশে গিয়ে পরিবার নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে চান তিনি। তাই সিরিয়া থেকে পালিয়েছেন। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে জর্ডানে আসা রিয়াদ ও হাসাদের মতো শরণার্থীদের স্বাস্থ্য ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে দেশটির উত্তরাঞ্চলের জাতারি বা আজরাকে নেওয়া হয়। এই অস্থায়ী শিবিরটি জর্ডান ও জাতিসংঘ যৌথভাবে চালায়।

No comments

Powered by Blogger.