মকবুলার ভাই, এ কেমন চলে যাওয়া? by সোহরাব হাসান

মকবুলার রহমান
সংবাদ থেকে বন্ধু হারাধন গাঙ্গুলি যখন টেলিফোনে খবরটি দিলেন, নিজেকে অপরাধী মনে হলো। বেশ কিছুদিন ধরে মকবুল ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও যাওয়া হয়নি। তিনি খুব অসুস্থ ছিলেন, বলা যাবে না। দুদিন আগেও ঘনিষ্ঠ বন্ধু মঈদুল হাসানের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। তিনি গাইবান্ধায় তাঁর গ্রামের বাড়িতে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই ২৮ অক্টোবর রাতে চলে গেলেন না–ফেরার দেশে।
মকবুল ভাই। ড. মকবুলার রহমান। এ প্রজন্মের মানুষ হয়তো তাঁকে চেনে না। চেনার কথাও নয়। গেল শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যে একগুচ্ছ উজ্জ্বল মেধাবী তরুণ বামপন্থায় দীক্ষা নিয়েছিলেন, মকবুলার রহমান ছিলেন তাঁদেরই একজন। মেধা, মনন, চিন্তা ও সহৃদয়তায় তাঁর সমকক্ষ মানুষ খুব কম দেখেছি। তিনি পদার্থবিজ্ঞানের চৌকস শিক্ষার্থী ও ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সেই সূত্রে পাকিস্তান আমলের নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে ষাটের দশকের একেবারের গোড়ার দিকে মকবুলার রহমান তখন বিরোধী কণ্ঠ হিসেবে পরিচিত দৈনিক ইত্তেফাক–এর সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। সে সময়ে তাঁর সহকর্মী এবং রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ছিলেন মঈদুল হাসান, আহমেদুর রহমান প্রমুখ। ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, তাঁদের ‘লাল মিয়া’ বলে সম্বোধন করতেন। সম্পাদক হিসেবে তিনি ছিলেন পাকা জহুরি, নিজে কমিউনিস্টবিরোধী হয়েও মেধাবী বাম তরুণদের কাজে লাগিয়েছেন। উভয় পক্ষ সীমা মেনে চলত। আলাপ প্রসঙ্গে একবার মকবুল ভাই বলেছিলেন, কমিউনিজমের বিরুদ্ধে কিছু লিখতে হলে মানিক মিয়া অন্যদের দিয়ে লেখাতেন; তাঁদের
লিখতে বলতেন না। সে সময়ে লেখাপড়া ও রাজনীতির সূত্রে মকবুলার রহমান আরও যাঁদের কাছাকাছি আসেন, তাঁরা হলেন দ্বিজেন শর্মা, দেবদাস চক্রবর্তী, আমিনুল ইসলাম, বজলুর রহমান, মোহাম্মদ ফরহাদ, আবদুল হালিম, এনায়েতউল্লাহ খান, আনোয়ার জাহিদ, আতাউস সামাদ প্রমুখ।
বছর খানেক পর মকবুলার ইত্তেফাক ছেড়ে পাকিস্তান বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের পত্রিকায় চাকরি নিয়ে করাচি চলে যান। সেখান থেকে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে যোগ দেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান পিএইচডি করতে এবং সেখানে অধ্যয়ন ও শিক্ষকতায় ১১ বছর কেটে যায়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে নাইজেরিয়ায় যান ১৯৭৭ সালে, সেখানেও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দশকেরও বেশি সময় অধ্যাপনা করেন। ১৯৮৯ সালে মকবুল ভাই দেশে ফিরে আসেন। সেটি ছিল তাঁর অবসর নেওয়ার সময়। কিন্তু অবসর নেওয়া হয় না। একদিন পুরোনো বন্ধু বজলুর রহমানের সঙ্গে দেখা হলে তিনি মকবুলার রহমানকে সংবাদ-এ যোগদানের আমন্ত্রণ জানান। সেই থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি সংবাদ পত্রিকায় কাটিয়ে দিলেন।
মকবুলার রহমান ছিলেন বিজ্ঞানের মানুষ। কিন্তু সাংবাদিকতা থেকে সাহিত্য, রাজনীতি থেকে দর্শন, ভূগোল থেকে পরিবেশ—সব বিষয়ে তাঁর ছিল অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ও উৎকর্ষ। যেকোনো জটিল বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি ধীরস্থিরভাবে বুঝিয়ে দিতেন। ইংরেজি বানান জিজ্ঞেস করলে জানা থাকলেও নিশ্চিত হতে আরেকবার অভিধান দেখে নিতেন। এ রকমই শুদ্ধতাবাদী ছিলেন তিনি।
জ্ঞানজগতের সব শাখায়ই মকবুলার রহমানের ছিল সমান পদচারণ। ছাত্রজীবনেই তিনি জাঁপল সাত্রের অস্তিত্ববাদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতেন। বিজ্ঞানের মানুষ হয়েও তিনি কবিতাকে এত গভীরভাবে ভালোবেসেছেন যে, মনে হতো কবিতামগ্ন মানুষ। সমকালীন ইংরেজি কবিতার নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন। তিনি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে, সমর সেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের নিবিড় ও নিমগ্ন পাঠক। তাঁদের পদ্য তো বটেই, গদ্যও পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি মুখস্থ বলে যেতে পারতেন। তিনি জীবনানন্দ দাশের ‘হাওয়ার রাত’ কবিতাটির নিচের কয়েকটি পঙ্ক্তি প্রায়ই আবৃত্তি করতেন:
অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের
মতো ঝলমল করছিলো সমস্ত নক্ষত্রেরা;
জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রাণীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার
শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ!
কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিলো।
প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির ভেজা চোখ সবাই দেখতে পায় না। সবাই জ্যোৎস্নারাতে চিতার উজ্জ্বল শালের মতো জ্বলজ্বলে আকাশও দেখেন না। মকবুলার রহমান দেখেছিলেন।
তিনি ছিলেন একই সঙ্গে প্রচণ্ড জীবনবাদী ও জগৎবিরাগী মানুষ। অর্থবিত্ত–প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতার এই সমাজে কী করে একজন মানুষ এসবের প্রতি এতটা নিরাসক্ত থাকতে পারেন, মকবুলার রহমানকে না দেখলে বোঝা যেত না। বিচিত্র বিষয়ে গভীর অভিনিবেশ ছিল তাঁর। কিন্তু কখনো পাণ্ডিত্য জাহির করতেন না। তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল নিরপেক্ষ, দৃষ্টি ছিল নির্মোহ। সূক্ষ্ম রসবোধের মধ্য দিয়ে তিনি নানা বিষয়ে নির্মম সত্য উচ্চারণ করতেন। তিনি কখনো হতাশ হননি। হয়তো নশ্বর পৃথিবীর কাছে তাঁর তেমন আশাই ছিল না।
মনে আছে, কবি মাহমুদ আল জামানের অনুরোধে সংবাদ সাময়িকীতে তিনি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে একটি আশ্চর্য সুন্দর নিবন্ধ লিখেছিলেন। পড়ে মনে হয়েছিল তিনি কবিকে যতটা নিবিড় ও গভীরভাবে দেখেছেন, জীবনানন্দ গবেষকেরাও তা পারেননি। বেশির ভাগ গবেষক জীবনানন্দের কবিতার দাঁড়ি-কমা সেমিকোলন, উপমা-অনুপ্রাস নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। মকবুলার রহমান সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তাঁকে দেখেছেন, পরিবেশ প্রতিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, জীবনানন্দ বরিশালে না জন্মালে হয়তো এ রকম কবিতা লিখতে পারতেন না।
আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মানুষ জীবনকে দেখে নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্য, পদপদবি ও ক্ষমতার মাপকাঠিতে। কিন্তু মকবলার রহমান ছিলেন ব্যতিক্রম। দেশ, সমাজ ও সম্প্রদায় নিয়েও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সব ধরনের পক্ষপাতমুক্ত। তিনি প্রচুর পড়াশোনা করলেও লিখেছেন কম। একাডেমিক বিষয়ের বাইরে আরও কম। তিনি দ্য অ্যাটম বইয়ের অনুবাদ করেছেন। সবার মাঝে ও সবার সঙ্গে থেকেও অনেকটা আলাদা ছিলেন তিনি।
আমাদের এই অস্থির সমাজে মকবুলার ভাই ছিলেন স্থির, অচঞ্চল। কোনো যশ, খ্যাতি কিংবা পদের মোহ তাঁর ছিল না। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের দুঃখ-কষ্ট–গ্লানি কিছুই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। অফিসে কিংবা বাড়িতে মৃদু হাসিতে তিনি সবাইকে অভ্যর্থনা জানাতেন। প্রচুর বই পড়তেন। পড়া শেষ হলে অনেক বই অনুরাগীদের দিয়ে দিতেন।
মকবুলার রহমান জীবনকে ভোগ করেননি, উপভোগ করেছেন। তিনি কিছু হতে চাননি। এই যে দেশে কত রাজনৈতিক উত্থান-পতন আলোড়ন বিলোড়ন—সব তুচ্ছ বলে পাশ কাটিয়ে গেছেন। তিনি কারও সঙ্গে না থেকেও সবার সঙ্গে ছিলেন। তিনি কখনো মন খারাপ করেছেন, মনে পড়ে না। তিনি নিজে স্বপ্নের পেছনে ঘোরেননি। বরং অনেককেই স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করেছেন।
মকবুলার ভাইয়ের আরও বহু দিন বেঁচে থাকার প্রয়োজন ছিল। সেটি তাঁর জন্য যতটা না আমাদের জন্য তার চেয়ে বেশি। মেনে নেওয়া কঠিন যে, তাঁর সঙ্গে আর দেখা হবে না। মকবুলার ভাই, এ কেমন চলে যাওয়া?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.