কেঁপে উঠল প্যারিস by পামেলা ড্রাকারম্যান

এটা একেবারেই স্বাভাবিক ডিনার পার্টি ছিল, যতক্ষণ না কেউ একজন উঠে দাঁড়িয়ে মুঠোফোন দেখে বলল, আমার মনে হয়, ফ্রান্সের জাতীয় স্টেডিয়ামে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে।
আমার স্বামী একজন সাংবাদিক, তিনি সেই ডিনার পার্টিতে ছিলেন না, ছিলেন সেই স্তাঁদ দ্য ফ্রঁসে। সবাই নিজেদের মুঠোফোন বের করা শুরু করল। তখন আমি এমন এক কথা বললাম, যেটা প্যারিসের ডিনার পার্টিতে আমি কখনো বলিনি: আমরা কি টিভি ছাড়তে পারি?
শিগগিরই মানুষের চোখ মুঠোফোনের পর্দায় স্থির হয়ে গেল, তাঁরা পরিচিত স্থানের নাম উচ্চারণ করছিলেন: লা ক্যামবোজ রেস্তোরাঁ ও সেন্ট মার্টিন ক্যানেলের পাশে হিপস্টার নুডল শপ। এই ডিনার পার্টিতে আসার সময় আমি এটার পাশ দিয়েই এসেছি (পরবর্তী সময়ে আমরা জানতে পারলাম, লা পেটিট ক্যামবোজের বর্ধিত অংশে এই গুলিবর্ষণ হয়েছে)। দৃশ্যত, লা বাতাক্লঁতে মানুষকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে, যে কনসার্ট হলের পাশ দিয়ে আমি ছেলেকে চোখের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিকেল পাঁচটার সময় হেঁটে গিয়েছি, সেখানে একটি বড় বাস দাঁড় করানো ছিল।
ফরাসি টিভি বা যে টিভি চ্যানেলই আমরা দেখেছি, তারা কেউই বলতে পারছিল না যে আসলে কী হয়েছে। কিন্তু ডিনার পার্টির অতিথিরা টুইটারে ঢুঁ মারছিলেন, আর নিহত মানুষের সংখ্যার হিসাব দিচ্ছিলেন। কে কীভাবে জানবে, কত মানুষ মারা গেছে? এমনকি আমরা একটা ক্যামেরাও দেখলাম না, যেটা লা বাতাক্লঁতে যে মানুষের জিম্মি করে রাখা হয়েছে, তাদের ছবি দেখাচ্ছে।
আমি আমার স্বামীকে ফোনে পেলাম, তিনি জাতীয় স্টেডিয়ামের ভেতরেই ছিলেন, সেখান থেকে তিনি টুইট করছিলেন, আর একটি ডাচ্ বেতারকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। এক ঘণ্টা পর আমি তাঁকে বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে শুনলাম। তিনি বললেন, বিস্ফোরণ হওয়ার পরও খেলা চলেছে আর ফরাসি দলের ভক্তরা প্রিয় দলের গোল উদ্যাপন করেছে, গ্যালারিতে ‘ঢেউ’ তুলেছে।
নিউইয়র্কের এক বন্ধু টুইটারে দেখেছেন, আমার স্বামী স্টেডিয়ামের ভেতরেই আছেন, সেই বন্ধুটির আবার নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ আছে। গোলাগুলি হলে কী করতে হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে তিনি আমাকে খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন: ‘যতটা পারা যায় মাটির সঙ্গে লেপ্টে থাকুন, সরতে হলে বুকে ভর দিয়ে চলাচল করুন।’ এই বার্তাটা আমি আমার স্বামীকে ই-মেইল করলাম। তিনি এমনিতেই মনে করেন, আমি একটু বেশি সতর্ক, তিনি কি এবারও তা-ই ভাববেন?
কেউ একজন খোঁজ নিল, লা বাতাক্লঁতে কারা গান গাচ্ছিল। জানা গেল, ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যান্ড দল ইগলস অব ডেথ মেটাল সেখানে গান গাচ্ছিল। ডিনার পার্টির এক দম্পতি তাঁদের কিশোর সন্তানদের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আমি আমার বেবিসিটারকে ফোন করলাম, ভাইকে খুদে বার্তা পাঠালাম। টুইটারে চিনি এমন একজন মানুষও আমাকে খুদে বার্তা পাঠালে আমি তার জবাব দিই। ডিনার পার্টির দুজন সদস্য তাঁদের সাবেক প্রেমিকার কাছ থেকে খুদে বার্তা পান।
আমি বললাম, ‘এটা শার্লি এবদোর চেয়েও ভয়ংকর।’ এক ঘরভর্তি মানুষকে লক্ষ করে আমি এ কথা বললাম, যাঁরা তার কয়েক মিনিট আগেই বুনো শূকরের মাংস দিয়ে তৈরি পাস্তা খাচ্ছিলেন অথবা মারজিপান চেখে দেখছিলেন। দৃশ্যত, এর মাত্রা ইতিমধ্যে সবার কাছেই দৃশ্যমান ছিল। আরেকটি কথা, লা বাতাক্লঁ কিন্তু শার্লি এবদোর আগের কার্যালয়ের কাছাকাছি।
টেলিভিশনের পর্দায় দুটি মানচিত্র ভেসে উঠল, সেখানে যে দুটি স্থানে গোলাগুলি হয়েছে, তা চিহ্নিত করা হয়েছে। আমার বাড়ি আবার ওই দুটি স্থানের ওপারেই। আবারও খবরে যে প্যারিসের কথা বলা হচ্ছে, সেটা আমারই প্যারিস। এই শহরটিতেই একসময় শ্রমিক শ্রেণির পদচারণা ছিল, যেখানে এখন আমাদের মতো বুর্জোয়া বোহেমিয়ানরা থাকে।
যেসব মানুষ রাস্তায় আটকা পড়েছে, তাদের সহায়তা করার জন্য ফরাসি জনগণ টুইট করছে, দরজা খুলে দাও। আমরা সবাই বুঝতে পারি, এই আহ্বানে মানুষের প্রতি উন্মত্ত ভালোবাসা আছে, কিন্তু এ সময় কে দরজা খুলবে? খবরে বলা হচ্ছে, বন্দুকধারীরা এখনো রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ মানুষকে সতর্ক করছে, তারা যেন বাড়ির বাইরে না যায়।
আমাদের আতিথ্যকর্ত্রী সে রাতের জন্য অতিরিক্ত কয়েকটি বিছানা পাড়লেন। ডিনার পার্টির সেই দম্পতি বোঝার চেষ্টা করলেন, তারা প্যারিসের পশ্চিমে গাড়ি চালিয়ে যেতে পারবেন কি না। তাদের বাচ্চারা ভালো আছে, কিন্তু ওরা বাড়িতে একা। আমার স্বামী তখনো স্টেডিয়ামের ভেতরে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিজেও স্টেডিয়ামে জার্মানি-ফ্রান্স ম্যাচ দেখছিলেন, তিনি সেখান থেকে বের হয়ে এসে ঘোষণা দেন, ফ্রান্সের সীমান্ত বন্ধ। নিশ্চিতভাবে স্কুলগুলোও বন্ধ থাকবে। আমি কারফিউ শব্দের ফরাসি প্রতিশব্দ শিখলাম: কুভর-ফু। খবরে প্রতিবেদন প্রচারিত হচ্ছে, লা বাতাক্লঁর ভেতরে অনেক মানুষ মারা গেছে। সংখ্যাটা এখনো ধারণা করা যাচ্ছে না।
আমার বাচ্চারা ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু বেবিসিটার ঘুমাননি। আমি শুধু ভাবছিলাম, ওরা ঘুম থেকে জেগে উঠলে আমি কী বলব?
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
পামেলা ড্রাকারম্যান: প্যারিসে বসবাসরত মার্কিন লেখক।

No comments

Powered by Blogger.