এই ছিল প্লুটোর বুকে!

চাঁদ ক্যারনের আলোয় প্লুটোর বুকে চাঁদের আলো।
রাইট ভ্রাতৃদ্বয় আকাশে বিমান ওড়ানোর ১১২ বছরের মাথায় পৃথিবী থেকে এক নভোযান সৌরজগৎ পাড়ি দিল। ১০ বছর ধরে চলতে চলতে ৩০০ কোটি মাইল পাড়ি দিয়ে বরফাচ্ছন্ন এক গ্রহের ছবি তুলল নভোযানটি। এক সপ্তাহ আগেও প্লুটো পৃথিবীর মানুষের কাছে সৌরজগতের দূরতম গ্রহ হিসেবে একটা ঝাপসা বিন্দুর মতোই ছিল। কিন্তু এখন তার ভূ-প্রকৃতির নানা ধাঁধা সামনে হাজির হচ্ছে। নাসার নভোযান নিউ হরাইজনসের পাঠানো ছবিতে প্লুটোর ভূপৃষ্ঠে দেখা গেছে বরফঢাকা পর্বতমালা।
গতকাল বুধবার নিউ হরাইজনসের পাঠানো ছবি থেকে প্লুটোর ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে প্রথমবারের মতো ধারণা পেলেন গবেষকেরা। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার নভোযানটি মঙ্গলবার প্লুটোর প্রায় সাত হাজার ৭৫০ মাইল দূর থেকে প্লুটোর এই ছবিগুলো তুলেছে। নাসা এর মধ্য থেকে বাছাই করা কিছু ছবি উন্মুক্ত করেছে।
২০০৬ সালে পূর্ণাঙ্গ গ্রহের মর্যাদা হারায় প্লুটো। সূর্যের দূরতম গ্রহ হিসেবে একে ডাকা শুরু হয় বামন গ্রহ বলে। নাসার গবেষকেরা বলছেন, প্লুটোর পর্বতগুলো ১১ হাজার ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে যা অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের রকি পর্বতমালার কাছাকাছি।
অবশ্য প্লুটো-পৃষ্ঠের ছবি গবেষকেদের বিস্ময় জাগিয়েছে এর বিশেষ ভূগঠনের কারণে। প্লুটোর অবস্থান কুইপার বেল্ট অঞ্চলে হলেও ছবিতে আগ্নেয়গিরির ফলে সৃষ্ট কোনো গর্ত বা জ্বালামুখ দেখতে পাননি তাঁরা। কুইপার বেল্ট হচ্ছে নেপচুন গ্রহের বাইরের একটি বিশেষ অঞ্চল যেখান থেকে মহাকাশীয় বস্তুর ধ্বংসাবশেষ নিয়মিত প্লুটো ও এর পাঁচটি চাঁদের ওপর আঘাত করতে থাকে।
প্লুটোর চাঁদ ক্যারন
নাসার গবেষকেরা দাবি করছেন, তাঁদের মনে হয়েছে প্লুটো এখনো ভূতাত্ত্বিকভাবে গঠিত হচ্ছে বা সক্রিয়; এবং সেখানে এমন কিছু অংশ রয়েছে যা জ্যোতির্বিজ্ঞানের শর্ত অনুযায়ী এখনো নবীন অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ এগুলোর বয়স ১০ কোটি বছরের বেশি হবে না, যা আমাদের এই সৌরজগৎ সৃষ্টির ৪৫০ কোটি বছরের ভগ্নাংশ মাত্র। নিউ হরাইজনস প্রকল্পের বিজ্ঞানী জন স্পেনসার বলেন, ‘প্লুটো এখনো সক্রিয়।’
বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো এমন ভূতাত্ত্বিক সক্রিয়তার নমুনা দেখতে পান ট্রাইটন নামের নেপচুনের এক চাঁদে। আশির দশকে ভয়েজার-টু মহাকাশ মিশনের তোলা ছবি দেখে সেখানেও কোনো আগ্নেয়গিরির ফলে সৃষ্ট গুহার সন্ধান পাননি তাঁরা।
গবেষক অ্যালাস স্টার্ন দাবি করেছেন, ‘আমরা একটি বিষয়ে একমত হয়েছি যে, ছোট গ্রহগুলো দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকতে পারে। আমি মনে করি এটা এখন অনেক ভূতাত্ত্বিকদের ড্রয়িং বোর্ডে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে এবং এর কারণ খুঁজতে ও ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে উত্সাহী করবে।
গবেষক স্টার্ন বলেন, যে পাথুরে স্তর দিয়ে প্লুটোয় পর্বত তৈরি হয়েছে সেগুলো অবশ্যই পানি বা পানি-বরফ দিয়ে তৈরি। এ ছাড়া প্লুটোর পৃষ্ঠে আর যে ধরনের বরফের প্রাচুর্য থাকতে পারে সেগুলো নাইট্রোজেন, মিথেন ও কার্বন মনোক্সাইড দিয়ে তৈরি। শুধু ওই একটি উপাদান দিয়ে পর্বত তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। কারণ এটি অনেক কোমল।
প্লুটোর পৃষ্ঠের ছবি পাঠানোর আগে নিউ হরাইজনস প্লুটোর সম্পূর্ণ এই ছবিটি পাঠিয়েছিল।
প্লুটোর বুকের ছবি তুলে পাঠানো মহাকাশযান নিউ হরাইজনস তৈরি করতে ব্যয় হয়েছে ৭০ কোটি মার্কিন ডলার। মহাকাশযানটি পারমাণবিক শক্তিতে চলে। দেখতে অনেকটা পিয়ানো আকৃতির। প্লুটো এত দিন মানুষের কাছে একটি ঝাপসা বিন্দুর মতো থাকলেও নিউ হরাইজনসের ছবির কারণে আগের চেয়ে অন্তত দশগুণ অতিরিক্ত তথ্য জানা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
অবশ্য এখনই সবকিছু জানা হয়ে যাচ্ছে না। এক দশকে তিন শ কোটি মাইল পাড়ি দিয়ে যে ছবি নিউ হরাইজনস তুলেছে তা এখন পৃথিবীতে আসতে শুরু করেছে। আগামী ১৬ মাস ধরে এই তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন গবেষকেরা।
প্লুটোর ভূ-প্রকৃতির ছবি। নিউ হরাইজনস সাত হাজার ৭৫০ মাইল দূর থেকে প্লুটোর ভূপৃষ্ঠের এই ছবি তুলেছে। এতে প্লুটোতে রকি পর্বতমালার সমান উঁচু বরফের পর্বত দেখা যাচ্ছে। গতকাল বুধবার ছবিটি প্রকাশ করেছে নাসা।
বুধবার প্লুটোর বৃহত্তম চাঁদ ক্যারনের ছবিও প্রকাশ করেছে নাসা। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের সমান আয়তনের এই উপগ্রহটিতে চার থেকে ছয় মাইল গভীর গিরিখাত রয়েছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, ক্যারন গিরিখাত, খান খন্দ, রহস্যময় অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চলের ছোট্ট এক দুনিয়া। শুধু এই একটি ছবিতে মজার বৈজ্ঞানিক বিষয় রয়েছে।
(এএফপি, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস)

No comments

Powered by Blogger.