আক্রান্ত প্যারিস- জরুরি অবস্থা ঘোষণা, সীমান্ত বন্ধ, আইএসের দায় স্বীকার

রক্তস্নাত প্যারিস। আক্রান্ত প্যারিস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্যারিসে এমন ভয়াল রাত আর কখনও আসেনি। ফ্রান্সের রাজধানী শহরটি দুনিয়াব্যাপী পরিচিত ছবি আর কবিতার শহর হিসেবেই। শুক্রবার রাতটি অন্যান্য দিনের মতোই শুরু করেছিলেন নগরের বাসিন্দারা। তবে মুহূর্তের মধ্যে তাদের জীবনে নেমে আসে বিভীষিকা। ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন তারা। একের পর এক বিস্ফোরণ আর গুলিতে প্যারিস পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরীতে। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এ হামলায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১২৮ জন। আহত হয়েছেন কয়েক শ। আট হামলাকারীও নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে সাত জন মারা যায় আত্মঘাতী বিস্ফোরণে। একজন নিহত হয় পুলিশের গুলিতে।
এ হত্যাযজ্ঞের পর ফ্রান্সজুড়ে জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। কর্তৃপক্ষ স্থানীয় অধিবাসীদের ঘরের বাইরে বের হতে নিষেধ করেছে। আশেপাশের এলাকার স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত সেনা। এ হামলার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদেও এ হামলার জন্য আইএসকে দায়ী করেছেন। এ হামলায় নিন্দার ঝড় উঠেছে সারা দুনিয়াতে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ থেকেই হামলার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। নাইন ইলেভেনের হামলার পর এ হামলাকেই ইউরোপে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই প্যারিসে সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ।
স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৮টা নাগাদ প্রথম হামলাটি হয় স্ট্যাডে ডি স্টেডিয়ামের বাইরে। সেখানে তখন ফ্রান্স-জার্মানি প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ চলছিল। স্টেডিয়ামে হাজির ছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঁসোয়া ওঁলাদে। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাকে স্টেডিয়াম থেকে বের করে নেয়া হয়। একের পর এক হামলা শুরু হয় প্যারিসের বিভিন্ন প্রান্তে। সবচেয়ে বড় হামলাটি হয়েছে বাতাক্লাঁ কনসার্ট হলে। স্লোগান তুলে ভিড়ে ঠাসা হলে ঢুকে পড়ে আত্মঘাতী বাহিনী। শুরুতেই শতাধিক দর্শককে পণবন্দি করে নেয় সন্ত্রাসীরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, পণবন্দিদের অনেককেই সন্ত্রাসীরা একে একে গুলি করে মারছিল। এরপর সেনা অভিযান শুরু হতেই একের পর এক আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকে সন্ত্রাসীরা। কনসার্ট হলে হামলাতেই শ’খানেক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। একই সময় আলাদা আলাদা হামলা চলতে থাকে পানশালা, রেস্তরাঁ, শপিং সেন্টারে। মোট ছয় জায়গায় হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা।
সন্ত্রাসীদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর ফ্রান্সজুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক। শোকে মুহ্যমান জনতা। আক্রান্ত প্যারিসে দম বন্ধকরা এক পরিবেশ। রাস্তাগুলোতে এখন ভয় আর শঙ্কা। চারদিকে শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থা। হামলার খবরে ফ্রান্সের মানুষ যেন হিম হয়ে গেছে। ঘরের বাইরে পা পড়ছে না। শুধু কয়েকটি শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘হরর’ ‘ম্যাসাকার’ আর ‘ওয়ার’। টেলিভিশন খুললেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে ভয়াবহ রক্তাক্ত একটি রাতের বিভীষিকা। তা দেখে গা শিউরে উঠছে প্যারিস, তথা ফ্রান্সের মানুষের।
১০ মাস আগে জানুয়ারিতে শার্লি হেবদোতে সন্ত্রাসী হামলায় বিপর্যস্ত হয়েছিল প্যারিস। এবারে আবারও সন্ত্রাসের ভয়াল থাবা আঘাত হেনেছে শহরটিতে। ফরাসি সংবাদিক অ্যান শার্লোট হিনেট সিএনএনকে বলেন, এ মুহূর্তে প্যারিস একপ্রকার অবরুদ্ধ। ফ্রান্স রেডিওর ডেপুটি এডিটর গ্রেগরি ফিলিপস বলেন, প্যারিসের পরিস্থিতি খুবই থমথমে। মানুষজন আতঙ্কিত। হামলার সময় বা এর পরে যারা নিজ বাড়ি থেকে দূরে ছিলেন তারা স্থানীয় দোকানপাট বা বন্ধু-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নানা পোস্টে দেখা গেছে অপরিচিত ব্যক্তিরাও বাইরে আটকে পড়া মানুষদের আশ্রয় দিচ্ছেন। সবমিলিয়ে বিরাজ করছে, আতঙ্ক, বেদনা আর শোকের আবহ। নির্মম সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এসব হামলার জবাবও হবে নির্মম (রুথলেস)। এ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনে ফ্রান্সকে সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
হামলার সময় বাতাক্লাঁ কনসার্ট হলে উপস্থিত ছিলেন পিয়ারস নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, যাতে গুলি না লাগে সেজন্য আমরা মেঝেতে শুয়ে পড়ি। তখন শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থা। সন্ত্রাসীরা আমাদের দিকে গুলি চালায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট। এর মধ্যেই কনসার্ট হল পরিণত হয় রক্তস্রোতে। এর ভেতরে ফরাসি সেনারা প্রবেশ করার আগেই সন্ত্রাসীরা জিম্মি করে অনেককে। পুলিশ গিয়ে সেখান থেকে উদ্ধার করেছে প্রায় ১০০ মানুষকে। এখানে অভিযানে অংশ নেয়া সন্ত্রাসীদের মধ্যে তিনজনের পরনে ছিল বিস্ফোরকে তৈরি বেল্ট। প্রসিকিউটরের মুখপাত্র অ্যাগনেস থিবাল্ট-লেসুইভরে বলেন, প্যারিস ও পার্শ্ববর্তী ছয়টি স্থানে হামলার সময় আটজন সন্ত্রাসী আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয়েছে। তবে তারা বলতে পারেন নি যে, সব সন্ত্রাসীই নিহত হয়েছে কিনা। এছাড়া, অপারেশনে মোট কি পরিমাণ সন্ত্রাসী অংশ নিয়েছিল তাও তারা আন্দাজ করতে পারছেন না।
লি পেটিট ক্যামবোজ রেস্তরাঁয় সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে কমপক্ষে ১৪ জনকে। এছাড়া, প্যারিসের ১০ম জেলায় অন্য একটি ক্যাম্বোডিয়ান রেস্তরাঁয় হামলায় নিহত হয়েছেন চারজন। এভিনিউ দি লা রিপাবলিকে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন চারজন। লা বেলে ইপুইপে বারের বাইরে হত্যা করা হয়েছে ১৯ জনকে। ফ্রান্স রেডিও’র উপ-সম্পাদক গ্রেগরি ফিলিপস বলেছেন, প্যারিসের অবস্থা এখন ভীষণ উত্তেজনাকর। লোকজন ঘরের বাইরে যাচ্ছে না। এখনও হামলাকারীদের কেউ কেউ বাইরে রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এসব হামলায় স্তব্ধ বিশ্ব বিবেক। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, আমরা এ লড়াই চালিয়ে যাবো এবং তা হবে নির্মম। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ হামলায় শোক প্রকাশ করে ফোন করেছেন ওঁলাদেকে। এ সময় তিনি সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই ও হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এখনও কোন বিশ্বাসযোগ্য বা বিশেষ কোন হুমকি নেই। পরে হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ওঁলাদে ও ওবামা দু’নেতা একত্রে বাকি বিশ্বকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেল বলেছেন, হামলাকারীরা স্বাধীনতায় ঘৃণা করে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার দেশ সমর্থন দেবে। এ হামলার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
দায় স্বীকার আইএস-এর, ফের হুমকি
প্রকাশিত এক ভিডিওতে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। জঙ্গি কর্মকাণ্ডের ওপর নজরদারিমূলক প্রতিষ্ঠান সাইট (এসআইটিই) ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ আইএস-এর দায় স্বীকারের কথা উল্লেখ করেছে। এর পরিচালক রিটা কাটজ তার টুইটারে বলেন, ফরাসি ও আরবি ভাষায় লেখা বিবৃতিতে দায় স্বীকার করেছে আইএস। ওদিকে গতকালই আইএস একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করে ফ্রান্সে আরও হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। তারা বলেছে, যদি তাদের যোদ্ধাদের ওপর ফ্রান্স বোমা হামলা অব্যাহত রাখে তাহলে তারা ফ্রান্সে আরও হামলা চালাবে। এসব খবর প্রকাশিত হয়েছে আল-জাজিরা, বার্তা সংস্থা রয়টার্সসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। প্যারিসে ভয়াবহ বোমা হামলার পরদিনই আইএস’র বৈদেশিক মিডিয়া শাখা আল হায়াত মিডিয়া সেন্টার ওই হুমকি দেয়। এতে তারা ফরাসি মুসলমানদের হামলা চালানোর আহ্বান জানায়। ওই ভিডিওতে শশ্রূমণ্ডিত আরবিভাষী এক জঙ্গি বলতে থাকে, যতদিন তোমরা বোমা হামলা চালানো অব্যাহত রাখবে ততদিন তোমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারবে না। এমনকি তোমরা বাজারে যেতেও আতঙ্কিত হবে। প্রসঙ্গত, শুক্রবার দিবাগত রাতে সন্ত্রাসী হামলায় প্যারিসে কমপক্ষে ১৫৩ জন নিহত হন। ফ্রান্স সরকার এ ঘটনায় দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করেছে। ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলো রয়েছে সতর্কাবস্থায়। ওদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ এ হামলার জন্য আইএসকে দায়ী করেছেন। তিনি এ হামলাকে বর্বরোচিত বলে আখ্যায়িত করেছেন। মধ্যরাতে জাতির উদ্দেশে তিনি এক ভাষণে এ হামলাকে একটি ভীতিকর অবস্থা বলে মন্তব্য করেন। ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট ওঁলাদ সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। একই সঙ্গে সমস্ত সীমান্ত অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছেন, যাতে কোন ঘাতক পালাতে না পারে। ঘটনার পর সবচেয়ে বেশি রক্তপাতের স্থান তিনি পরিদর্শন করেন। সেটি হলো বাটাক্লাঁ মিউজিক হল। সেখানে ওঁলাদ ঘোষণা করেন তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নির্দয়ভাবে লড়াই চালিয়ে যাবেন। ওদিকে গতকাল প্যারিসের মেট্রো রেল, স্কুল, ইউনিভার্সিটি, মিউনিসিপ্যাল ভবনগুলো বন্ধ ছিল। পরের দিকে কিছু রেল ও বিমান চলাচল শুরু হওয়ার কথা।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ভারতে উচ্চসতর্কতা
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়েছে বিশ্বের অনেক দেশে। হামলার পর পর তাৎক্ষণিকভাবে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক, বোস্টন, শিকাগো ও অন্যান্য শহরের কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ইউরোপজুড়ে চলছে উচ্চমাত্রার সতর্কতা। বৃটেনের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-ফাইভ লন্ডনেও একই ধরনের হামলার আশঙ্কা করছে। দেশটির গ্যাটউইক বিমানবন্দর নিরাপত্তাজনিত কারণে খালি করে ফেলা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ‘কোবরা’য় বসেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। এ ছাড়া নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়েছে ভারতের দিল্লি, মুম্বই ও আহমেদাবাদেও। এ খবর দিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস, ব্রিজবেন টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান ও এনডিটিভি।
নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগ বলছে, হামলা ঠেকানোর জন্য নয় বরং পূর্বসতর্কতা হিসেবেই নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যস্ততম এ শহরে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর চালানো হয়েছিল কুখ্যাত হামলা। ওই হামলায় বাংলাদেশীসহ নিহত হন প্রায় ৩ হাজার মানুষ। ধ্বংস হয়ে যায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার। তবে পরে নতুন করে নির্মিত টুইন টাওয়ার ও এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংজুড়ে জ্বল জ্বল করছে নীল ও লাল রঙের আভা। ফ্রান্সের পতাকা নীল ও লাল রঙের। ফ্রান্সের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের জন্যই এ উপায় বেছে নিয়েছে ভবন দুটির কর্তৃপক্ষ। একই সাজ নিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি অপেরা হাউজ ও ব্রিজবেনের স্টোরি ব্রিজ। তবে অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তার দেশ বিদ্যমান সতর্কাবস্থাই বহাল রাখবে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিচার করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে সতর্কাবস্থা পরিবর্তন করা হবে কিনা।
লন্ডনে বন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা। দেশটির পুলিশ জানিয়েছে, এ নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে। প্যারিস হামলার পর পর বৃটেনের গ্যাটউইক বিমানবন্দর নিরাপত্তাজনিত কারণে খালি করে দেয়া হয়। হামলার পর পর হোয়াইট হলে মন্ত্রণালয়ের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। বৃটেনের কর্মকর্তারা এ ধরনের হামলার আশঙ্কা করছেন। দেশটির গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ফ্রান্সের পরিস্থিতির দিকে তীক্ষ্ন নজর রাখছেন। এ ধরনের হামলা ঘটতে পারে ধরে নিয়েই প্রস্তুতি শুরু করেছে বৃটিশ পুলিশ।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়িয়েছে। বেলজিয়াম জানিয়েছে, তারা ফ্রান্সের সঙ্গে সীমান্ত সাময়িকভাবে বন্ধ করে রেখেছে। নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়েছে জার্মানির বার্লিনেও।
এদিকে ভারতের রাজধানী দিল্লি ও মুম্বইয়ে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। মুম্বইয়ের আগেও হামলার শিকার হয়েছিল। ভারতের ইহুদি সিনাগগগুলোতে নেয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা।
বিশ্ব নেতাদের নিন্দা
ফ্রান্সের প্যারিসে ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ব নেতারা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এসব হামলাকে নিরপরাধ সাধারণ মানুষের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টির গর্হিত প্রচেষ্টা বলে আখ্যা দেন। দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার প্রতিশ্রুতিও দেন ওবামা। এ হামলাকে পুরো মানবতার ওপর হামলা বলে আখ্যা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বক্তব্যেও একই কথা প্রতিধ্বনিত হয়। কেরি আরও বলেন, ফরাসি সরকারের যত ধরনের সহায়তা প্রয়োজন তা দিতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের মহাসচিব বান-কি মুন প্যারিসের ‘অত্যন্ত গর্হিত সন্ত্রাসী হামলাগুলোর’ নিন্দা জানান। হামলাগুলোকে ‘বর্বর এবং কাপুরোষিত’ আখ্যা দিয়ে নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন, প্যারিস থেকে সেসব খবর আর ছবি আমাদের কাছে আসছে তাতে আমরা গভীরভাবে দুঃখভারাক্রান্ত। এক বিবৃতিতে তিনি হামলায় ভুক্তভোগীদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেন, প্যারিস হামলায় তিনি ‘স্তব্ধ’। এক টুইট বার্তায় ক্যামেরন বলেন, ফরাসি নাগরিকদের প্রতি আমাদের প্রার্থনা রইলো। আমরা সহায়তা করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করবো। চীনের প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিং ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদেকে ফোন করে বলেছেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ফ্রান্স ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগ দিতে চীন প্রস্তুত। এছাড়াও তিনি ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকেও নিন্দা জানানো হয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার নিন্দা জানিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ফরাসি জনগণের পাশে রয়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, কালো আর ভয়াবহ এ সময়ে আমাদের ফরাসি ভাইদের প্রতি হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে সমবেদনা ও প্রার্থনা রইলো। ফরাসি সরকারকে তার সরকার সকল ধরনের সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে বলেও তিনি জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এক টুইট বার্তায় নির্মম সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ভারত কঠিন এ সময়ে ফ্রান্সের জনগণের পাশে রয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, শুক্রবার রাতের ভয়াবহ ওই সিরিজ হামলায় মারা গেছেন কমপক্ষে ১৫৩ জন। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতারা শোক ও নিন্দা প্রকাশ অব্যাহত রেখেছিলেন।
বেঁচে আছি, শুধুই মৃত্যু...
ব্যাটাক্লাঁ থিয়েটার হলের দরজা আটকে তাণ্ডবলীলা চালাচ্ছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। চোখের সামনে বেঞ্জামিন কেজনোভস দেখতে পাচ্ছেন, সন্ত্রাসীদের কালাশনিকভের গুলি নিমিষে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে দর্শকদের। সেই অবস্থাতেও হাল হারান নি তিনি, চালু রেখেছেন নিজের ফেসবুক। প্যারিসের ব্যাটাক্লাঁ কনসার্ট হলে জিম্মি অবস্থায় ফেসবুকে নিজের কথা জানিয়েছেন তিনি। ফেসবুকে আতঙ্কে ভরা সেসব পোস্ট ভাইরাল হতে সময় লাগেনি। এ খবর দিয়েছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
ফরাসি ভাষায় লেখা বেঞ্জামিনের পোস্ট বিং ট্রান্সেলটর অনুবাদ করার পর যা দাঁড়ায়, তা হলো: ‘আমি এখনও ব্যাটাক্লাঁয় আটকে। আঘাত খুব গভীর। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলছে। অনেকেই ভেতরে আটকে আছে। সবাইকে মেরে ফেলছে। একজনের পর একজন। দোতলায়, তাড়াতাড়ি!’
বেঞ্জামিনের এ ফেসবুক পোস্ট থেকে হিমশীতল আতঙ্কের চিত্র সপষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই পোস্ট ২০ হাজার বার ফেসবুকে শেয়ার হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা পর ফের ফেসবুকে নিজের অবস্থার কথা জানান বেঞ্জামিন। এবার তিনি লেখেন: ‘বেঁচে আছি। শুধুই মৃত্যু... ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ... চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাশ। এবার বেঞ্জামিনের পোস্টে শ’ শ’ মন্তব্য পড়ে। তিনি কেমন আছেন, তা জানতে চান অনেকে। বেঞ্জামিন যে বেঁচে আছেন, তাতেই স্বস্তির শ্বাস ফেলেন সবাই।
‘যেনো রক্তস্নান’
সন্ত্রাসীরা যখন প্যারিসের বাটাক্ল্যাঁ থিয়েটারে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি গুলি করা শুরু করে তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন জুলিয়েন পিয়ার্স। তিনি একজন রেডিও রিপোর্টার। নির্মম হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে পিয়ার্স বলেন, রক্তস্নান চলছিল। থিয়েটারের ভেতরে উপস্থিত অনেককে জিম্মি করে নেয় জঙ্গিরা। সিএনএনকে পিয়ার্স বলেন, মানুষজন চিৎকার করছিল। কমপক্ষে ১০ মিনিট তাদের আর্তচিৎকার শোনা গেছে। প্রত্যেকে তখন নিজেদের মাথা ঢেকে ফ্লোরে বসে পড়ে। পিয়ার্স বলেন, গোলাগুলি যখন শুরু হয় তখন তিনি মঞ্চের ওপরের দিকের কাছাকাছি ছিলেন। দুজন সন্ত্রাসীকে প্রবেশ করতে দেখেন তিনি। ওরা ছিল ‘অত্যন্ত শান্ত আর সংকল্পবদ্ধ’। তারা এলোপাতাড়ি গুলি করা শুরু করে। তারা কালো পোশাক পরেছিল। তবে কোন মুখোশ ছিল না। পিয়ার্স জানান, তিনি একজন হামলাকারীর চেহারা দেখতে পেয়েছিলেন। তার বয়স খুব বেশি হলে ২৫ বলে উল্লেখ করেন তিনি। পিয়ার্স বলেন, বন্দুকধারীরা কক্ষের পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে ফ্লোরে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে গুলি করা শুরু করে। বন্দুকধারীদের বর্ণনা দিতে গিয়ে পিয়ার্স বলেন, ওরা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিল। আর আমাদের দিকে গুলি করছিল। যেন আমরা একদল পাখি আর তারা পাখিগুলোর দিকে নির্বিচারে গুলি করছে। অপর এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, পুরো নরকের দৃশ্য আবির্ভূত হয়েছিল যেন। পিয়ার্স জানান, তিনি তার আশেপাশের মানুষদের পড়ে থেকে মরার অভিনয় করতে বলেন। বন্দুকধারীদের ম্যাগাজিনের গুলি শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করেন। জঙ্গিরা যখন বন্দুক রিলোড করছিল তখন পিয়ার্সরা দৌড়ে একটা খালি কক্ষে চলে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন বের হওয়ার কোন পথ নেই। পিয়ার্স বলেন- আমরা আটকে পড়েছিলাম। আরও পাঁচ মিনিট গোলাগুলি চললো। বন্দুকধারীরা গুলি করা বন্ধ করে। এরপর তারা আবারও রিলোড করে। ওই সুযোগে আবার দৌড় দেন পিয়ার্স। সামনে একটা দরজা দেখতে পেয়ে তা দিয়ে বাইরে চলে আসেন পিয়ার্স। বের হওয়ার পথে এক তরুণীকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তিনি।  রক্ত বইছিল তার পা দিয়ে। তাকে ধরে পিঠে উঠিয়ে দৌড় দেন পিয়ার্স। ২০০-৩০০ মিটার যাওয়ার পর মেয়েটিকে একটি ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। রাস্তায় পৌঁছে ২০-২৫ জনকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। এদের বেশিরভাগই মৃত বা আহত হয়ে পড়েছিল। বাইরে বেরিয়ে প্রথমে কোন পুলিশ সদস্যকে দেখেননি। সিএনএন-এর সঙ্গে পিয়ার্স যখন প্রথম কথা বলেন তখন তিনি জানান, তার অনেক বন্ধু তখনও ব্যাটাক্লাঁর মধ্যে আটকে ছিলেন। পরে বাইরে থেকে মোবাইলে টেক্স মেসেজে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন পিয়ার্স। ওরা সবাই লুকিয়ে ছিল। ভাঙা কণ্ঠে পিয়ার্স বলেন, এটা ভয়াবহ ছিল। ভয়ঙ্কর। ব্যাটাক্লাঁ থিয়েটারে কমপক্ষে মারা যায় ১১২ জন। এছাড়া পৃথক হামলায় রু বিচাত এলাকায় ১৪ জন, রু দে শারোন এলাকায় ১৯ জন, ডে লা রিপাবলিকা এভিনিউতে ৪ জন ও অপর চার জন মারা যায় স্টাডে দে ফ্রান্স স্টেডিয়ামের বাইরে। সবমিলিয়ে সিরিজ সন্ত্রাসী হামলায় ঝরে যায় ১৫৩টি প্রাণ। পুলিশ ব্যাটাক্লাঁতে প্রবেশ করার পর বোমা বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল বাইরে থেকে। অভিযানে চার হামলাকারী নিহত হয়। এদের তিনজন ছিল আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী। তাদের শরীরে বোমা স্থাপন করা ছিল। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কমপক্ষে ১০০ জন জিম্মি ব্যক্তিকে তারা বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়।

No comments

Powered by Blogger.