এ দেশে এখন কে নিরাপদ? by আনিসুল হক

এ দেশে এখন কে নিরাপদ? নিরাপত্তা মানে নিরাপত্তার বোধ, মনের ভেতরে এই প্রত্যয় থাকতে হবে যে আমি নিরাপদ, তা এখন আছে কার মনে? কার চিত্ত এখন ভয়শূন্য? কে ভাবছেন যে তাঁর কিছু হবে না! মরতে তো হবেই, আজ হোক আর কাল হোক, মরলে মরব—এই ভাবে ভাবা সাহসের লক্ষণ, সান্ত্বনার পরিচয়—কিন্তু এটাকে নিরাপত্তার বোধ বলে না।
এই দেশে এখন অনেকেই নিজেকে নিরাপদ ভাবেন না। নিজের শয়নকক্ষেও নয়। কারণ, নিরাপত্তারক্ষীরা কিংবা প্রশাসন কারও বেডরুম পাহারা দিতে পারবে না। পথে নয়, সড়কে নয়, এই দেশে বছরে হাজার আঠারো মানুষ মারা যায় শুধু সড়ক দুর্ঘটনায়, লঞ্চ আর নৌকাডুবিতে লোক মরে, বাসে-ট্রেনে পেট্রলবোমা নিক্ষিপ্ত হয়। এই দেশে প্রকাশ্য জনবহুল এলাকায় মানুষ খুন হয়, বইমেলার প্রবেশপথে জনাকীর্ণ রাস্তায়। দিনের বেলা চারতলা ভবনের অফিস কক্ষ যখন জমজমাট, সেখানে ঢুকে পড়ে আততায়ীরা, গুলি হয়, চিৎকার-চেঁচামেচি ও আর্তনাদও নিশ্চয়ই হয়, তারপর মোটরসাইকেলে চড়ে চলে যায় ঘাতকেরা। ভিড়াক্রান্ত মার্কেটের অফিস কক্ষে ঘটে হত্যাকাণ্ড। ফ্ল্যাটভবনের ভেতরে হত্যাকাণ্ড ঘটে, নারী খুন হয়, পুরুষ খুন হয়, লেখক মরেন, প্রকাশক মরেন, স্কুলের ছাত্রী মরে, গৃহবধূ মরেন। কেউ বাড়ি থেকে বেরোনোর পর মারা যান, কেউ বাড়ি ফিরতে গিয়ে মারা পড়েন। কেউ নিজের অফিস কক্ষে মারা যান, কেউ-বা মারা যান রেললাইনের ধারে। পীর মারা যান, মাজারের খাদেম মারা যান। আক্রান্ত হন যাজক, আক্রান্ত হন পথচারী। চেকপোস্টে পুলিশ সদস্য মারা যান ছুরিকাঘাতে। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মারা যান ব্যাংকের ভেতরে,
সঙ্গে মারা যান নিরীহ গ্রাহক। ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মারা যান সচিবালয়ের কর্মকর্তা। গুম হয়ে যান মানুষ—ক্রসফায়ারে মারা যান, এনকাউন্টারে মারা যান। নদীতে লাশ ভাসে। খুন হয় মেধাবী কিশোর ত্বকী। মারা যান বিদেশিরা, শুধু একজন-দুজন বিদেশিকে মরতে হবে—এই দৈবচয়ন পদ্ধতির শিকার হয়ে!
মানুষ সারা পৃথিবীতে মারা যায়, খুন হয়, অপঘাতে মরে, সন্ত্রাসী হামলাতেও মরে। গত এক বছরে পৃথিবীতে মাথায় নারকেল পড়ে মারা গেছে ১৫০ জন, আমেরিকায় বিছানা থেকে পড়ে মারা যায় প্রতিবছর ৪৫০ জন। কিন্তু সেটা মানুষকে আতঙ্কিত করে না। চিত্তের স্বাধীনতাই হলো আসল স্বাধীনতা। আজ এই বাংলাদেশে কে আছেন, যিনি ভাবছেন যে তিনি নিরাপদ? যিনি ভাবছেন যে আমার বা আমার স্বজনদের কোনো বিপদ নেই। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, গোপন অতর্কিত হামলা থেকে কেউ নিরাপদ নয়, আমিও নই। মন্ত্রী যদি নিরাপদ বোধ না করেন, তাহলে কে নিরাপদ বোধ করবে? কিন্তু বাস্তবতা হলো, মন্ত্রীরাও কেউ নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। সরকারি দলের নেতা-কর্মীরাও আতঙ্কে ভোগেন। তার একটা প্রমাণ হলো, জনসভাতেও তাঁরা নিয়ে আসেন অস্ত্র, এবং নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে মাঝেমধ্যে ধরাও পড়েন।
বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা নিরাপদ নন, তাঁরা আছেন দৌড়ের ওপরে; সরকারি দলের কর্মীরা তাঁদের তাড়া করেন, পুলিশ তাঁদের পিছু নেয়। এই দেশে যিনি সংস্কৃতিচর্চা করেন, তিনি ভাবেন, তাঁর অবস্থা নাজুক, যিনি ধর্মচর্চা করেন, তিনিও ভাবেন তিনি সহজেই আক্রমণযোগ্য। এই দেশে পিতামাতা ভাবেন, আমার সন্তানের কিছু হবে না তো! সন্তানেরা ভাবে, বাবা কিংবা মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে আসতে পারবেন তো! এই দেশে সংখ্যালঘুরা ভাবে, দেশটা তাদের জন্য নিরাপদ নয়, আর এটা বাসযোগ্য রইল না। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, প্রত্যেকেই আজ সংখ্যালঘুর মনস্তত্ত্বে ভুগছে।
খেলোয়াড় ভাবেন, আমি আক্রমণযোগ্য; শিল্পী ভাবেন, আমি অসহায় গোষ্ঠীর; সম্পদশালী ভাবেন, আমার সম্পদই আমার প্রধান সমস্যা; বিত্তহীন ভাবেন, এই দেশে বিত্তহীনের পক্ষেÿ তো কিছুই নয়, কেউই নেই; ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ভাবে, নিরাপত্তা নেই, নিরাপত্তা নেই তার জীবনের, পরিবার-পরিজনের, সহায়-সম্পত্তির। নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা ভাবে, এই দেশে আমার উপযুক্ত মর্যাদা আর স্থান কই, জমিজিরেতের ওপরেই-বা আমার আইনগত অধিকার কই। বিএনপি সমর্থক ভাবে, এই সময়টা আমার জন্য অনুকূল নয়। আওয়ামী লীগ সমর্থক ভাবে, যেকোনো সময় আক্রমণের শিকার হতে পারি, পরিস্থিতি তো ভালো নয়! পুলিশ ভাবে, যেকোনো সময় আক্রমণ হতে পারে আমার ওপরে। অবস্থা এমন যে সহকর্মীর ওপরে আক্রমণ হতে দেখে নিজের জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছেন তিনজন পুলিশ সদস্য।
চোর ভাবে, আমাকে নেওয়া হতে পারে ক্রসফায়ারে কিংবা বানানো হতে পারে জজ মিয়া। লেখক ভাবেন, আমি বাংলা ভাষায় লিখি, এইটাই তো কারও কারও চোখে হতে পারে সবচেয়ে বড় অপরাধ। শিল্পী ভাবেন, আমি গান করি, নাটক করি, সেইটাই বা ওরা সহ্য করবে কেন? পরহেজগার ভাবেন, আমাকে কি ওরা সন্দেহের চোখে দেখছে না। নারী, যেকোনো বয়সের—পথে নেমে বারবার ঘাড় ঘুরে তাকান, কোথাও থেকে কোনো আক্রমণ আসছে না তো! শিশুরা এই দেশে আক্রমণের শিকার হচ্ছে—নিষ্ঠুর সব নির্যাতনের। ফলে এই দেশে কোনো মতের, কোনো দলের, কোনো পেশার, কোনো শ্রেণির মানুষ কি পাওয়া যাবে, যিনি ভাবছেন যে তিনি নিরাপদ?
এই দেশে এমন কোনো স্থান কি আছে, যেখানে আপনি ভাবতে পারেন, এখানে কিছুই হবে না আপনার? ভবন ভেঙে যেতে পারে, ফুটপাতে গাড়ি উঠে পড়তে পারে—তারও চেয়ে বড় কথা, আততায়ীরা হামলা করতে পারে যেকোনো খানে, পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, ঘরে-বাইরে, অফিসে-উঠানে। আপনি এ পক্ষের মার খেতে পারেন, ও ও পক্ষের মার খেতে পারেন; আপনি হরতালকারীদের আক্রমণের শিকার হতে পারেন, হরতালবিরোধীদের ছুরিকাঘাতে মারা যেতে পারেন। আপনি গুম হয়ে যেতে পারেন, গুমের ঘটনা দুর্ভাগ্যক্রমে দেখে ফেলার অপরাধেও মরতে পারেন। আপনি টার্গেটেড হয়ে মারা পড়তে পারেন, আর হয়তো একজনকে টার্গেট করতে গিয়ে ভুলে আততায়ীরা মেরে ফেলতে পারে আপনাকেও। অতীতে আমরা দেখেছি, নামের মিলের কারণে ক্রসফায়ারে মারা গেছে ভুল মানুষ, এমনকি পরনের কাপড়ের রং মিলে যাওয়ায় হাঁটুতে গুলি খেয়েছে ভুল যুবক।
আগেই বলেছি, অপঘাতে সারা পৃথিবীতে মানুষ মারা যায়। বড় বড় সন্ত্রাসী হামলা বাইরের দেশগুলোতে অনেক হয়, আমেরিকা-ইউরোপে বদ্ধ উন্মাদেরা বন্দুক নিয়ে ঢুকে পড়ে বাচ্চাদের ইশকুলে, এটা ফি বছরই ঘটে থাকে। কিন্তু অসহায়তার অনুভূতি নিরাপত্তাহীনতার বোধ সব শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণ, সংস্কৃতি-আচারের মানুষের মধ্যে এত প্রবলভাবে আর কখনো বাংলাদেশে চেপে বসেছে কি না সন্দেহ। মার্কনি রেডিও আবিষ্কার করার পর বিজ্ঞানীরা কিছুদিন বলতেন, পৃথিবীটা পূর্ণ ইথার নামের একটা জিনিসে, পরে অবশ্য ওই তত্ত্ব ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এখন বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস পূর্ণ হয়ে আছে ভয় নামের একটা পদার্থে, যে ভয় কাল্পনিক নয়, বাস্তব; যে ভয় অমূলক নয়, যার মূল দেশের রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বাস্তবতার মধ্যে প্রোথিত।
ভয় থেকে বাঁচার জন্য মানুষ তাই পালাতে চাইছে। দেশ ছাড়ার কথা ভাবছে। আচ্ছা, আমি নাহয় মরলাম, আমার সন্তানেরা যেন নিরাপদ থাকে—তাই বাইরে কোথাও একটা...এমন কথা শোনা যায় আজ অনেকেরই মুখ থেকে। ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি, আমার এই মাটিতে জন্ম যেন এই মাটিতে মরি—এ কথা জোর গলায় বলার লোক এখন কমে যাচ্ছে। যাঁরা বলছেন, তাঁদের উপায় নেই বলে বলছেন, নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলছেন।
একটা সময় এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে! একটা দেশের পরিস্থিতিকে কখন আমরা বলব এর চেয়েও হতাশাব্যঞ্জক। মানুষের মন থেকে ভয় দূর করতে হবে, দিতে হবে সাহস। দিতে হবে আশ্বাস। শুধু কথায় চিড়া ভেজে না, কিন্তু মুশকিল হলো, সাহস আর সান্ত্বনার বাণী যাঁরা শোনাতে পারতেন, তাঁরা নিজেরাই বলে চলেছেন ভয়াবহ সব উক্তি, বেফাঁস সব কথা! তাঁদের কথা শুনে মানুষ আশ্বাস পাচ্ছে না, পাচ্ছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা।
অপরাধীদের ধরতে হবে, বিচার করতে হবে, তা করতে হবে দ্রুততার সঙ্গে আর তা হতে হবে, দৃষ্টান্তমূলক—এটা তো একেবারেই প্রথম কাজ, প্রথম ও অপরিহার্য কর্তব্য। ফয়সলের বাবা যতই বলুন না কেন, তিনি বিচার চান না, আসলে বিচার করতেই হবে, করতে পারতেই হবে। সে জন্য দরকার হবে প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা, প্রশিক্ষণ, রসদ, যন্ত্র, জনবল, অর্থ এবং স্ট্র্যাটেজি। দরকার হবে দূরদৃষ্টি, পরিকল্পনা ও জোরদার নির্দেশনা। কিন্তু অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের পরের কথাটাও গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্ন মতের, ভিন্ন পথের, ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন বিশ্বাসের, ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন বর্ণের মানুষের শান্তিপূর্ণ, আস্থাপূর্ণ, মর্যাদাপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারতে হবে। সেটা করতে হলে দরকার হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। দরকার হবে গণতান্ত্রিক পরিসর। বিরোধীদের বিরোধিতা প্রকাশের অবাধ পরিবেশ। কারও মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হলে তার প্রকাশের জানালা। মিছিল-সভা-সমাবেশ করবার আইনানুগ অধিকার। বিরোধী মত প্রকাশের মাধ্যমগুলোর অনাক্রান্ত অবস্থান। এবং শিক্ষা। শিক্ষা মানে সুশিক্ষা। এবং সংস্কৃতি। আর সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে বাঁচা, বিচিত্রভাবে বাঁচা।
এই দেশে আমরা একদা গান গাইতাম—ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ। এখন আমাদের মনে গান নেই, তার বদলে আছে শঙ্কা, ভায়ের মায়ের মনে এত ভয়, আর কোথাও পাবার নয়। এটা কোনো সুস্থ সমাজের লক্ষণ নয়, এটা কোনো সুন্দর শাসনের প্রতিচ্ছবি নয়, এখন একটা কথাই বলা যায়, এখন দুঃসময়। ১৯৭১ সালে আমাদের মনে ভয় ছিল, কিন্তু আশাও ছিল। কারণ আমরা জানতাম, আমরা মারা যেতে পারি, কিন্তু তার বিনিময়ে পাব স্বাধীনতা! এখন মানুষের মনে ভয়, যে কেউ যেকোনো সময় মারা যেতে পারেন, কিন্তু তার বিনিময়ে তিনি পাবেন একরাশ বর্জ্য-বচন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.