কী ঘটেছিল সেই রাতে

রাত পৌনে ২টা। তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি চলছে। হোসনি দালানের ইমামবাড়ার ভেতরের কবরস্থানের পশ্চিমদিকে ফুল ও লাল রং দিয়ে সাজানো রয়েছে একটি ঘোড়া। ওই ঘোড়াকে সবাই ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করছিল। শোক মিছিলে যোগ দেয়ার জন্য ইমামবাড়ার ভেতর তখন লোকে লোকারণ্য। হঠাৎ বিকট শব্দ। পরপর তিনটি। মুহূর্তেই শুরু হয়ে যায় কান্নার রোল। কবরস্থানের পাশে তখন অনেকেই মাটিতে পড়ে আছেন। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। কারও হাত, কারও পা, কারও বা শরীর দিয়ে ঝরছে রক্ত। কান্না আর আহাজারি চলছে সমানতালে। শোক মিছিলের জন্য জড়ো হওয়া নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু সবাই ছুটছে নিরাপদ দূরত্বে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সবাই যেন সম্বিৎ ফিরে পায়। এরপর শুরু হয় আহতদের উদ্ধারের চেষ্টা। ইমামবাড়ার গেটের সামনে মোতায়েন থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ছুটে আসেন। আহতদের যে যেভাবে পারেন উদ্ধার করে নিয়ে যান হাসপাতালে। শিয়া মুসলিমদের জন্য বিভীষিকাময় একটি রাত। যদিও বোমা বিস্ফোরণে আহতদের অধিকাংশই সুন্নি মুসলিম। পুলিশ জানিয়েছে, বোমা হামলায় আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়েছিল ৫৭ জনকে। আর মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ৩৯ জনকে। আহতদের অনেকেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। ঢাকা মেডিক্যালে এখনও ভর্তি আছেন ১৬ জন। তারা হলেন রিনা খাতুন (৩৮), সারোয়ার হোসেন (৬), মো. জনি (২৫), নূর হোসেন (৫৫), আয়েশা বেগম (৫০), জামাল হোসেন (৫৫), রুনা বেগম (৩০), মেহেদী (১১), মনির হোসেন (৯), হালিমা আক্তার (২০), কামাল হোসেন (২২), ইকরামুল হোসেন (২৬), কায়েস (২), হাসান (৬), রাকিব (২৬) ও রাসেল হোসেন (৩০)।
তাদের মধ্যে চিকিৎসাধীন জামাল হোসেনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে ওই হাসপাতালের আইসিইউতে (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) ভর্তি করা আছে। তার মাথা, বুকসহ শরীরের বিভিন্নস্থানে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে। আহত অন্যদের হাসপাতালের ১০১, ২০৪, ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন জনি জানান, তিনি লালবাগের একটি শাড়ির দোকানের কর্মচারী। পুরান ঢাকার ছোটকাটরা এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকেন। বোমা হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। পর মুহূর্তেই দেখি সবাই আতঙ্কে ছোটাছুটি করছে। আমিও দৌড় দেই। কিন্তু কিছুদূর দৌড়ে গিয়েই মাটিতে পড়ে যাই। তার পরের কথা আমার মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালে। আমার বাম পায়ের হাঁটুর নিচে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আমার পায়ে একাধিক স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আহত একরাম হোসেন জানান, আমি স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করছিলাম। মিছিলে অংশ নেয়ার জন্য অসংখ্য নারী ও শিশু ইমামবাড়ায় জড়ো হয়েছিল। নারী ও শিশুরা যেন কোন বিড়ম্বনার শিকার না হন এজন্য আমি তাদের বড় ভবনের নির্ধারিত স্থানে পাঠাচ্ছিলাম। তিনি আরও জানান, ওই সময় একটি ছোট বস্তু আমার পায়ে এসে লাগলে সেটি বিস্ফোরিত হয়। আমার বুক, দুই হাত, দুই পাসহ শরীরের বিভিন্নস্থানে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তার ধারণা, কোন ছাদ থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়নি। সন্ত্রাসীরা ভেতর থেকেই বোমা নিক্ষেপ করেছে। আকরাম বলেন, যারা এ হামলা করেছে তাদের নিশ্চয়ই একটি অসৎ উদ্দেশ্য আছে। তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনলেই বোঝা যাবে যে, কারা কী উদ্দেশ্যে ওই পৈশাচিক হামলা করেছে। আহত গৃহবধূ রিনা খাতুন জানান, প্রতি বছর তাজিয়া মিছিলের শোকের সমাবেশে যোগদান করি। ঘটনার সময় লাইব্রেরির দেয়ালের কাছে বসে মোনাজাত করছিলাম। ওই গেট দিয়ে অনেকেই তখন যাতায়াত করছিলেন। তিনি আরও জানান, মোনাজাতকালীন অবস্থায় বিকট আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠেলাঠেলি শুরু হয়। এরপর আমার কিছু মনে নেই। অচেতন অবস্থায় অন্যরা তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তিনি আরও জানান, প্রিয়নবীর প্রিয় নাতির শাহাদতবার্ষিকীতে আসাটা অপরাধ? কেন এমন হামলা করা হলো। রিনা খাতুনের পায়ে ও হাতে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে। তিনি তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন।
আহত হোসনি দালানের খাদেম নূর হোসেন জানান, মিছিল শুরু হওয়ার আগে দুলদুল ঘোড়াকে ছোঁয়াকে কেন্দ্র করে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। ওই স্থানে ছিল খুব ভিড়। অনেকেই ঘোড়ার পা অনেকক্ষণ ধরে ছিলেন। আমরা সেখান থেকে লোকজনকে মূল ভবনের দিকে এবং বাইরে চলে যেতে বলছিলাম। এ সময় লাইব্রেরির দেয়ালের কাছে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। কেউ ছাদ থেকে বোমা মেরেছে বলে মনে হয়নি। বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে অচেতন হয়ে যাই। তার পিঠ ও হাতে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে। তিনি আরও জানান, এ হামলার নিন্দা জানানোর কোন ভাষা নেই। তবে একটাই দাবি, হামলার সঙ্গে যত বড়ই মহারথিরা থাকুক না কেন, তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের মাধ্যমে সোপর্দ করা হোক।
২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আয়েশা বেগম জানান, প্রেসারের রোগী হওয়ার কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এরপর ঘোড়াকে সালাম করে চলে কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে আমার ভাতিজাকে ফোন দিচ্ছিলাম। তখন দুর্বৃত্তরা মুহুর্মহু একাধিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। এরপর সেখানকার লোকজন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তার বাম পায়ের হাঁটুর নিচের অসংখ্য স্থানে জখম হয়েছে।
গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, হোসনি দালান এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সেখানে জটলা। সবার মনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ছাপ। অসংখ্য শিয়াভক্ত হোসনের প্রার্থনার জন্য সেখানে এসেছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। গেটে আর্চওয়ে বসিয়ে পুলিশ আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন। পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি, পিবিআইসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পোশাকে ও সাদা পোশাকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
গতকাল ঘটনাস্থলে যান ডিবির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান ডিবির এডিসি সানোয়ার হোসেন। তিনি পুরো এলাকা পরিদর্শন করেন। এরপর তিনি সাংবাদিকদের জানান, বোমাগুলোর আলামত দেখে মনে হয়েছে সেগুলো দেশের তৈরি। তবে অত উন্নত মানের নয়। ঘটনাস্থল থেকে একাধিক অবিস্ফোরিত বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো পানিতে নিষ্ক্রিয় করার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে।
হোসনি দালানের তত্ত্বাবধায়ক এম এম ফিরোজ হোসাইন জানান, এ ঘটনার পর আমরা নিজেরাই হতবাক। ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাসে শিয়া ধর্মাবলম্বীদের শোক দিবসে এমন বর্বরোচিত হামলা করা হয়েছে। দুর্বৃত্তরা চেয়েছে যেন আমরা প্রিয়নবীর নাতির শোক দিবস পালন করতে না পারি, যেন তাকে ভুলে যাই। কিন্তু, এ কাপুরুষোচিত বোমা হামলায় আমরা ভীত নই। আমরা শোককে শক্তিতে পরিণত করে আগামীর পথচলা শুরু করবো। ইমাম হোসেনের আদর্শকে বুকে ধারণ করে সামনের পথ আরও সুন্দরভাবে চলবো।

No comments

Powered by Blogger.