অমানুষিক অবর্ণনীয় by সৈয়দ আতিক

দুই পা হারিয়ে তীব্র যন্ত্রণায় কাতর সালমা বেগম ঢাকা
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন-যুগান্তর
শুধু হৃৎপিণ্ডটাই খুলে নেয়া বাকি রেখেছে। এছাড়া শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গই নৃশংসভাবে কেটে ফেলা হয়েছে মাদারীপুরের গৃহবধূ সালমা বেগমের। অজানা-অচেনা কেউ নয়। নিজের ঘরের লোকদের হাতেই এমন অমানুষিক বর্বরতার শিকার হয়ে এখন মৃত্যুর প্রহর গুনতে হচ্ছে তাকে। সামান্য সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে ছোট দেবর রেজাউল হক বেপারি রামদা দিয়ে কুপিয়ে গোড়ালির ওপর থেকে দুই পা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে সালমার। লোভের কোপ থেকে রক্ষা পায়নি হাত দুটিও। এখানেই থামেনি দুর্বৃত্ত দেবর। মাতৃতুল্য ভাবির স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোও ভয়ংকরভাবে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। এ নৃশংসতা বর্ণনাতীত। সালমা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারেন তিন সন্তানের এই মা। আর যদি বেঁচে যান তাহলেও ক্ষতবিক্ষত দেহের ভার কী করে বইবেন, সে প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই।
মাদারীপুরের রাজৈরের পূর্ব শরমঙ্গল টেকেরহাট গ্রামের গৃহবধূ সালমা তার তিন সন্তান, স্বামী ও শ্বশুরকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন। সামান্য কিছু জমিও আছে। স্বামী সামসুল ইসলাম একটি ধানের মিলে (চাতালে) ৭ হাজার টাকা বেতনে চাকরিও করেন। সালমা-সামসুল দম্পতির দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু কাল হল শ্বশুরের ভালোবাসার দান এক টুকরো জমি। ওই জমি কেড়ে নিতেই উন্মত্ত দেবর হামলা চালায় সালমার ওপর।
সালমার শ্বশুর আজিজুল হক বেপারি বয়বৃদ্ধ। সামসুলরা চার ভাই। সবারই আলাদা সংসার। মা-বাবার দায়িত্ব নেন সামসুল। শ্বশুর-শাশুড়ির সেবাযত্নে কখনও কোনো ত্রুটি করেননি সালমা। যেখানে অন্য ছেলের বউরা দেখতেও আসেন না। শাশুড়ির মৃত্যুর পর বৃদ্ধ শ্বশুর প্রায়ই বলতেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি যেন সালমার সেবা পেয়ে যান।
সালমার সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে আজিজুল হক বেপারি একসময় ১২ শতাংশ জমি সামসুল ও তার আরেক ভাই নুরুল হকের নামে রেজিস্ট্রি করে দেন। আর বাড়ির পাশে দেড় বিঘা জমিও দেন চাষাবাদ করতে। আজিজুল বেপারি যে বাড়িতে থাকতেন সে ভিটের অংশটুকু সামসুলের নামে লিখে দেন তিনি।
সালমার তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে সাইদুল ইসলাম জম্মগত প্রতিবন্ধী। মেয়ে সুরাইয়া আক্তার টেকেরহাট প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ছোট ছেলে সালাহউদ্দিন বেপারি একই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী। গ্রামে থাকলেও সালমার ইচ্ছে ছিল দুই সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। কিন্তু স্বপ্নের এই সংসারই ছারখার হয়ে গেল হঠাৎ ঝড়ের তাণ্ডবে। গত রোববার আপন দেবরের বর্বরতার শিকার হয়ে এখন তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। আর সারাক্ষণ ভাবছেন, সামনের দিনগুলোর কথা। কী হবে তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ?
সেদিন কী ঘটেছিল, তা জানতে চাইলে সালমা কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে তার বোন মাহমুদা বেগম ঘটনার বর্ণনা দেন। তাতে উঠে আসে দেবর রেজাউলের পৈশাচিক নির্যাতনের কথা।
মাহমুদা বলেন, রোববার সকাল ৯টার দিকের কথা। সালমা নিজের ঘরে কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় হাতে একটি রামদা নিয়ে ঘরে ঢোকে রেজাউল। রামদা দেখেই চিৎকার করে ওঠেন সালমা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রেজাউল সালমার বুকের উপর উঠে বসে প্রথমে দুই পায়ে, পরে দুই হাতে কোপাতে থাকে। দুই পায়ের একটি রগের সঙ্গে ঝুলে থাকলেও পরে তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নির্বিচারে কোপানোর সময় দুই-তিনবার চিৎকার দিয়ে পরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন সালমা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৬ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন বোন সালমার পাশে বসে মাহমুদা শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, বৃদ্ধ শ্বশুর চলতে পারেন না। অন্য কেউই তাকে দেখে না। সালমা তার শ্বশুরের সেবা করত। এ কারণে খুশি হয়ে তিনি পৈত্রিক ভিটের অংশ তার স্বামী সামসুল এবং আরেকভাই নুরুল হক বেপারির নামে লিখে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন বড় ভাই আবদুল হক বেপারি ও সবার ছোট রেজাউল হক বেপারি।
বোনের বরাত দিয়ে মাহমুদা বলেন, আবদুল হক ও রেজাউল মিলে সালমাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এর অংশ হিসেবেই তার ওপর হামলা চালানো হয়।
মাহমুদার কথা বলার সময়টায় চোখ বন্ধ করেছিলেন সালমা। তার দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল জলের ধারা। অস্ফুট স্বরে একবার বললেন, মেয়ে সুরাইয়ার কী হবে। বললেন প্রতিবন্ধী ছেলে সাইদুলের কথা। ক্ষণেক্ষণে বলছেন ছেলে সালাউদ্দিনের কথাও। জানতে চাইলেন তার সন্তানদের কে দেখবে এখন।
সালমার স্বামী সামসুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পরপরই তিনি সালমাকে প্রথমে ফরিদপুরে স্থানীয় হাসপাতালে নেন। সেখান থেকে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, তার স্ত্রীর ওপর এমন হামলা যে করতে পেরেছে সে তো ভাই হতে পারে না। তিনি এর সুষ্ঠ বিচার চান। বলেন, সংসারটাকে সব সময় খুব আগলে রেখেছিলেন সালমা। তার কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসাব ছিল না। স্বল্প আয়েই সুখের সংসার সাজিয়ে তোলেন সালমা।
সালমার শ্বশুর আজিজুল হক বেপারি মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, রেজাউলকে এখন তো আমার ছেলে পরিচয় দিতেই ঘৃণা হচ্ছে। সে কুপুত্র। এমন ছেলে জেলে পচলেও আমার চোখে এক ফোঁটা পানি আসবে না।
ঢাকা মেডিকেলে বেশ খানিকটা সময় মাহমুদার সঙ্গে কথা হয়। এর একপর্যায়ে সালমা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কিছু কথা বলেন। পাষণ্ড দেবরের কী বিচার চান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিচার তো চাইবই। জানি বিচারও হবে। আবার এটাও জানি, উন্নত চিকিৎসা করেও আমাকে বাঁচানো যাবে না। তারপরও তিনি চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য প্রার্থনা করেন। বলেন, যে ক’দিন বেঁচে থাকব সে ক’দিনের মধ্যেই রেজাউলের বিচার দেখে যেতে চাই।
এদিকে ঘটনার পর রোববারই রাজৈর থানায় মামলা করা হয়। রাজৈর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আফসার আলী জানান, রেজাউলকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। সে ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছে।
নুরুল হক বেপারি বলেন, ঘটনার দিন বাড়িতে একা পেয়ে আমার ছোট ভাই রেজাউল এ নৃশংস ঘটনা ঘটায়। তিনি জানান, প্রায় ১৫ বছর আগে তার ভাই সামসুলের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার মোল্লাদি গ্রামের মাইনুদ্দিন শেখের মেয়ে সালমা বেগমের।
রাজৈর থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, আজিজুল হক বেপারির চার ছেলের সবারই পৃথক সংসার। আজিজুল দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছেলের সংসারে খাওয়া-দাওয়া করতেন। এর কাছে এক মাস, ওর কাছে এক মাস। এভাবে মাস ভাগ করে খেতেন। এর মধ্যে সামসুলের সংসারেই বেশি খেতেন বৃদ্ধ আজিজুল। জমিজমা কিছু নিজের কাছে রেখে বাকি সব ভাগ করে দিয়েছেন ছেলেদের। কিছুদিন আগে নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৯০ শতাংশ জমি তিনি ভাগ করে দেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় ছেলে এবং এক মেয়েকে। এতে বড় ছেলে আবদুল হক ও সবার ছোট ছেলে রেজাউল ক্ষুব্ধ হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, সালমাকে কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করার পর রেজাউল ঘর থেকে বের হয়ে টিউবওয়েলে গিয়ে রামদা ধুয়ে ফেলে। এ সময় আবদুল হকের ছেলে রিয়াজ এসে জিজ্ঞেস করে, ‘কাক্কু রামদা দিয়ে কী জবাই করেছ যে রক্ত ধুয়ে ফেলছ?’ উত্তরে রেজাউল বলে, ‘কী জবাই করেছি তা তুই বুঝবি না। পরে জানতে পারবি।’
সালামার বোন শাহজাদি বলেন, ঢাকায় আসার সময় সালমার পা দুটো ও ডান হাত ঝুলে ছিল। ওগুলো আমরা সঙ্গে নিয়ে এসেছি যদি কাজে লাগে। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন, দুটি পা আর জোড়া লাগবে না। এখন দুই হাতেরও ভরসা নেই। সালমার দেহের আরও যেসব স্পর্শকাতর স্থান কুপিয়ে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে তার চিকিৎসা কী হবে, তা জানেন না তার স্বজনরা।

No comments

Powered by Blogger.