চরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ুক উন্নয়নের আলো by জাহিদ রহমান

বহু নদ-নদীবেষ্টিত বাংলাদেশের একটি বড় অংশ চরভূমি হিসেবে পরিচিত, যেটাকে আমরা চরাঞ্চল বলে থাকি। চরাঞ্চল বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্বল্প বসতির সঙ্গে বিস্তীর্ণ ভূমি। চোখের সীমানাজুড়ে ধু ধু ভূমি ছাড়া যেন আর কিছুই চোখে পড়ে না। তবে সব চর এলাকাতেই বিস্তৃত চরভূমি দেখা যায় না। এই বিস্তৃত চরভূমি দেখা যায় মূলত দ্বীপ-চরাঞ্চলে। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, ধরলায় দ্বীপচর এলাকা তুলনামূলক বেশি। উপকূলীয় এলাকায়ও অনেক দ্বীপচর রয়েছে, যেখানে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে। দ্বীপচরের বৈশিষ্ট্য হলো, চরগুলো যেমন আয়তনে বড়, তেমনি মারাত্মক ভাঙনপ্রবণ এবং দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থা। মূল ভূমি থেকে দ্বীপচর যোগাযোগবিচ্ছিন্ন এক জনপদ। বছরের বেশির ভাগ সময় আবার দ্বীপচরগুলো পানিবেষ্টিত থাকে। বন্যায় এই চরগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বীপচরের মানুষ প্রধানত দুটি পেশার ওপর নির্ভরশীল—কৃষিকাজ ও মাছ ধরা। কৃষিকাজের বাইরে চরের বেশির ভাগ দরিদ্র মানুষ খাদ্যের চাহিদা মেটাতে মাছ ধরে। এর বাইরে দিনমজুরি, শ্রম বিক্রি এবং অন্যান্য মৌসুমিভিত্তিক কিছু পেশার ওপর স্বল্পসংখ্যক চরবাসী নির্ভরশীল।
দেশের দুর্গম চরাঞ্চল যে বরাবরই উন্নয়নবঞ্চিত, এটি নতুন করে বলা অপ্রয়োজন। বাংলাদেশের দুর্গম চরাঞ্চলগুলো আমাদের সবার দৃষ্টিসীমার বাইরের এক অংশ বলেই প্রতীয়মান। তাই অবহেলা, উপেক্ষা ও বঞ্চনার মাত্রাও এখানে সবচেয়ে বেশি। বহুকাল ধরেই চরাঞ্চলে মানুষ বসবাস করছে। চরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যাও অনেক। দ্বীপচর, উপকূলীয় চর—সব মিলিয়ে ৫০-৬০ লাখ মানুষের বসবাস চর এলাকায়। বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১০ শতাংশ চরভূমি বলে প্রতীয়মান। দেশের প্রায় ৩২টি জেলার শতাধিক উপজেলার অংশবিশেষ চরাঞ্চল। তীব্র নদীভাঙন, বন্যা, খরাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বেকারত্ব—এসব মোকাবিলা করেই বছরের প্রায় পুরো সময়টা ধরে চরের মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। ভৌগোলিক বিচার-বিশ্লেষণে চরাঞ্চল বাংলাদেশের উচ্চমাত্রার দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।
চরে বসবাসরত মানুষের বৃহৎ অংশই অতিদরিদ্র। অতিদরিদ্র ব্যক্তিদের বড় অংশই খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার থেকেই বঞ্চিত। সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষাসহ যেসব চাহিদা অনুসৃত রয়েছে, তার কোনোটিই পায় না চরবাসী। তাই নিরন্তর দুঃখ-কষ্টের এক বঞ্চনাময় জীবন অতিবাহিত করতে হয় তাদের। অবশ্য এই বঞ্চনা এক দিনের নয়, দীর্ঘদিনের। ফসল উৎপাদনের সুযোগ কম থাকা, দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থা, সরকারি সব ধরনের মৌলিক সেবার অপর্যাপ্ততা, কর্মসংস্থানের স্বল্পতা, পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড না থাকা, খাদ্যাভাব, নদীভাঙনসহ বহুমুখী দুর্যোগপ্রবণ হওয়ার কারণেই চরে বসবাসরত মানুষকে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। এ সংগ্রাম জন্মাবধি বললে ভুল হবে না। নদী ও জীবন প্রকল্পের গবেষণামতে, এখনো চরের ৬৫ শতাংশ মানুষ বছরের বিভিন্ন সময়ে কমবেশি খাদ্যকষ্টে ভুগে থাকে। ৯৫ শতাংশ মানুষ নিজ এলাকায় স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশনসেবা পায় না। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার চিত্রও করুণ। একই সঙ্গে চর এলাকায় বাল্যবিবাহ ও নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি। পরিবারে ও পরিবারের বাইরে স্বীকৃতি ও মর্যাদার প্রশ্নে চরের নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে। অথচ চরের কৃষি উৎপাদনে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেন নারীরাই।
এটি সত্য, চরে যেমন হাজারো সমস্যা রয়েছে, তেমনি রয়েছে সম্ভাবনার শত দুয়ার। চরে রয়েছে বিস্তীর্ণ জমি এবং এক বিপুল জনগোষ্ঠী। যে জনগোষ্ঠী নিজেরাই চরাঞ্চলে সমস্ত ধরনের ফসল ফলাতে সক্ষম। কৃষিতে আমাদের বিরাট সাফল্য থাকলেও এটি সত্য, চরের সব আবাদি জমি অধিক উৎপাদনের আওতায় এখনো আনা সম্ভব হয়নি। আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির সুবিধা না থাকায় চরাঞ্চলে বিস্তীর্ণ ভূমির তুলনায় কৃষি উৎপাদন অনেক কম। অথচ বিশেষজ্ঞদের ভাষায় চরের জমি হলো ‘হিডেন ডায়মন্ড’। চরের কৃষিজমিতে অধিক উৎপাদন করতে হলে প্রথমেই চরের কৃষককে বিভিন্ন ধরনের কৃষিসহায়তা, প্রশিক্ষণ, কৃষিপ্রযুক্তি প্রদানের বিকল্প নেই। চরের বিপুল জমিতে কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের যে পরিমাণ খাদ্য আমদানি করতে হয়, তা অনেকটাই কমে আসবে। একই সঙ্গে চরের অতিদরিদ্র মানুষের নিত্য যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস, সেটাও কমিয়ে আনা সম্ভব। কৃষির পাশাপাশি চর এলাকা গবাদিপশু পালনের জন্যও সবচেয়ে ভালো জায়গা। কৃষিব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি চরাঞ্চলে যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র আকারের বিভিন্ন ধরনের খামার ও উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে সেটাও চরের অর্থনীতিতে নতুন এক প্রবাহ তৈরি করবে।
সারা দেশে উন্নয়নের যে জোয়ার চলমান, চরাঞ্চলে উন্নয়নের সুবাতাস সেই অর্থে অনুপস্থিত। ডিএফআইডি, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড, কেয়ার বাংলাদেশ, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠনের সহযোগিতায় স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠনগুলো বিভিন্ন চরে প্রকল্পভিত্তিক কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করলেও তার মাত্রা বা ব্যাপ্তি যেমন বড় নয়, তেমনি স্থায়িত্বশীলতা নিয়েও প্রচুর প্রশ্ন রয়েছে। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে চরের মানুষের উন্নয়নে আজ পর্যন্ত সমন্বিত কোনো কর্মসূচি বা কর্মকৌশল ঠিক করা হয়নি। আর তাই গত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) চরের মানুষের উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তার একটি টাকাও খরচ করা হয়নি। এবারের বাজেটে (২০১৫-১৬) সে কথা স্বীকার করে নিয়েই বাজট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, ‘গত বছরের বরাদ্দ অব্যবহৃত থাকা সত্ত্বেও এবারও ৫০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করছি।’ এবারও চরের মানুষের উন্নয়নে বরাদ্দকৃত ৫০ কোটি টাকা ব্যবহার হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
চরবাসী এ দেশেরই মানুষ, কিন্তু কেন তারা অধিকারবঞ্চিত হয়ে থাকবে? কেন তারা চিরদিন বিস্তর বঞ্চনা আর উপেক্ষার গল্প হয়ে থাকবে? আমাদের সংবিধানের ১৯(১) ধারায়ও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে সচেষ্ট হইবেন।’ চরবাসীর সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের বাইরে এখনো কার্যকর, দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বৈষম্য, উপেক্ষা আর বঞ্চনার বেড়াজাল থেকে চরবাসীকে মুক্ত করতে সরকারসহ সবাইকে এখনই সক্রিয় হতে হবে। শুধু এ-ই নয়, এসডিসি অর্জন করতে হলে চরগুলোকে অবশ্যই আলোকিত করা প্রয়োজন রয়েছে। চরের মানুষকে অবশ্যই উন্নয়নের মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে। চরের সব দুঃখ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকারের নানামুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের কারণেই দারিদ্র্যের হার ৪০ থেকে ২৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের মধ্যে দেশে আর দরিদ্র জনগোষ্ঠী থাকবে না। কিন্তু দুর্গম চরাঞ্চলের উন্নয়নে এখনই একটি সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা না হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী নির্মূলের যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে, সেটা পূরণ করা অসম্ভবই হবে। দুর্গম চরাঞ্চলে উন্নয়নের আলো ছড়িয়ে দিতে এখনই উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
জাহিদ রহমান: গবেষক, সদস্যসচিব, ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স।
zahidrahman67@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.