মিয়ানমারে ফৌজি শাসনের ৫৪ বছর

প্রায় ৫৪টি বছর গণতন্ত্রহীনতায় কেটেছে মিয়ানমারের। ১৯৬২ সালের ২রা মার্চ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা যায় সেনাবাহিনীর হাতে। তারপর থেকে ২০১৫ সাল। এই দীর্ঘ সময় দেশটির ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সেনাবাহিনী না হয় তারা পশ্চাতে থেকে মদত যুগিয়েছে। অন্যদিকে গণতন্ত্রের ডাক দেয়া বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সান সু চিকে তারা নিক্ষেপ করেছে কারাগারে। দীর্ঘ ১৫টি বছর তাকে গৃহবন্দি হয়ে কাটাতে হয়েছে। এর মাঝে ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে গণতন্ত্র মুক্তি পাওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। মিয়ানমারের নাগরিকরা গণতন্ত্রের পক্ষে তাদের রায় দিয়ে দিয়েছিলেন। অং সান সু চির দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল সেই নির্বাচনে। কিন্তু জনগণকে বোকা বানিয়ে সেই নির্বাচনকে বাতিল করে সেনাবাহিনী। উল্টো তারা জেঁকে বসে ক্ষমতায়। নাফ, ইরাবতী নদীতে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে রয়ে গেছে গণতন্ত্রের জন্য দেশবাসীর ত্যাগের নজির। জেনারেল নি উইনের নেতৃত্বে ১৯৬২ সালের ২রা নভেম্বর এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় গিয়েই চালু করে কর্তৃত্ববাদী শাসন। সেই থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারকে শাসন করে জেনারেলদের নের্তৃত্বে রেভুলুশনারি কাউন্সিল দিয়ে। বার্মিজ ওয়ে টু সোসিয়ালিজমের অধীনে প্রায় সব ব্যবসা, মিডিয়া, কলকারখানা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। ১৯৭৪ সালে সোসিয়ালিস্ট রিপাবলিক অব দ্য ইউনিয়ন অব বার্মা’র নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয় মিয়ানমার। তখন জেনারেল ও অন্য সামরিক কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেন। ফলে মিয়ানমার শাসন করে বার্মা সোশালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টি। এ সময়কালে মিয়ানমার বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশে পরিণত হয়। জেনারেল নি উইনের শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগই হয়েছিল সহিংস। বিক্ষুব্ধদের সব সময়ই সহিংসতার মাধ্যমে দমন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৬২ সালের ৭ই জুলাইয়ের কথা কেউ ভোলেন নি। ওই দিন রেঙ্গুন ইউনিভার্সিটিতে প্রতিবাদ বিক্ষোভে হামলা করে সরকার। এতে কমপক্ষে ১৫ জন ছাত্র নিহত হন। সরকারবিরোধী একটি বিক্ষোভ সেনাবাহিনী সহিংস উপায়ে দমন করে ১৯৭৪ সালে। একই ঘটনা ঘটে ১৯৭৫, ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে। ১৯৮৮ সালে সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক দমনপীড়নের প্রতিবাদে এবং গণতন্ত্রের দাবিতে সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলন ৮৮৮৮ আপরাইজিং নামে পরিচিত। তখন নিরাপত্তা রক্ষীরা কয়েক হাজার বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে। জেনারেল শ মুয়াং সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। ঘোষণা করেন স্টেট ল অ্যান্ড অর্ডার রিস্টোরেশন কাউন্সিল (এসএলওআরসি)। ১৯৮৯ সালে দেখা দেয় আবার ব্যাপক বিক্ষোভ। তখন এসএলওআরসি ঘোষণা করে সামরিক আইন। অবশেষে ১৯৮৯ সালের ৩১শে মে সেনা সরকার পিপলস এসেম্বলি নির্বাচনের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এ বছরই দেশের ইংরেজি নাম পাল্টে ফেলে এসএলওআরসি। এর আগে মিয়ানমারের ইংরেজি নাম ছিল সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব দ্য ইউনিয়ন অব বার্মা। তা পরিবর্তন করে করা হয় ‘ইউনিয়ন অব মিয়ানমার’। প্রায় ৩০ বছর পরে দেশে গণতন্ত্রের সূর্য উদয়ের একটি সম্ভাবনা দেখা দেয় ১৯৯০ সালে। এ বছরের মে মাসে সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেয়। তাতে তখনকার পার্লামেন্টের ৪৯২টি আসনের মধ্যে ৩৯২টি আসনে জয় পায় অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। কিন্তু সামরিক জান্তা ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানায়। একই সঙ্গে এসএলওআরসি-এর মাধ্যমে তারা দেশ শাসন অব্যাহত রাখে। এ অবস্থা চলতে থাকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। এরপর সেনাবাহিনী গঠন করে স্টেট পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল (এসপিডিসি)। অবশেষে ২০১১ সালের মার্চে তাও বিলুপ্ত হয়। এর মধ্যে ঘটে যায় অনেক ঘটনা। ১৯৯৭ সালের ২৩শে জুন মিয়ানমারকে এসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান)-এ অঙ্গীভূত করা হয়। ২০০৬ সালের ২৭শে মার্চ সামরিক জান্তা ইয়াঙ্গুন থেকে রাজধানী সরিয়ে নেয় ন্যাপিড’তে। ন্যাপিড শব্দের অর্থ হলো ‘রাজাদের শহর’। ২০০৭ সালে ডিজেল ও পেট্রলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা স্যাফ্রোন রেভ্যুলুশন করেন। তবে তাদের আন্দোলনেরও কড়া জবাব দেয় সরকার। ২০০৭ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর তাদের ওপর দমনপীড়ন চালায় সরকার। এ অভিযান ছিল রুক্ষ্ম, কড়া। এ সময় অনেক ভিক্ষুকে হত্যা করা হয়। নিরস্ত্রদের ওপর সরকারের এমন আচরণে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে নিন্দা জানানো হয়। তারই সূত্র ধরে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে দেয়া হয় অর্থনৈতিক অবরোধ। ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের আঘাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিশেষ করে ইরাবতী বিভাগে অববাহিকা এলাকায় ধানের মারাত্মক ক্ষতি হয়। মারা যান প্রায় দুই লাখ নাগরিক। ক্ষতি হয় এক হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। ১০ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে যান। এটি মিয়ানমারের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় জাতিসংঘ। কিন্তু মিয়ানমার সরকার তাদের কাছে তথ্য গোপন করায় সে কাজ অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে সহায়তার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা উপস্থিতির কারণে জাতিসংঘের সামরিক বিমানের প্রবেশ বিঘ্নিত হয়। বিঘ্নিত হয় ওষুধ, খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য সরবরাহ। ২০০৯ সালে কোকাং নামে একটি সংঘাত দেখা দেয় উত্তর মিয়ানমারের শান রাজ্যে। কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে হ্যান চাইনিজসহ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় সেনাবাহিনী। এই সংঘাতের প্রথম দিনগুলোতে ৮ থেকে ১২ই আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার সাধারণ নাগরিক পালিয়ে আশ্রয় নেন প্রতিবেশী দেশ চীনের ইউনান প্রদেশে।
মিয়ানমারে গণতন্ত্রের বাতাস একটু একটু করে প্রবেশ করতে শুরু করে ২০০৮ সালে। তখন সংবিধান নিয়ে গণভোটে হয় ১০ই মে। ওই গণভোটের রায় অনুযায়ী দেশের নাম ‘ইউনিয়ন অব মিয়ানমার’ থেকে পাল্টে করা হয় রিপাবলিক অব দ্য ইউনিয়ন অব মিয়ানমার’। নতুন সংবিধানের অধীনে ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। ওই নির্বাচনে সু চির দল অংশ নিলেও তারা তেমন সফলতা দেখাতে পারে নি। পর্যবেক্ষকরা এ নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে কোন কোন ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ ছিল। জাতিসংঘ ও পশ্চিমা কিছু দেশ নির্বাচনকে জালিয়াতির নির্বাচন আখ্যা দিয়ে নিন্দা জানায়। এ নির্বাচনে সেনা সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বলা হয় তারা শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পেয়েছে। কিন্তু তাদের এ দাবির বিরোধিতা করে বেশির ভাগ গণতন্ত্রপন্থি বিরোধী দল। ২০১১ সালের ৩০শে মে সামরিক জান্তা আস্তে আস্তে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যায়। গণতন্ত্র বিকশিত হতে থাকে। এতে সুচির নেতৃত্ব সবচেয়ে বেশি। তিনি নিজেকে কারাগারে এক নাগারে বছরের পর বছর ধরে রেখে, ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে অন্যরকম এক লড়াই চালিয়েছেন সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে। অবশেষে জয়টা তারই।

No comments

Powered by Blogger.