আদালতের বিশেষ অধিবেশন চালু হোক by মিজানুর রহমান খান

বিচার বিভাগ পৃথক্করণের অষ্টম বছরে এর অগ্রগতি বুঝব দুটি উপায়ে। প্রায় ৯০০ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট চালাতেন সরকারি কর্মকর্তারা, তার অবসান ঘটল ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর। কিন্তু পৃথক্করণের সময় তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রায় আড়াই শ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও তার সহায়ক লোকবল কমিয়ে দিয়েছিল। এর প্রতিকার আজও হয়নি। পৃথক্করণ-পূর্ববর্তী ১ হাজার ৬৫৫টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে কেবল শূন্য পদ পূরণে এ পর্যন্ত ৯৩০ জন নতুন বিচারক নিয়োগ দিতে সুপারিশ করতে দেখেছি। গত আট বছরে একটি নতুন পদও সৃষ্টি হয়নি। গত আট বছরে প্রত্যেক বিচারকের মাথায় চার গুণ বেশি মামলার বোঝা চেপেছে। বর্তমানে একজন বিচারকের মাথায় মামলার সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। ২০০৭ সালে জনপ্রশাসন স্বীকার করেছিল, এই অনুপাত হওয়া উচিত ১: ৮৭৮।
মাসদার হোসেন মামলার মাধ্যমে অধস্তন আদালতে যে দ্বৈত শাসন বা ‘ডায়ারকি’–ব্যবস্থা মেনে নেওয়া হয়েছে, তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে গুরুতরভাবে আঘাত করেছে। দ্বৈত শাসন হলো যেকোনো বিচারককে যেকোনো সময় বদলি করে দিতে কিংবা যে কারও কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা বিধানে মূল প্রস্তাব সরকার কর্তৃক একচেটিয়াভাবে প্রদানের এখতিয়ার ও অধিকার সংরক্ষণ করা। তাই একে আমরা বলতে পারি সরকারি শাসন। আর সেই প্রস্তাবের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট যে মতামত দেবেন, সেটা ‘প্রাধান্য’ পাবে, সেটা হলো আদালতের শাসন। এ দুই মিলে দ্বৈত শাসন।
লর্ড ক্লাইভের চালু করা দ্বৈত শাসনে ‘ক্ষমতা’ থেকে ‘দায়িত্বশীলতা’ পৃথক করা হয়েছিল। ‘প্রকৃত ক্ষমতা’ ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। আর প্রশাসন পরিচালনার দায়দায়িত্ব বাংলার নওয়াবদের ওপর চাপানো হয়েছিল। দ্বৈত শাসন এ জন্য নিন্দিত ছিল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ১১৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের বিচার প্রশাসনের ‘প্রকৃত ÿক্ষমতা’ আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে রেখে দিতে একমত। এই দ্বৈত শাসনব্যবস্থাটাই প্রতিনিয়ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি একটি পদ্ধতিগত হুমকি সৃষ্টি করে রেখেছে। কাকে, কখন, কোথায় বদলি করতে হবে—সেই প্রাথমিক অনুভব বা প্রয়োজনীয়তা যাচাই করা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। তাই প্রস্তাব দেওয়াটাও মৌলিক কাঠামো থেকে অবিভাজ্য। ভারতের নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনীর মাধ্যমে আদালতের এই এখতিয়ার হরণ করেছিল। সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ওই সংশোধনী বাতিলের অন্যতম কারণ এটি।
পর্বতসম মামলার চাপে ন্যুব্জ থাকা বিচারকদের বিচারকার্যের পরিমাণ ও মান দুটোর ওপরই বিরূপ প্রভাব ফেলে। তদুপরি রূঢ় বাস্তবতা হলো, ৫৪ জেলার ৩৪২ জন বিচারক ১৬৪টি এজলাস ও খাসকামরা পালাক্রমে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। ৬৪ জেলায় মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালত ভবন নির্মাণকাজ শুরুর গত পাঁচ বছরে এ পর্যন্ত মাত্র ছয়টি জেলায় ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ৫৮টির মধ্যে অর্ধেক ধীরগতিতে চলছে এবং বাকি অর্ধেক জেলায় জমি অধিগ্রহণের কাজই বাকি পড়ে আছে। এ জন্যই বিচার বিভাগের জন্য বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন জরুরি।
ভূমি সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ চিরদুঃখী। অথচ দেশে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালকে পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর না করার এক যুগ পূর্তি চলছে। আদালত গঠন করা হবে, কিন্তু তাতে বিচারক ও সহায়ক লোকবল সরকার থেকে দেওয়া হবে না। এ ধরনের বিষয়কে যদি আমরা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে আঘাতের সঙ্গে তুলনা না করতে চাই, তাহলে কি তা উট পাখির মাথা গুঁজে থাকার সঙ্গেই তুলনীয় হতে পারে না?
বিচারের সেবার মান-সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণের জন্য আদালত অঙ্গনে বক্স স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি জেলা জজদের প্রতি মাসে সম্মেলন করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। এসব পদক্ষেপ অত্যন্ত সময়োপযোগী, আমরা অনেকে বহুকাল ধরে এমনটাই আশা করেছিলাম জমির দলিলের সবশেষ হালনাগাদ করা রেকর্ড চূড়ান্তভাবে প্রকাশের ঘটনা থেকে উদ্ভূত মোকদ্দমা দ্রুত নিষ্পত্তি করা ওই ট্রাইব্যুনালের কাজ। অথচ গত ১১ বছরেও সেই আদালত কীভাবে চলবে, সে-সংক্রান্ত বিধি তৈরি করা হয়নি। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন যে ভূমি জরিপ–সংক্রান্ত মামলা মুলতবি হওয়ার একটি তারিখ থেকে পরবর্তী তারিখের মধ্যে ব্যবধান ছয় মাস থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। কারণ, সারা দেশের জন্য বিচারকের পদ সৃজন ছাড়াই ৪২টি ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল তৈরি করা হয়েছিল। প্রায় ৫০ ভাগ যুগ্ম জেলা জজের পদ শূন্য থাকায় ৪২টি ট্রাইব্যুনালের ৩০টিই অকার্যকর রয়েছে। আর আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনই করা হয়নি। অথচ ১ লাখ ৮০ হাজার ৪১টি মামলা এখানে বিচারাধীন আছে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জসহ মাত্র ১৩টি জেলায় সোয়া লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন আছে।
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে মোকদ্দমা নিষ্পত্তি নিয়ে সরকারের অঙ্গীকার সুবিদিত। অথচ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ অত্যন্ত দুঃখিত ও মর্মাহত। ৬১টি জেলায় মোট ১ লাখ ১৯ হাজার ৪২৯টি মামলা বিচারাধীন থাকলেও এটা অভাবনীয় যে অর্পিত সম্পত্তি আইনের আওতায় কোনো বিচারকের পদ সৃজন করাই হয়নি। অন্য বিচারক যাঁদের সাধারণ দায়িত্বই বহুগুণে ‘অতিরিক্ত’, তাঁদের ওপর এ ধরনের ‘অতিরিক্ত’ বিচারকার্য চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার অর্পিত সম্পত্তি-সংক্রান্ত যেসব মোকদ্দমা যতটুকু নিষ্পত্তি হয়েছে, তা কোথায় আপিল হবে, সেই প্রশ্নের মীমাংসা এখনো হয়নি। আইন সংশোধনটাই বাকি।
যে দেশে ৩১ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন এবং যে দেশে একটি বছরে ছয় লাখ নতুন মামলা দায়ের হয়, সে দেশে একজন বিচারক নিয়োগ প্রদানে তিন থেকে চার বছর সময় লাগছে। বিচারক পেতে আদালত সরকারের মুখাপেক্ষী, আবার চাহিদাপত্র প্রেরণে সরকারের অদূরদর্শিতা পীড়াদায়ক। যেমন ২০১৪ সালের মে মাসে আইন মন্ত্রণালয় মাত্র ২৪ জন বিচারকের নিয়োগ প্রদানে চাহিদাপত্র পাঠানোর সাড়ে ১৪ মাস পরে তারা সম্প্রতি আরও ৩৮৩ জন বিচারক নিয়োগের জন্য চাহিদাপত্র পাঠিয়েছে। এর ফলে অনুমোদিত পদ ও বাজেট থাকলেও অব্যবস্থাপনার জন্য বহু রকম অদ্ভুত অবস্থা বিরাজমান। কুষ্টিয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ৩২৮টি মামলা বিচারাধীন, সেখানে পূর্ণকালীন বিচারক রয়েছেন। আবার ভোলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ২ হাজার ৫১৯টি মামলা বিচারাধীন; অথচ এখানে খণ্ডকালীন জজ দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। এভাবে বিচার প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা ও দুর্বলতা বিচারপ্রার্থীদের মানবাধিকারের সুরক্ষা দিতে পারছে না।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০১৬-২০) চূড়ান্ত খসড়া বিচার ব্যবস্থাপনার ‘অবনতিশীল’ চিত্র আঁকতে গিয়ে বলেছে, গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে উচ্চ ও নিম্ন আদালতে মামলার মোট ব্যাকলগ প্রায় ১৮ লাখ থেকে ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বছরে আড়াই লাখ মামলা বেড়েছে। সুতরাং ২০১৯ সালে ৩৩ লােখ ব্যাকলগ সীমিত রাখতে তাদের ধারণা টিকবে না। গত ৩০ জুনেই ৩১ লাখ অতিক্রম করেছে। তারা ন্যায়পাল করবে বলেছে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছ ও নির্দিষ্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া নির্ধারণ করবে। আদালতের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া গতিশীল ও ডিজিটালাইজেশন করবে। প্রতিটি জেলায় ব্যক্তির চেয়ে পদ্ধতির উন্নয়নের দিকে খেয়াল রেখে ‘কেস ম্যানেজমেন্ট ও কো-অর্ডিনেশন কমিটি’ গঠন করবে। এসব তাহলে দ্রুত বাস্তবায়ন করুন।
২০১০ থেকে ২০১৪ সাল—এই পাঁচ বছরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে প্রায় তিন লাখ এবং অধস্তন আদালতে প্রায় পৌনে ৬৫ লাখ নতুন মামলা দায়ের হয়েছে। এই সময়ে সুপ্রিম কোর্টে ২ লাখ ৬৬ হাজার এবং অধস্তন আদালতে ৫২ লাখ ৬৪ হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে দেখা যায়, মামলা দায়েরের চেয়ে নিষ্পত্তির হার বেশ কম।
এর ফলে গড়ে প্রতিবছর ২ লাখ ৬০ হাজার মামলার ব্যাকলগ সৃষ্টি হচ্ছে। বিচার ব্যবস্থাপনায় বড় কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব না হলে এবং গত পাঁচ বছরের প্রবণতা বিবেচনায় নিয়ে ধারণা করা চলে যে ২০১৯ সালে উচ্চ ও নিম্ন আদালতে সব ধরনের মামলার ব্যাকলগ বা জট ৪৪ লাখে পৌঁছাবে। গত পাঁচ বছরের গড় হিসাবে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি বছরে ৫২২টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। একই সময়ের গড় হিসাবে নিম্ন আদালতের একজন বিচারক বছরে ৮৫৮টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে এখন বিচারপতি ১০২ জন। অধস্তন আদালতে বিচারক পদে কর্মরতদের সংখ্যা ১ হাজার ২২৭। প্রজাতন্ত্রের মোট সক্রিয় বিচারক ১ হাজার ৩২৪ জন। মোট ব্যাকলগ ৩১ লাখ। সার্বিক বিচারে বিচারকদের মাথাপিছু ব্যাকলগ ২ হাজার ৩৩২।
দ্বৈত শাসন বিলোপ, মোবাইল কোর্টে কর্মরতদের চাকরি প্রেষণে সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত করা, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ গঠন এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে দ্রুত সান্ধ্যকালীন বা বিশেষ অধিবেশন চালু করা দরকার। বিচারের সেবার মান-সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণের জন্য আদালত অঙ্গনে বক্স স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি জেলা জজদের প্রতি মাসে সম্মেলন করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। এসব পদক্ষেপ অত্যন্ত সময়োপযোগী, আমরা অনেকে বহুকাল ধরে এমনটাই আশা করেছিলাম। এসব উদ্যোগের সাফল্য কামনা করি।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.