‘চোখ তুইল্যা ফালানের কথা শুইন্যা কি আর দুনিয়ায় আছি!’ by মানসুরা হোসাইন

উপড়ে ফেলা চোখে ব্যান্ডেজ নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে একটু পর পর ব্যথায় কোঁকাচ্ছিলেন সুখী। আর ব্যান্ডেজের নিচে দিয়ে গড়িয়ে পড়া কষ জাতীয় কিছু মুছতে চাচ্ছিলেন। আরেক চোখের দুই পাতা একসঙ্গে লাগানো। তবে পুরোটাতেই কালচে দাগ আর ফোলা।
বিছানার পাশে বসা সুখীর মা লায়লা বেগম বললেন, ‘আমার মাইয়্যার হাত পা বানছে। একজন বুকের ওপর বসছে। চোখে লাইট ধরছে একজন। তারপর টেস্টার দিয়া আমার মাইয়্যার এক চোখ উপড়াইয়্যা তুইল্যা ফালাইছে। আরেক চোখ আছে কি না জানি না।’
তার পাশেই সুখীর বাবা নূর মোহাম্মদ বিলাপ করে বললেন, ‘আমার ম্যায়ার (মেয়ে) চিকিৎসার জন্য পাঁচ হাজার টাকা ভাংমু তাও সামর্থ্য নাই। আমার চারটা ম্যায়া। এক পোলা। তাদের আমি উল্টা হাত দিয়াও কোনো দিন থাপড় দেই নাই। জানে খাইট্যা আমি মানুষ করছি। আমি এর সুষ্টু (সুষ্ঠু) বিচার চাই।’
আজ রোববার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পঞ্চম তলায় ফিমেল ওয়ার্ড (১) এ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন সুখীর বাবা ও মা।
এক যুগ আগে বিয়ে হয়েছে সুখী আক্তারের (২৪)। যৌতুকের জন্য ঈদের আগের দিন শুক্রবার সাভারের জিঞ্জিরা এলাকায় এক ভাড়া বাসায় স্বামী, দেবর, ভাসুর ও ননদ মিলে সুখীর হাত-পা বেঁধে ইলেকট্রিক টেস্টার দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জানালেন সুখীর বাবা মা। ঘটনার পর সুখীর চিৎকারে বাড়িওয়ালার সহায়তায় এলাকাবাসী তাঁকে উদ্ধার করে এই হাসপাতালে ভর্তি করান। আর সুখীর স্বামী রবিউলকে তুলে দেন সাভার থানা-পুলিশের হাতে।
সুখীর বাবা ঈদের দিন মেয়ের স্বামীসহ তিনজনকে আসামি করে মামলা করেছেন। এখন রবিউল জেলে। সেদিন আসলে কী ঘটনা ঘটেছিল এখন পর্যন্ত তা জানার সুযোগ পাচ্ছেন না সুখীর বাবা-মা। সুখীর কাছে কোনো কিছু জানতে চাইলেই তাঁর যে চোখের দুই পাতা একসঙ্গে লেগে আছে সেখানে শুধু কান্নার পানি জমে। তাই তাঁকে কেউ এ ঘটনা জানার জন্য জোর করছেন না।
সাভার থানা-পুলিশের এক সদস্য ফোন করে সুখীর মাকে ঘটনার কথা জানান। তারপর থেকে পুরো পরিবারের দিশেহারা অবস্থা। তাঁদের ঈদ কেটেছে হাসপাতালে। সুখীর সাত বছর বয়সী মেয়েকেও সুখীর শ্বশুরবাড়ির লোকজন আটকে রেখেছে। সুখীর শ্বশুরবাড়ি ঢাকার সিঙ্গাইর থানায়। আর সুখীর বাবার বাড়ি নবাবগঞ্জ থানায়।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক জালাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুখীর ডান চোখ একেবারে তুলে ফেলা হয়েছে। সুখীকে যাঁরা হাসপাতালে ভর্তি করাতে এসেছিলেন তাঁরা তুলে ফেলা চোখটি সঙ্গে করে এনেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন চিকিৎসকেরা যদি তা আবার লাগাতে পারেন। আসলে তা করা সম্ভব না। আর সুখীর বাম চোখেও প্রচণ্ড আঘাত করা হয়েছে। তবে আই বল আছে। চোখের নার্ভের ফাংশন খুব দুর্বল। লাইট ধরলে সে তা দেখতে পাচ্ছে না বলছে। তবে আমাদের বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকেরা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে বলছেন, এ চোখ দিয়ে কিছুটা দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। দেখতে পাবেই তা বলা যাচ্ছে না। কাল সোমবার হাসপাতালের মেশিন দিয়ে সুখীর ব্রেন ও চোখে সিটিস্ক্যান করা হবে।’
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক জালাল আহমেদের আজ ছিল ঈদের ছুটি। তবে এই ঘটনা শুনে হাসপাতালের অন্যান্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের নিয়ে দুপুরে তিনি সুখীকে দেখতে আসেন।
অধ্যাপক জালাল আহমেদ বলেন, ‘চিকিৎসক জীবনে ডাকাত, এলাকাবাসীর সঙ্গে শত্রুতাসহ বিভিন্ন কারণে চোখ উপড়ে ফেলা রোগী পেয়েছি। তবে স্বামী ও অন্যরা মিলে ইলেকট্রিক টেস্টার দিয়ে এভাবে চোখ উপড়ে ফেলেছে তা দেখিনি। সুখীকে দেখার পর থেকে মনে হচ্ছে, মানুষ এত অমানুষ হয় কীভাবে? সুখীর চোখের জন্য তিনটি ইনজেকশন লাগবে। একেকটির দাম এক হাজার টাকার বেশি। হাসপাতালে এ ইনজেকশনের সাপ্লাই নাই। পরিবারটির অসহায় অবস্থা দেখে আমি আমার নিজের পকেট থেকে আজ একটি ইনজেকশন কেনার দাম দিয়েছি। আর দুইটির দাম জোগাড় করতে না পারলে হাসপাতালের সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে তা জোগাড় করার চেষ্টা করব। চোখের সামনে এত কম বয়সী মেয়ের কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্য করা যাচ্ছে না। মেয়েটা কথা খুব কম বলছে। ঘটনা কী কারণে ঘটেছে তা স্পষ্ট করে জানা যায়নি। তবে যে কারণেই ঘটুক, স্বামী ও অন্যরা মিলে এভাবে আঘাত করতে পারে তা না দেখলে বোঝা যেত না।’
চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের আনসার কমান্ডার আবুল কাশেম সুখীকে হাসপাতালে আনার পর প্রথম দেখার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘দুই চোখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। কাগজে করে উপড়াইয়্যা ফেলা চোখ আমরা অনেকেই দেখছি। অনেকে মোবাইলে ছবিও তুলছে। শুধু পশুর বেলাতেই সম্ভব অন্যকে এইভাবে হামলা করা।’
সুখীর মা জানালেন, মাত্র মাস খানেক আগে মেয়ের স্বামী বিদেশ থেকে ফিরেছে। এর আগেও একবার বিদেশ গিয়েছিল। সুখীর বাবা-মা একবার তিন লাখ টাকা দেন বিদেশ যাওয়ার সময়। এবার বিদেশ থেকে একেবারে চলে এসেছে বলে জানায় মেয়ের স্বামী। আসার পর আবার স্ত্রীর কাছে দেড় লাখ টাকা দাবি করে। মেয়ে বেশির ভাগ সময় বাবার বাড়িতেই থাকত। এর আগেও মেয়েকে মারধর, ঘরে বন্দী করে রাখা, খাবার না দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে বিচার-সালিস হয়েছে। সুখীর বাবা-মা অনেক বার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন মেয়েকে আর শ্বশুরবাড়ি পাঠাবেন না। এবার মেয়ের স্বামী বিদেশ থেকে আসার পর সাত দিনের মাথায় মারধরের ঘটনায় মেয়েকে নিয়ে আসেন বাবা-মা। তবে মেয়ে নিজের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাবা-মা কাউকে কিছু না বলে স্বামীর কাছে চলে যায়। সাভারের কোথায় বাসা ভাড়া নিয়েছিল বা কেনো নিয়েছিল তার কিছুই জানেন না তাঁরা।
সুখীর মা জানালেন, ঘটনার দিনদুপুর ১২টার দিকে সুখীর স্বামীর মুঠোফোনে ফোন দেন মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে ঈদের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। মেয়ের স্বামী ভালো ভাবে কথাও বলে। তবে বেশ কয়েক দিন ধরে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও নানা অজুহাতে কথা বলতে দিত না। সেদিনও বলে সুখী ঘুমাচ্ছে। নাতির সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও বলে ও দোকানে গেছে। তারপর সেই দিনই এ ঘটনা ঘটায়।
সুখীর বাবা গৃহস্থালির কাজ করেন। জমিজমা নেই তেমন একটা। সুখীর মা বলেন, ‘কয়দিন ধইরাই খালি বুকের মধ্যে কেমন জানি করতাছিল। আপনজন মরলে যেমন লাগে তেমন লাগে। হুদাহুদি কান্না আহে। আজেবাজে স্বপ্ন দেহি। তারপর পুলিশের ফোনে চোখ তুইল্যা ফালানের কথা শুইন্যা কি আর দুনিয়ায় আছি! কাটা মুরগি যেমুন ছটফট করে আমি খালি ছটফট করছি।’
সাভার থানার সাব ইন্সপেক্টর সুখীর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহেদ আলী টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, যৌতুক মামলার আসামি সুখীর স্বামী এখন জেলখানায়। অন্য দুই আসামি এখনো ধরা পড়েনি।
সুখী অনেক বেশি অসুস্থ এবং মানসিক ভাবে ট্রমার মধ্যে থাকায় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সুখীকে কথা বলার জন্য জোর করা হয়নি। প্রতিবেদক চলে আসার সময় সুখীর বাবা আবার বললেন, ‘আমার এতটুকুন বয়স হইছে, কোনোদিন এই ধরনের ঘটনা দেহি নাই। আমি সরকারের কাছে আর কিছু চাই না, খালি সুষ্টু বিচার চাই।’

No comments

Powered by Blogger.